Hot Posts

6/recent/ticker-posts

Ad Code

ভদন্ত প্রজ্ঞাজ‍্যোতির বহু স্বপ্নের রাংকূট বনাশ্রম রক্ষকগণ (৭ম পর্ব)



 ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতির বহু স্বপ্নের রাংকূট বনাশ্রম রক্ষকগণ (৭ম পর্ব)
********************
জানিনা এই হাজার বছরের পুরাকীর্তিটি নিয়ে ১৮৬৬ খৃস্টাব্দে ইহার তথ্য সংগ্রহকারী আচারিয়া পূর্ণাচার ও তৎ শিষ্য ভদন্ত জগৎচন্দ্র মহাস্থবির(উনাইনপুরা) কি স্বপ্ন দেখে ছিলেন । ভদন্ত জগৎচন্দ্র নিজের গড়া কোন শিষ্য রেখে যেতে পারেননি । খুব সম্ভব জগৎচন্দ্র মহাস্থবিরের শেষকৃত্য রাংকূট বিহার প্রঙ্গনে সমাপ্তির পর বসন্ত নামে যেই ভিক্ষুটি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি অতবেশী পরিচিত না থাকায় বেশীদিন রাংকূটে অবস্থান করতে পারেননি। কিন্তু রাংকূটের নাসিরকূল পাড়ার দায়ক রাংকূট সেবক প্রিয় দাদু চিন্তাপ্রু মহাজন সেই বসন্ত ভিক্ষুর দ্বারা রাংকূটে সৃষ্ট আম কাঁঠালের বনায়নটির গল্প আমাকে শুনিয়েছিলেন। শ্রদ্ধেয় বসন্ত ভিক্ষুর রোপিত রাংকূটের রসালো ফলনের বিশাল বিশাল আম কাঁঠালের ফল গুলো খাওয়ার ভাগ্য ভদন্তের না হলেও ২০১৩ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত আমরা ভোগ করেছি। তাই ভদন্তের প্রতি জানাই কৃতজ্ঞ বন্দনা ।জানিনা স্থাপনা প্রিয় বর্তমান পরিচালকের হাতে সেগুলো সুরক্ষিত আছে কি না ।
১৯৬৬ খৃস্টাব্দে আমার গুরুদেব বাঁশখালীর উত্তর জলদি বনবিহার হতে আরো একটু নির্জন পরিবেশের সন্ধানে চকরিয়ার মানিকপুর হয়ে রামুর সীমা বিহারে উপস্থিত হলে ঘটনাক্রমে সেখানের উন্নত পর্যায়ের সাধক হেমবাবুর সাথে দেখা হয়। তিনিই গুরুদেবকে এই রাংকূট দেখতে প্রথম নিয়ে আসেন।
উল্লেখ্য ৬ষ্ঠ সঙ্গায়ন দর্শনে সাতকানিয়া ও রামু হতে কয়েকজন দায়ক রেঙ্গুনে গিয়েছিলেন । তন্মধ্যে যুবক হেমেন্দ্র লাল বড়ুয়া (বড়হাতিয়া) ও যুবক অরুণ কুমার বড়ুয়া(রামু) অন্যতম।তাঁরা উভয়ে তথায় প্রখ্যাত বিদর্শন শিক্ষক মহাসী সেয়াদ পরিচালনায় ধ্যান অনুশীলন করেন। তন্মধ্যে হেমবাবু ছিলেন বিদর্শন ধ্যানে বেশ উন্নত পর্যায়ের। অপরজন ছিলেন উপাসক অরুন চন্দ্র বড়ুয়া ওরফে অরুণ মহাজন( শেষ জীবনে বিদর্শনাচার্য প্রজ্ঞাবংশ ভিক্ষু নামে পরিচিত) । গুরুদেব ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথেরোর সাথে এ দুই সাধকের হৃদ্যতা ছিল চমৎকার। তাঁরা মাঝে মাঝেই রাংকূট গিয়ে গুরুদেবের সাথে ধ্যান বিষয়ক আধ্যাত্মিতটক অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেন। তবে , অরুণ মহাজন যখন রাংকূটের বিপদাপদের অভিভাবক সুবর্ণ মহাজনের সাথে প্রতি পূর্ণীমায় বুদ্ধপূজা করতে হাজারী কুলের প্রেমলাল মহাজন সহ আসতেন তখন কিন্তু, আলোচনা হতো মিলিন্দ প্রশ্ন , সুত্তপিটক ও জাতকাদি ব্যবহারিক বৌদ্ধদিক বিষয়াদি নিয়ে।
একটু আগেই উল্লেখ করেছি ১৯৬৬ খৃস্টাব্দে একপ্রকার দীর্ঘ পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা রাংকূটের সন্ধান আমার গুরুদেবকে দিয়েছিলেন রামুর সাধক সেই হেমেন্দ্র বড়ুয়া(হেমবাবু) । ১৯৭১ এ সেই হেমবাবুর সাথে আমার প্রথম সাক্ষ্যাতেই কথা বলার সময় মনে হলো তাঁর নিরভীমান শান্ত স্নিগ্ধ মনের আকর্ষণীয় শব্দগুলোতে মধু যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। তাঁর সাধারণ কথা বার্তা পর্যন্ত আমার কাছে এমনই প্রতীয়মান হতো। সেদিনের এই ভালোলাগা আমার স্মৃতিতে রয়ে গেল চির অম্লান হয়ে।
আমার পরিব্রাজক জীবন বহুকাল পরে ১৯৯৩ খৃস্টাব্দে হেমবাবুর জীবনের সাথে আবার যুক্ত হলো । তখন তিনি পঙ্গুত্ব বরণ করে চরম আর্থিক দৈন্যতার শিকার হয়েছেন। স্বামী পরিত্যক্ত একমাত্র কন্যা ও তার এক পুত্র সন্তান নিয়ে হেমবাবু বাড়ীতে লাগানো এক ছোট্ট সুপারি বাগানের আয় নির্ভর জীবন কাটাতে গিয়ে কৃচ্ছতার সীমা নেই। রামুর কোন সাধারণ ধর্মীয় অনুষ্ঠানও হেমবাবুকে বাদ দিয়ে হতো না। তেমন জনপ্রিয় মানুষটি এক সংঘদানে ভিক্ষুসংঘকে খাদ্য পরিবেশন কালে হঠাৎ পড়ে গিয়েই নাকি পা ভেঙে ছিলেন । কিন্তু, এই বিপদে এমন সজ্জনটির সুচিকিৎসা কেন হলো না জানিনা। হেমবাবুর এমন দুঃসময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে ডব্লু এফ বি এর কনফারেন্স আমার পরিচয় হয় জার্মান বুড্ডীস্ট ইউনিয়নের দুই প্রতিনিধির।তাঁরা আমার শিক্ষা ও মানবিক কার্যক্রমের কথা তাঁদের চেয়ারম্যান খৃস্টা বেটেন রাইডার কে জানালে তিনি ১৯৯৪ তে আমাদের ভিক্ষু ট্রেনিং সেন্টার , বিহার ভিত্তিক শিশু শিক্ষা ও বৃদ্ধ অসহায়দের কিছু আর্থিক সহায়তার কর্যক্রম প্রত্যক্ষ ভাবে দেখতে আসেন। সেই সুত্রে রামু সীমা বিহারে থাকা দুই সাধুমা ( একজন ১৯৭৩এ গহিরা শান্তিময় বিহারে আমার অসুস্থতায় মায়ের মতো সেবাকারী) ও রামুর রাউরঘোনা বিহারের বৃদ্ধ ভিক্ষু কে কিছু সহায়তা দানে আমি আবেদন করি । তাঁরা তিন মাস অন্তর মহামন্ডল কল্যাণ সংস্থার পরিচালনায় এই সহায়তা লাভ করতেন।
সেই সাধুমাদের কাছে জানতে পারি হেমবাবুর এমন দুরবস্থার কথা। কালবিলম্ব না করে হেমবাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখি ভাঙা পায়ের অবস্থা খুব খারাপ। সিদ্ধান্ত নিই আমার সাথে চট্টগ্রাম নিয়ে গিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করবো । সিদ্ধান্ত হেমবাবুরকে জানালে তিনি করুণভাবে আমার দিকে চেয়ে নীরব অশ্রু ঝরালেন । বললেন , আমার মেয়ে যদি সাথে যায়; নাতিটাকে দেখবে কে ; ভান্তে? বললাম তার স্কুল তো খোলা। না হয় তাকেও সাথে নিয়ে যেতাম । আমি বললাম চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারে এমন কেহ আমার সাথে নেই যে ; আপনার কখন কি লাগে আমাকে জানাবে । সাধুমাকে বললাম হেমবাবু ঘরে না ফেরা পর্যন্ত হেমবাবুর নাতিটির দায়িত্ব নিতে । আমি তার আহারাদি প্রয়োজনের কথা ভেবে কিছু টাকা সাধুমাকে দিয়ে একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করে হেমবাবু ও মেয়েকে সাথে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলাম । হাসপাতালে আমার দুই ভাগিনী নার্স ছিল । ভাগিনী অংসিন সিনিয়র নার্স; তার ছোট বোন অনিমা জুনিয়র। ডাক্তার প্রভাত বাবু সহ বড়ুয়া ডাক্তার যে কয়জন আছেন ;তাঁদেরকে সাধক হেমবাবুর পরিচয় করে দিয়ে সহসা যাতে আরোগ্য লাভ করতে পারেন সেই অনুরোধ জানিয়ে ভর্তি করে দিলাম । ভাগিনীদের দায়িত্ব দিলাম রোগী সহ মেয়েটির যা প্রয়োজন আমাকে ফোনে জানাতে । দেখলাম মাত্র কয়েক দিনে হাসপাতালের চিকিৎসা শেষ করে আমাকে বললেন এখন বাসায় রেখে ঔষধ সেবন করাতে হবে আর সপ্তাহে একবার চেকআপ করানোর জন্যে হাসপাতালে আনতে হবে। রামু পাঠিয়ে দিলে প্রতি সপ্তাহে চেকআপ সম্ভব নহে দেখে আমি চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারে রাখার ব্যবস্থা করলাম । এভাবে মাস দুই গত হতেই একদিন হেমবাবু সকাল থেকেই নাকি মেয়েকে বার বার বলছিলেন ভান্তের সাথে আমি একটু কথা বলতে চাই । দুর্ভাগ্য বশতঃ সেদিন সকাল দুপুর আমন্ত্রণে ব্যস্ত থাকায় মেয়েটি আমাকে পিতার ইচ্ছাটা জানানোর সুযোগ পায়নি । দুপুর দুইটার দিকে বিহারে ফিরে দেখি হেমবাবু আর নেই। বুদ্ধ মার্গে নিবেদিত জীবনের দীপশিখা এভাবেই নিভে গেল চিরতরে । মনে খুব আঘাত পেলাম আমার হৃদয়ের পরম আত্মীয়টির অন্তিম কথা গুলো শোনার ভাগ্য না হওয়ায়। তারপরও ভাবলাম তিনি অসহায় মেয়ে আর নাতিটির কথা বেশ কয়েক বার আমাকে বলে ছিলেন। তাই , নাতিটির লেখা পড়ার খরচের দায়িত্ব আমি নিলাম । কিন্তু, চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের বৌদ্ধ সমিতির মানুষ গুলোর অমানবিক আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ১৯৯৬ এর জুলাই মাসে যখন চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব চিরতরে ত্যাগ করে পূজ্য বনভান্তের সান্নিধ্যে চলে গেলাম ; তখন থেকে অসীত নামক হেমবাবুর নাতিটির সাথেও আমার যোগাযোগ রাখা আর সম্ভব হয়নি। পরে জেনেছি আমার সহায়তা বন্ধ হওয়ার পর অসীত গ্রামে টিউশনি করে নিজের লেখাপড়া চালিয়েছে। একজন মেধাবী ছাত্র হওয়ার কারণে সে টিউশনীতে ভালো নাম করেছিল। ফলে মায়ের অভাবও পূরণ করতে পারতো। এই অসীত পরবর্তী জীবনে রামুতে একজন শিক্ষক হিসেবে এখন যথেষ্ট সুনামের অধিকারী।
কিন্তু আমি আশ্চর্য হয়েছি রামুর সকলের এতো শ্রদ্ধাভাজন এই হেমবাবুর ভালোমন্দ জানার জন্যে এই দুই মাসে একজন ব্যক্তিও চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারে আসেননি। তারপরও নিজের ঘরবাড়ি যখন রামুতে আছে ; তাই হেমবাবুর মরদেহ রামু পাঠিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত নিলাম । আর তখনই জানতে পারলাম চট্টগ্রাম আছাদ গন্জের বড়ো ব্যবসায়ী ধর্মপাল বড়ুয়া নাকি হেমবাবুর আপন ভাইয়ের সন্তান । আমি তৎক্ষনাৎ ধর্মপাল বাবুকে হেমবাবুর মৃত্যু সংবাদ দিলে ; তিনি আসলেন। আর মরদেহ সৎকারের সমস্ত দায়িত্ব তিনি একাই নিলেন। ভাবলাম হেমবাবু এমন ধনাঢ্য ব্যক্তির পরমজন হয়েও কেন আমাকে একবারও ধর্মপাল বাবুর বিষয়ে কিছুই বলেননি? পরে জানলাম হেমবাবুর কন্যাটির যিনি স্বামী তিনি আপন ভাগিনা । সেই ভাগিনা বিনা কারণে স্ত্রী সন্তান বাদ দিয়ে আরেক টি মেয়ে বিয়ে করাকে নিয়ে হেমবাবু নিজের জ্ঞাতি স্বজনের সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ ত্যাগ করেছিলেন ।
আমি মাঝে মাঝে নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান ভাবি । এজীবনে মা বাবা ও আমার গুরুদেবের প্রতি মনের মতো দায়িত্ব পালনে নানা কারণে অক্ষম হলেও ; হেমবাবুর মতো বহু সংকটাপন্ন জনকে সেবা সহায়তা দানের সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
১৯৭১ এ যেই রাংকূটের সাথে আমার সম্পর্কের কারণে হেমবাবুর মতো আরো কতোজনের সঙ্গে চিরজীবনের সম্পর্ক আমার হলো তা বলা অসম্ভব । সেই রাংকূটের সমস্ত ভূমি আর এস ,পি এস, ও বি এস খতিয়ানে ছিল প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির ও প্রাচীন বৌদ্ধ শ্মশানের নামে । কিন্তু খতিয়ানে মালিকানায় ছিল ভরত সরকার , পাকিস্তান সরকার ও বাংলাদেশ সরকার। মানে রাংকূটের সম্পূর্ণ ভূমি সম্পদ সরকারী খাস জমি । আর সেই ভূমি তদারকির দায়িত্বে কক্সবাজার জেলা কমিশনার ।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে সেই বৃটিশ সময়কাল থেকেই কর্মচারীদের মধ্যে সবসময়ে হিন্দু প্রধান্যতা থাকতে দেখাগেছে । তাই হিন্দুরা সুযোগ পেলেই রাংকূটের কিছু না কিছু জমি হিন্দু মন্দিরের নামে করে নেয়। অপরদিকে স্থানীয় মুসলিম নেতারাও বনবিটের কর্মকর্তাকে আর্থিক ভাবে বশীভূত করে ক্রমে নানা অন্চলের ভূমিহীন মানুষদের কাছে প্লট বিক্রি করে করে দুইটি মুসলিম পাড়া গড়ে তুলেছেন। আমার গুরুদেব রাংকূটের স্থানীয় অভিভাবক রামুর সুবর্ণ মহাজন , অধ্যাপক অরবিন্দ বড়ুয়া, অধ্যাপক দীপক বড়ুয়া প্রমূখদের এবিষয়ে জানালেও সমস্যাটি সমাধানে কোন চেষ্টা করেননি। আমার গুরুদেব প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পরিচালকে অনেক চেষ্টার পর পরিদর্শনে নিয়ে এসে ভাগ্যক্রমে একটি পরিদর্শন রিপোর্ট আদায় করেছিলেন । আমার গুরুভাই চন্দ্রজ্যোতি মহাস্থবির এসব বিষয়ে আর কোন অগ্রগতি সাধন করতে না করলেও আমার সংগ্রহ করা ইতালিয়ান মিশনারী ফাদার লুইজী লুপির সহায়তায় মুসলিম ও হিন্দু আগ্রাসনের পর অবশিষ্ট যতটুকু আছে ততটুকু ঘেরা দিয়ে প্রকাশ্য আগ্রাসন রোধে সক্ষম হলেও সকলের অগোচরে হিন্দুরা পুলিবিহারী দেবনাথ নামে এক সরকারী কর্মকর্তা কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে আগমণের সুযোগে তাঁর মাধ্যমে রাংকূটের অবশিষ্ট ভূমির অর্ধেক হিন্দু মন্দিরের নামে রেকর্ড করে নেয়। পরিস্থিতি আরো নাজুক করে তোলে আমার প্রতিষ্ঠিত জগজ্জোতি শিশুসদনের পরিচালকগণও হিন্দু মন্দিরের সাথে যুক্ত হয়ে অবশিষ্ট অর্ধেক শিশু সদনের নামে করে ফেলতে আবেদন করে বসে । সেই আবেদনের চুড়ান্ত রিপোর্ট প্রেরণের জন্যে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক রামু উপজেলার ভূমি কমিশনারকে নির্দেশ দিলে ; সেই অফিসের রাজারকুল নিবাসী এক বড়ুয়া কর্মচারী আমাকে বিষয়টি জানান । আমি তাকে জগজ্জোতি শিশুসদনের আবেদন পত্রের ফটোকপি আমাকে দিতে অনুরোধ করি । তাদের আবেদনটি পড়ে আমি হতবাক হয়েছি । পুরো রাংকূট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ শ্মশান চলে যাবে জগজ্জোতি শিশু সদনের নিয়ন্ত্রণে । রাংকূটের দায়কগণ ২০০৮ এ ও আমাকে বলেছিলেন ইতিপূর্বে আমার গড়া এই শিশুদন রাংকূটে অবাধ আসা-যাওয়া ও শ্মশানে মরদেহ সৎকার নিয়ন্ত্রণে একবার পদক্ষেপ নিয়ে মেইন গেটে নোটিশ ঝুলায়ে ছিল । তখন আমার গুরুভাই চন্দ্রজ্যোতি কোন প্রতিবাদ না করলেও রাংকূটের দায়কদের তীব্র প্রতিবাদে নোটিশ টি শিশুসদন পরিচালকেরা প্রত্যাহার করেছে । তাদের সেই অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে আবারো হিন্দুদের সাথে মিলে এই গোপন পদক্ষেপ আমি মেনে নিতে না পারায় তারা আমাকে নানাভাবে অপমান অপদস্থ করা শুরু করে । তারা আওয়ামী লীগ দলের সাথে যুক্ত থাকায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সর্বস্তরে আমাকে রাংকূটে একজন বহিরাগত দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করে রাকূট হতে আমাকে বহিষ্কারের জন্য রামু জন্মজাত কিছু ভিক্ষু সহ কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে সাক্ষ্যাত করে আবেদন জানায় । এই ঘটনাটি আমাকে অবগত করেন ব্যরিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া আমি যখন বিপদের শিকার হয়ে তাঁর সহায়তা চেয়ে ফোন করি । ২০১২ খৃস্টাব্দে রামুর বিহার পোড়ানোকে ভিত্তি করে রামু খীজারী স্কুল মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ মন্চে মাননীয় সংঘরাজ সহ বিশাল সংখ্যক ভিক্ষুর সমাগম হয় । তাতে আমিও অংশগ্রহণ করতে চাইলে আমাদের রাংকূট বৌদ্ধ বিহারের বেনারটি পর্যন্ত রামু চৌমুহনীতে লাগাতে দেয়া হয়নি । অপরদিকে পরবর্তী সময়ে রামুতে একই স্থানে বিরোধী দলীয় নেতা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও ভাষণ দিতে আসেন । বান্দরবান ঘুমদুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উপাসক দিপক বড়ুয়া আমাকে অনুরোধ করলেন সেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্মেলনে যোগদানের জন্যে। আমি অসম্মতি জানালে তিনি বললেন ; আপনারা শেখ হাসিনার সমাবেশে গেলেন । আর আজ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আগমনে একজন ভিক্ষুও যদি রামু থেকে গমণ না করেন কেমন হবে? কক্সবাজারে আওয়ামীলীগের চেয়ে বি এন পির সমর্থক বেশী । আপনারা ভিক্ষুরা কি তাহলে সবাই আওয়ামীলীগের মানুষ ? এতোসব বিতর্কের মুখে শেষ পর্যন্ত যাওয়ার সম্মতি জানালাম। আমার সেই যাওয়াকে পুঁজি করেই শেষ পর্যন্ত আমাকে রাংকূট হতে বহিষ্কারের জন্যে সরকারী জমির বনায়ন ধ্বংস, সরকারি জমি দখল, আর পাহাড় কাটার অভিযোগে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে আমার বিরুদ্ধে মামলার নোটিশ পাঠানো হলো। অথচ, রাংকূটের শ্মশানের বাউন্ডারি ওয়াল দিতে গিয়ে আমাদেরই রোপিত কয়েকটি গাছ সরাতে হয়েছিল , মাটিও কাটতে হয়েছিল । ইহা ১৯১০ এর ঘটনা । সেগুলোর ছবি শিশুসদন কমিটির লোকেরা তুলে যে রেখেছে তা আমি জানতাম না । আজ তারা সুযোগ মতো সেগুলো দিয়েই অভিযোগ টি করলো।
রাংকূটের এই বৈরী পরিবেশে রাংকূট বৌদ্ধ তীর্থটি রক্ষার জন্যে রামুর ভদন্ত করুণাশ্রী থেরো , শীলমিত্র থেরো, উখিয়ার ভদন্ত কুশলায়ন থেরো সহ রাজার কুল ,শ্রীকুল,হাজারী কুল , উখিয়া ও কক্সবাজার টাউনের অধিকাংশ বৌদ্ধ নরনারীরা রাংকূটে অসহায় দায়কগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন । বিশেষ করে কক্সবাজার শহরের উপাসক ইন্দ্রনাথ বড়ুয়া, এডভোকেট রাখাল বড়ুয়া, এডভোকেট সুনীল বড়ুয়া, উপাসক রবীন্দ্র লাল বড়ুয়া ,উপাসক নিরন্জন বড়ুয়াদের অকৃত্রিম সহায়তা সেদিনের সংগ্রামে রাংকূট আর আমাকে চির ঋণী করেছে। রাংকূটের দায়কগণ জীবন বাজি রেখে ফৌজদারি মামলা মোকদ্দমা , হাজতবাস পর্যন্ত অগ্রহ্য করে সর্বাবস্থায় একজোট থেকেছে বলেই শত অত্যাচার যন্ত্রণা ও কষ্টের মাঝে আমরা রাংকূট রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি ।
রাংকূটের আবিষ্কারক ভদন্ত জগৎ চন্দ্র মহাস্থবিরের নাম থেকে “ জগত” এবং এই পুরাকীর্তি রক্ষায় দেহের রক্ত ঝরানো আমার গুরুদেব ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতির নাম থেকে “ জ্যোতি “ শব্দ দুটি যুক্ত করেই প্রতিষ্ঠান টির নাম দিয়েছিলাম জগৎজ্যোতি শিশুসদন । রাকূটের গরীব মা বাবার সন্তানদের শিক্ষার আলো দানই ছিল প্রতিষ্ঠান টি রাকূটের ভূমিতে করার প্রধান উদ্দেশ্য । কিন্তু , ১৯৯৬ তে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহার ত্যাগ করে আমি রাঙামাটি বনবিহারে পূজ্য বনভান্তের সান্নিধ্যে চলে যাওয়ার সুযোগে এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় এমন কিছু হীন প্রবৃত্তির লোক ঢুকে যায়; তারা খৃস্টান মিশনারীর অঢেল অর্থে পাগল হয়ে এই শিশুসদন সহ রাংকূট তীর্থ ও তার গরীব সন্তানদের বহিষ্কার করে দিয়ে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার জন্যে বহুবিধ পদক্ষেপ নেয় । এমতাবস্থায় আমরার গুরুভ্রাতা ভদন্ত চন্দ্রজ্যোতি ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রয়াত হলে রাংকূটের দায়কগণ জোর করে আমাকে রাংকূটে নিয়ে আসেন । আমি রাংকূটের দায়িত্ব নেওয়ায় তাদের সমস্ত হিসাব ওলটপালট হয়ে যায়। তাই তারা মরিয়া হয়ে রাংকূট হতে আমার অপসারণ চেয়ে ছিল।
ভাগ্যিস ২০১২ তে রামু উখিয়া এলাকার ১২ টি বিহার সাম্প্রদায়িক উসকানিতে ধ্বংসের সুবাদে বাংলদেশের প্রেসিডেন্ট এরশাদ আমলের প্রধানমন্ত্রী ব্যরিষ্টার মওদুদ আহমেদ সস্ত্রীক রাংকূটে আগমন করেন । আলাপ সুত্রে জানতে পারলাম তিনি ব্যরিস্টার মওদুদ । আর তৎপত্নী আমার প্রিয় পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের সৌভাগ্যবতী কন্যা । তিনি একজন গবেষক ও অধ্যাপিকা । আলমিরায় আমার লিখিত বইগুলো দেখে তিনি পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন শুধু নহে ঢাকায় গেলে বাসায় বেড়াতে যাবার আমন্ত্রণও জানালেন । অধ্যাপিকার উদারপ্রাণতায় আস্থাশীল হয়ে আমি রাংকূটের চলমান ভূমি সমস্যার সমাধান উপায় জানতে চাইলাম । তিনি স্বামীকে কিছু উপায় করে দেয়ার জন্যে জোর দিয়ে বললেন। আমার মুখে এই প্রতিষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট জিয়া কর্তৃক বিদ্যুতায়ন , ও মন্দিরে উঠার সিঁড়ি করে দেয়ার কথা জেনে তিনি পরদিন বেগম খালেদা জিয়ার কাছে নিজেই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে রাংকূটের ভূমি সমস্যার কথা জানালেন । বেগম জিয়া আমাকে বললেন ; আপনি আমাদের দেয়া করেন যেন দল ক্ষমতায় যেতে পারে । আমাদের দল যদি ক্ষমতায় যায় আমি আপনাকে কথা দিলাম রাংকূটের সব সমস্যার সামাধান করবো; যেহেতু মরহুম জিয়ার স্মৃতি ধন্য এই প্রতিষ্ঠান । জানিনা রাংকূটের সেই সৌভাগ্য আসে কবে।
কিন্তু ; ইতিমধ্যে খালেদা জিয়ার সাথে আমার এই সাক্ষাৎ কাল হয়ে রাংকূট হতে বিদায়ের ঘন্টা বাজিয়ে দিল । আমার গড়া প্রতিষ্ঠান যাদের জীবন জীবিকা সেই জগত জ্যোতি শিশুসদনের লোকেরা কক্সবাজারের আওয়ামী পন্থী জেলা প্রশাসককে দিয়ে তিনটি মামলার নোটিশ জারি করলো।
আমি প্রথমে ব্যরিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া ও ব্যরিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া উভয়ের শরণাপন্ন হলাম । তাঁরা উভয়ে আমাকে হতাশ করলেন । অগত্যা ব্যরিস্টার মওদুদ সাহেবকে ফোন করলাম । তিনি সবকিছু শুনে বললেন ; আপনি প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট গুলো নিয়ে আসুন । কক্সবাজারের ডিসির কাছে যারা রাংকূটের ভূমি লিজ পাওয়ার আবেদন করেছে ; তার ফটোকপি আর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডাইরেক্টরের পরিদর্শন রিপোর্ট কপি সহ জমির সমস্ত খতিয়ান গুলো অবশ্যই আনবেন । মওদুদ সাহেবের কাছে গেলাম । তিনি নিজের বিশাল চেম্বারের আরো তিনজন ব্যরিস্টার সহ গোলবৈঠক করে একজনকে কক্সবাজার ডি সি র বিরুদ্ধে সহসা মামলা তৈরীর দায়িত্ব দিলেন । খুব কম সময়ের মধ্যেই মামলার শুনানি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে শুরু হলো । আর ব্যরিস্টার মওদুদ নিজেই মামলা পরিচালনা করে বাংলাদেশের সুপ্রাচীন বৌদ্ধ তীর্থ রাংকূটের সরকারি খাস জমি যা ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের মহাপরিচালক কর্তৃক বৌদ্ধ পুরাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে; সে সকল ভূমি কোন সরকার কর্তৃক যেন কোন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর না করা হয়; এই মর্মে স্টে অর্ডার জারি করানো হলো ।
এভাবেই প্রাণে বেঁচে গেল রাংকূট বৌদ্ধ তীর্থ ।
কিন্তু; নানা ভাবে আমার জীবনের উপর হুমকি শুরু হলো। পরিস্থিতি বুঝে আমি রামু এলাকার কিছু ভিক্ষুকে রাংকূটের দায়িত্ব নিতে বললে ; তারা স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েক জন ভিক্ষুর ভয়ে সম্মত হলেন না । তাই আমার অতি বিশ্বস্ত জন যাকে জানতাম সেই কুশলায়ন থেরোকে সম্মত করালাম রাংকূট রক্ষার দায়িত্ব নিতে । রাংকূটের দায়কদেরও বুঝালাম এই ভিক্ষু দায়িত্ব নিলে আমি যেভাবে রাংকূটের গরীব অসহায়দের পাশে থেকেছি তিনিও থাকবেন। আমার শিষ্য দীপানন্দ ভিক্ষু ও রূপা শিক্ষিকা যেভাবে রাংকূটের স্কুল শিক্ষার্থীদের শিক্ষার আলো দান করছেন ; ভদন্ত কুশলায়নও তা রক্ষা করবেন । অধিকন্তু আমি উত্তরকুল্যা বলে যেই বিষাক্ত দুর্গন্ধ এখানের কিছু ভিক্ষু গ্রামে গ্রামে ছড়াচ্ছেন ; কুশলায়নের বিরুদ্ধে তা করতে পারবেন না । এভাবে রাংকূটের দায়কদেরকে সম্মত করায়ে কুশলায়ন থেরো সহ তাদের সাথে বৈঠক করলাম । ১৯৬৬ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আমার গুরুদেব ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথেরো ও তৎ শিষ্য পরম্পরা সুরক্ষিত রাংকূট বনাশ্রম বৌদ্ধ তীর্থের দায়িত্ব পরম বিশ্বাসে এভাবেই হস্তান্তর করলাম ভদন্ত কুশলায়ন থেরোর হাতে ।(চলবে )

Post a Comment

0 Comments

Ad Code

Responsive Advertisement