আদর্শ সুদক্ষ শিক্ষক ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতির বুদ্ধ সাসন ভাবনা(৮ম পর্ব)
************************
জানিনা তিনি কি মগ বৈদ্যের বলা রাংকূটের গুপ্তধনের প্রত্যাশায় ; নাকি অন্যকোন পুণ্য সৌভাগ্য নেশায় শত কৃচ্ছতার মাঝেও কক্সবাজারের রাংকূটকে জীবন বাজি রেখে বুকে ধারণ করে ছিলেন। পূজ্য গুরুদেবের বহুল উচ্চারিত স্বপ্ন রাংকূট হবে বুদ্ধের ধর্ম বিনয় শিক্ষার বিশাল শিক্ষাকেন্দ্র । এটা থেকে শিক্ষা করে ভারত বাংলায় বুদ্ধ সাসনের পুণঃ প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করবে শিক্ষার্থীরা; এই স্বপ্নে তিনি মশগুল ছিলেন । সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাঁর প্রচেষ্টা এক মুখী ছিল না। বহুমাত্রিক উপায় ভাবনা তাঁর বিভিন্ন পদক্ষেপে দেখা গেছে ।
ইতিপূর্বে শুধুমাত্র কক্সবাজারের সীমিত এলাকায় পরিচিত ছিল রাংকূট সুপ্রাচীন তীর্থটি । ইহাকে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে তুলে ধরার জন্যে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী সহ ঢাকার জাতীয় দৈনিক খবর , ইত্তেফাক, সপ্তাহিক বিচিত্রা ইত্যাদি সংবাদ মাধ্যমের আশ্রয় নিয়েছিলেন । ইহার প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব নিয়ে বাংলাদেশে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ডাইরেক্টর সহ রাজশাহী,ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের খ্যাতনাম শিক্ষক গবেষকগণের মনোযোগ আকর্ষণে একটি পরিদর্শন মন্তব্য বই সংরক্ষণ করতেন।
এক সময় জাপানী এক বৌদ্ধ ভিক্ষু রাংকূট পরিদর্শনে আসেন । নাম রেভারেন্ড কোহিমা । তিনি শান্তিতে নোবেল জয়ী বিশ্বখ্যাত জাপানী ভিক্ষু নিসীদাস্তু ফূজীর শিষ্য । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোসীমা, ও নাগাসাকিতে আমেরিকার নিক্ষিপ্ত বিশ্বের প্রথম আনবিক বোমা বিস্ফোরণের ধ্বংস যজ্ঞের প্রতিবাদে তিনি সারা বিশ্বে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ভারতের রাজগীর,ভূবনেশ্বরের মতো বিশ্বের ৫০টি দেশে বহু শান্তিস্তুপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । শ্রীলংকার সুমন পর্বতের পাদদেশে বুদ্ধ পদচিহ্ন দর্শনে পর্বত আরোহনের সিঁড়ির সন্নিকটে তাঁর গড়া সামচেতিয়া তারই একটি । এই বিশাল চৈত্যটি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে ছিলেন কোহিমা নামের এই মহা ভিক্ষু। সেই ভিক্ষু গুরু দেবকে আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন । মূলতঃ তাঁরই আমন্ত্রণে ১৯৮০ খৃস্টাব্দে গুরুদেব কে ভিক্ষু কোহিমা শান্তি প্যাগোডাটির ভিত্তি দান অনুষ্ঠানে এবং ১৯৮১,তে প্যাগোডার দ্বারোদ্ঘাটন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেছিলেন । গুরুদেব আমাকে সেই দ্বারোদ্ঘঠন অনুষ্ঠানে কয়েক দিনের জন্যে সাথে নিয়ে গিয়ে চার বছর কাল অধ্যয়নে রেখে এসেছিলেন ।এমন দূরদর্শী প্রগতিশীল মনের ভিক্ষু তৎকালীন ভারত বাংলায় আমার চোখে পড়েনি ।
তিনি রাংকূটকে বাংলার বৌদ্ধদের মাঝে পরিচিত করার জন্যে চুরাশী হাজার ধর্মস্কন্ধ পূজা নামক এক বিশেষ আয়োজন করা শুরু করলেন বৈশাখী পূর্ণিমায়। উখিয়া থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত তার প্রচারণা চললো। ক্রমে বিরাটাকার ধারণ করলো সেই পূজা । সম্রাট অশোকের জীবনীতেই পেয়েছি তিনি বুদ্ধের চুরাশী হাজার ধর্ম বাণীকে প্রতিকী পূজার জন্যে তিনি সমগ্র সম্রাজ্যে চুরাশী হাজার চৈত্য নির্মাণ করেছিলেন । কিন্তু আমার গুরুদেব খাদ্য আর ফুল প্রদীপ ও আঁতর সুগন্ধী দিয়ে চুরাশী প্লেটে যেভাবে পূজা করতেন ; তেমনটি শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড,মায়ানমার কোথাও আমার চোখে পড়েনি । মনে হয় ইহা আমার গুরুদেবের স্ব আবিষ্কৃত পদ্ধতি।
এমনিতে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা বন্দনার পর তিনি আলমিরায় রাখা ত্রিপিটক গুলো খুবই ভক্তি তদগত চিত্তে বন্দনা করতেন । ইহা গুরুদেবের জীবন ব্যাপী অনুশীলন ব্রতগুলোর মধ্যে একটি ছিল । অতঃপর বন্দনা করতেন বোধি বৃক্ষকে । তারপর বন্দনা করতেন ভদন্তের দীক্ষা গুরু শিক্ষা গুরুগণের ছবি গুলোকে ।
গুরুদেব ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথেরোর শিক্ষা ও ও শিষ্যগঠণ পদ্ধতিও ছিল অনুকরণীয় একটি আদর্শ।
শিষ্যদের কে তিন প্রব্রজ্যা দেয়ার পরদিন থেকেই প্রথমে শিক্ষা ও অনুশীলনের দায়িত্ব দিতেন বিনয়াচার্য উপ-সংঘরাজ জীনবংশ মহাস্থবির সংকলিত “প্রব্রজ্যিতের ব্রতরাশী “ নামক গ্রন্থটি।ব্রত মানে দায়িত্ব কর্তব্য। গৃহী জীবন ত্যগ করে প্রব্রজ্যা জীবন গ্রহণকারী ভিক্ষু শ্রামণদের দৈনন্দিন জীবনের দায়িত্ব কর্তব্যের বিধি বিধান কি কি এই সম্পর্কিত অতীব গুরুত্বপূর্ণ অত্যাবশ্যকীয় গ্রন্থ এটি ।
“ বিনয়স্স নাম সাসনস্স আয়ু “ — বিনয় বুদ্ধের ধর্ম রাজ্যের গঠণতন্ত্র । এই গঠণতন্ত্র সেই ধর্মরাজ্যের প্রাণ । এই বুদ্ধ বাক্যটি চলমান লেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী , পদ পদবী আর খেতাব উন্মাদ ভিক্ষুগণের বোধগম্য করাতে আমাদের মহাদর্শী সন্তান বিনয়াচার্য ভদন্ত জীনবংশ মহাথেরো গ্রন্থ টি প্রণয়ন করেছেন। তিনি বঙ্গীয় ভিক্ষুদের দ্বারা বুদ্ধের ধর্ম রাজ্য সঠিক বুদ্ধপথে সুরক্ষিত রাখতে ২৫০০ বুদ্ধ বর্ষ স্মরণে বিনয়ের মহাবর্গ খন্ড হতে ব্রতস্কন্ধের আলোকে এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি রচনা করেছেন।
ইদানীং শ্রামণ গুরুরা মনে হয় অনেকে জানেনও না এই গ্রন্থটির নাম ধাম।
আমাদের পরম গুরু ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথেরো শিষ্যদেরকে তার সাথে শিক্ষা দিতেন “ কায়বিজ্ঞান “ নামক দেহতাত্ত্বিক ধ্যান ভবনার গ্রন্থটি। কারণ রক্ত মাংস জাত কাম সম্ভোগ চেতনা তো কেবল কষায় গৈরিক বস্ত্র ধারণ করামাত্র ত্যাগ করা সম্ভব না। এমনকি ভিক্ষু শ্রামণেরা একান্ত নিবেদিত হয়ে চেষ্টা না করলে সারা জীবনেও এই কামচেতনা বিসর্জন অসম্ভব। এমতাবস্থায় কায়বিজ্ঞান মানে দেহের প্রকৃত স্বাভাবকে শৈল্যবিদ্যা তথা সার্জিক্যাল ডাক্তারী জ্ঞানের সাথে অ্নিত্য দুঃখ ও আমিত্ব হীনতার জ্ঞানে দেখার অভ্যাস গঠন দ্বারা আত্মরক্ষার গ্রান্টী দান করতে সক্ষম এই গ্রন্থ টি ।
তাই খাঁটি প্রব্রজ্যাজীবন গঠণে সুদক্ষ আমাদের মহাচার্য ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথেরো আমাদেরকে এই দুই বইয়ের প্রায় সবগুলোর মুখস্থ পড়া আদায় করতে দিতেন। আর সেগুলোর অনুশীলন অভ্যাস গঠণে খুবই কঠোর ছিলেন তিন। একদিন আমি কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলাম একাকী। তিনি সে দৃশ্য দেখামাত্র আমার কাছে গিয়ে বললেন ; শ্রামণ এভাবে দাঁড়ানো অনার্যতার পরিচায়ক। আমরা যেই কষায় বসন পরিধান করেছি তা তো আর্য অরহতগণে । সেই আর্যদের কুলেই আগমন করেছি। তাই আমাদের পক্ষে গৃহীদের মতো আচরণ মোটেই শোভনীয় নহে ।
আরো একবার কাঁধে গামছা রেখে শৌচাগারে যাচ্ছি। গুরুদেব দেখামাত্র বললেন ; এভাবে তো গৃহীরাও রাখে । তাহলে তাদের সাথে আমরা ব্রম্মচারীদের তফাৎ কি? দশধর্ম সুত্রে কি এটা মনে রাখতে বলা হয়নি?
এভাবেই গুরুদেব সেখিয়াদির আলোকে প্রব্রজ্যা জীবনের চাল চলনগুলো শিক্ষাদিতেন । কায়বিজ্ঞানের গাথাগুলোর অর্থ বুঝিয়ে দিয়ে ধ্যান অনুশীলনের নির্দেশনা দিতেন।
মাঝে মাঝে মনের কামবিতর্ক বেপরোয়া হয়ে উঠতো। গুরুদেবের শিক্ষানুযায়ী গুরুকে অকপটে তা প্রকাশ করতাম । আর অদম্য মনকে দমাতে গুরুদেবকে অনুরোধ করতাম পিটুনীর মতো শাস্তি দেওয়ার জন্যে।
সত্যি সত্যি তিনি তা করতে গিয়ে একবার আমার ডান কানে ভয়ানক বেত্রাঘাত হয়। তাতে চোট লেগে কানটি বেজায় ফুলে গিয়েছিল। গুরুর শিক্ষায় তখন এমন অনুগত ভাব ধারণ করেছিলাম আমরা নতুন শ্রামণ দুই জনেই।
তিনি আমাদের বিজ্ঞান মনস্ক অনুসন্ধিৎসু মনের খোরাক দানে বীরেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দী প্রণীত অভিধম্মার্থ সংগ্রহ, পন্ডিত ধর্মাধার অনুদিত মিলিন্দ পঞ্হ, সমন পুন্নানন্দ ও আরেক জন অনুবাদকের যৌথ অনুবাদিত বিশুদ্ধি মার্গ , বেণীমাধব বড়ুয়া,পন্ডিত ধর্মাধার ও রাজগুরু ধর্মরত্ন মহাস্থবির অনুদিত মধ্যম নিকায় ও দীর্ঘ নিকায় , মহাপন্ডিত প্রজ্ঞালোক ও অনোমদর্শী ভিক্ষু অনুদিত ধম্মপদ , ভদন্ত ধর্ম তিলক অনুদিত কায়বিজ্ঞান ও তেলকটাহ গাথা, এবং তরুণ কবি ও অনুবাদক ভদন্ত জ্যোতিপাল ভিক্ষু (বাগোয়ান) অনুদিত উদানং এবং ধর্মভান্ডগারিক ভদন্ত বুদ্ধ রক্ষিত মহাথেরো অনুদিত সতিপট্ঠান সুত্ত সহ আরো বেশ কয়েকটি পিটকীয় গ্রন্হ রুটিন মাফিক অধ্যয়ন, অধিত বিষয় নিয়ে আলোচনা, গাথা সুত্রাদি মুখস্ত পাঠ দান চলতো মধ্যাহ্ন ভোজের পর দুপুর একটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।
তারপর থাকতো গাথা সুত্র আবৃত্তি করে করে বিহারের ভেতরে বাইরে পরিচ্ছন্নতা, ব্যবহার্য জল দূরে রাংকূট পাহাড়ের নীচের পুকুর থেকে বহন করে পাহাড় চুড়ায় চৌবাচ্চা ভর্তী করা এবং পাহাড়ী ছোট্ট একটি কুয়া থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করা। এসবের পর মুখ হাত ধুঁয়ে সান্ধ্য বন্দনা ও ধ্যান অনুশীলন । তারপর কোন কোন সময় রং চাঁ বা ফলের জুস পান করে শয্যায় ঘুম না আসা পর্যন্ত নিষ্প্রদীপ মৈত্রী ভাবনা ও কায়গতানুস্মৃতি ভাবনা ।
শুধু তা ই নহে ; সে সময়ে রাংকূটের নির্জন ধ্যান মৌন পরিবেশে সতিপট্ঠান সুত্র থেকে শুরু করে পুরো কায়বিজ্ঞান ও ধম্মপদ গ্রন্থের গাঁথা সহ হস্তসার, সদ্ধর্মরত্নাকর গ্রন্থের সুত্রাদির অর্থ সহ অনায়াসে মুখস্থ যা করেছি ; পরবর্তীকালে তা আর সম্ভব হয়নি। তাই আজো ভাবি ; হা ! প্রব্রজ্যা জীবনের সেই সোনালী দিনগুলো কেমন মহার্ঘ্য ছিল আমার সারা জীবনের জন্যে।
বাস্তবিক স্থায়ী নতুন প্রব্রজ্যিতগণের উচিত এজীবনের শুরু থেকেই কয়েক বছর (বুদ্ধের মতে সুদক্ষের জন্যে পাঁচ বছর) গভীর শ্রদ্ধা চিত্তে এক নাগাড়ে ধর্ম বিনয় আর ধ্যান ভাবনায় নিবেদিত থাকাতে আরণ্যিক নির্জন জীবন একান্ত অপরিহার্য। এমন নির্জন বাসের শক্তি পরবর্তী সারাজীবন প্রব্রজ্যা জীবনের প্রতিকুল সমস্ত বাধা অতিক্রম করা সম্ভব হয় অবলীলায়। এই অভিজ্ঞান থেকেই পরবর্তী কালে আমি গুরুদেবের মহামুনি পাহাড়তলীর অরণ্য বিদর্শন ধ্যানকেন্দ্র রক্ষায় এবং বেতবুনিয়ার শীলছড়ির অভয়ারণ্য ধ্যানকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় মনযোগী হয়েছি। অপরদিকে সামাজিক সম্পর্ক রক্ষায় রাউজান কদলপুরের ভিক্ষুট্রেনিং সেন্টার , নাগরিক জীবন ও জাতীয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষায় চট্টগ্রাম আগ্রাবাদে শাক্যমুনি বুদ্ধ বিহার, ঢাকা নারায়ণগঞ্জে ডক্টর শাসনরক্ষিত কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ বিহার রক্ষায় মনযোগী হয়েছি ।
কোন ভিক্ষু যদি কোন প্রব্রজ্যার্থীর শিষ্য হতে ইচ্ছুক হন ; সেই গুরুর উচিত আমাদের গুরুদেবের মতোই শিষ্যদের প্রতি ধর্মানুকুল দায়িত্ব শীল হওয়া। আমাদের গুরুদেব তেমন বুদ্ধ সাসন দরদী শিক্ষক ছিলেন বলেই আমি ১৯৮১ এ আমার প্রথম বারের এম এ পাশের পর তিনি একান্ত নিজের পরিকল্পিত সিদ্ধান্তে আমার শত অনিচ্ছা সত্বেও শ্রীলংকায় বর্ণবোধ শিখতে বাধ্য করতে পেরেছিলেন। রাংকূটে গুরুর প্রতি শিষ্যের এমন আনুগত্য শীলতার গুণ এমনই হয়ে ছিল ।
সেই সময়ে তিনি একাজটি না করলে জীবনে কোনোদিন আমার দ্বারা পালি ভাষা শিক্ষা যে হতো না ; তা নিশ্চিত । আর সেই পালি শিক্ষা না করলে বাংলায় ত্রিপিটক অনুবাদে আমাদের মহাপুরুষদের শত বছরের প্রচেষ্টার সমাপ্তির স্বপ্ন পূরণ হতে আরো কতো যুগ যে চলে যেতো ; তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গুরুদেব এক সুদূর প্রসারী ভাবনায় শ্রীলংকার বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ শ্রী বজিরাঞানা ভিক্ষুট্রেনিং সেন্টারে আমাকে ভর্তি করানোর পর তিনি সেই ১৯৮১ সালের প্রায় ছয়টি মাস আমাকে নিয়ে ঘুরে ছিলেন শ্রীলংকা ও ভারতের সকল পুণ্য তীর্থ সমূহ। আর নিয়ে গেছেন সারা ভারতে ছড়িয়ে থাকা জাতি জ্ঞাতি বিচ্ছিন্ন বড়ুয়াদের সন্ধানে। উদ্দেশ্য ছিল ভারত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সন্চয়। গুরুদেব প্রায় সময় ভাবতেন ভারত যেন পূর্বের সেই বুদ্ধ ভারতে পুণঃ প্রতিষ্ঠা পায়। আর সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে তিনি মহারাষ্ট্রের বাবা সাহেব ভীমরাও আম্বেদকর অনুসারীগণের সাথে এবং বুদ্ধগয়া ও থাইল্যান্ডে অবস্থান করেছিলেন বেশ কিছুদিন। এসবের দ্বারা জানতে চেয়েছিলেন নিজের করণীয় কি হবে।
তিনি আমাকে নিয়ে ভারত পরিক্রমার পথে আসাম ও ত্রিপুরা থেকে শ্রামণ প্রব্রজ্যা দিয়ে ছিলেন বেশ কিছু তরুনকে । উত্তর ত্রিপুরার কাঞ্চন নগরে জ্ঞাতি কন্যার পরিবার প্রধান হাটহাজারী মির্জাপুর গ্রামের সন্তান সুধন্য চৌধুরীদের পারিবারিক শ্মশানের তিন কানি জমিও গুরুদেব দানপত্র মূলে গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে আমি সহকর্মী দিকপাল ভিক্ষু (বর্তমানে ভারতীয় সংঘরাজ)কে দিয়ে সেই জমিতে এক ধ্যানকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করিয়েছি।
গুরুদেব বার বার বলেছেন আমি সমগ্র ত্রিপিটক আত্মস্থ করেই যেন দেশে প্রত্যাবর্তন করি। বাস্তবে তা হলো না ; নানা কারণে । প্রধান কারণ ছিল বর্তমান সংঘরাজ পূজ্য ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরো। ভদন্তের প্রতি আমার অন্ধ আনুগত্য আমাকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল তা দেখুন—
আমি ১৯৭২ এ রাংকূট ত্যাগ করে জন্মস্থান জোবরা সুগত বিহারে শ্রামণ জীবনে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমি জোবরা আসার পর পরই ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরোও এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে দিঘী নালা বোয়ালখালী দশবল রাজবিহার হতে কদলপুর সুধর্মানন্দ বিহার ও দীক্ষাগুরুর প্রতিষ্ঠান জোবরা সুগত বিহারের দায়িত্ব গ্রহণে চলে আসেন । সে এক বিরাট কাহিনী ।
অপরদিকে আমি রাঙ্গামাটি লংগদুর তিনটিলায় অবস্থানরত পূজ্য বনভান্তের সান্নিধ্যে থাকার অনুমতি চাইতে গেলে ; অন্যের শিষ্য বিধায় তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন না । তারই কারণে আমি অবস্থান নিয়েছিলাম জোবরা সুগত বিহারে । সুগত বিহারের তখন পরিচালনায় ছিলেন জ্ঞানশ্রী ভান্তের চতুর্থ চাকমা শিষ্য বর্তমান মীরপুর শাক্যমুনি বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো। আমার গৃহীজীবনে তিনি ছিলেন নাজির হাট কলেজে আমার ইন্টার মিডিয়েট ক্লাসের সহপাঠী। পরে আমি চট্টগ্রাম পলিটেকনিক কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে চলে যাই। রাংকূট হতে যখন আমি জোবরা সুগত বিহারে আসি তখন মা ও ভাইয়েরা বুঝতে পারলেন আমি চীবর ত্যাগ করবো না । তাই তাঁরা ধরে বসলেন ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দের মতো অন্ততঃ সাধারণ শিক্ষাটা অক্ষুন্ন রাখি । তাঁদের সন্তুষ্টির জন্যে অগত্যা হাটহাজারী কলেজে পড়াশুনা শুরু করি । শ্রদ্ধেয় জ্ঞানশ্রী ভান্তে প্রায় সময় জোবরা সুগত বিহারের কাজ কর্ম তদারকি ও বিহার সংলগ্ন নিজের ক্রয় করা জমিতে গুরু গুণালংকার মহাস্থবিরের স্মৃতিতে গুণালংকার অনাথাশ্রম প্রতিষ্ঠার কাজে আসতেন । ফলে শ্রদ্ধেয় জ্ঞানশ্রী ভান্তের সাথে সাক্ষাৎ আলাপের প্রেক্ষিতে উভয়ে এমন অন্তরঙ্গ হয়ে গেলাম যে ; আমি তাঁহার দেহের ছায়ার মতো থাকলাম সেই ১৯৭২ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত ।
১৯৭৩ এ কদলপুর পরিবাস ব্রতে ভিক্ষুত্ব গ্রহণের পর যখন গহিরা শান্তিময় বিহারের দায়িত্ব গ্রহণ করি ; তখন থেকে তিনি কদলপুর সুধর্মানন্দ বিহারে তিন দিন থাকলে চার দিন রেখে দিতাম আমার সাথে । সন্ধ্যায় বন্দনার পর রাত ১০ টা পর্যন্ত গ্রামের বয়ষ্ক লোকদের সাথে বিহারের বারান্দায় নিত্যদিনের সঙ্গ দিয়ে বিশ্রামের জন্যে কক্ষে প্রবেশ করে শ্রদ্ধেয় ভান্তেকে আমার শয্যায় শুয়ে দিয়ে; আমি শুয়ে পড়তাম ফ্লোরে । রাত ৩টায় ঘুম ভেঙ্গে যেত অভ্যাস বশে। পূজ্য জ্ঞানশ্রী ভন্তেরও তাই । সেই থেকে ভোরের বন্দনা পাঁচটা পর্যন্ত চলতো সারাদিন মহামন্ডলের কোন গ্রামে কি সমস্যা ; সেই সমস্যার সমাধানে সম্ভাব্য কি কি করা যায়; দুর্বল বিহার গুলোর উন্নয়নে মুষ্টি চাল সংগ্রহ প্রথা চালু উদ্যোগ নেয়া ; ভিক্ষুদের কে সংঘবদ্ধ করে বিপদ কালে সহায়তা দিতে সংঘ ফান্ড শক্তিশালী করণ — ইত্যাদি হরেক রকম ভাবনা পরিকল্পনার কথা তিনি কেবল বলতেই থাকেতেন । অপরদিকে আমি বেচারার যে বাংলা সাহিত্যের মতো ভারী এক বিষয় নিয়ে বিশ্ব বিদ্যালয়ে অনার্স কোর্স এর লেখাপড়া আছে ; সে বিষয়ে উনার কোন ভাবনা কোনদিন দেখিনি । ভোরে উঠে পরিকল্পনা করবেন ; আর দিনে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষে ও ক্লাস বন্ধের সময়ে এই কাজ গুলো বাস্তবায়নে গ্রাম গ্রামান্তর দৌঁড়ঝাপ করতাম ; তা কখনো উনাকে নিয়ে; আবার কখনো একা । আমি কিন্তু তাতে কখনো বিরক্তি বোধ করতাম না । কারণ; ভাবতাম কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আমার জন্যে মুখ্য নহে ; ধর্ম ও সামাজ কল্যাণই একজন ভিক্ষুর জন্যে প্রধান। বিশেষ করে আমি শ্রদ্ধেয় জ্ঞানশ্রী ভান্তের নিবেদিত ত্যাগময় জীবনের প্রতি কেমন অনুগত , কেমন গুণমুগ্ধ ছিলাম ; তা এই একটি উদাহরণ থেকেই অনুমান করতে পারবেন —
যিনি আমাকে ১৯৭১ এ গুরুদেব ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথেরোর দায়িত্বে নিজের হাতে তুলে দিয়েছিলেন আমার সেই জন্মদাতা পিতা , তৎ অপর দুই কন্যা ও দুই পুত্রের সবাইকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার পর থেকে আমি বহুবার চেষ্টা করি পিতাকে প্রব্রজ্যা জীবনে নিয়ে আসতে। অবশেষে ১৯৭৯ খৃস্টব্দে প্রব্রজ্যা দানে সক্ষম হলাম।
১৯৮৯ তে তিনি সফল ভিক্ষুজীবনের দশম বর্ষায় কদলপুরস্থ বাংলাদেশ ভিক্ষুট্রেনিং সেন্টারে হঠাৎ করে কালগত হলেন এক সকালে । আমার খুব ইচ্ছা ছিল দুই তিন দিন হলেও পিতা ভিক্ষুর মরদেহ শবাধারে রাখার ব্যবস্থা করে চারপাশের ভিক্ষু সংঘ ও জ্ঞাতীস্বজন সবাইকে নিয়ে শেষকৃত্য সামাধা করি । কিন্তু শ্রদ্ধেয় জ্ঞানশ্রী ভান্তের ইচ্ছা কে প্রধান্য দিয়ে সকালে প্রয়াত পিতা ভিক্ষুকে সন্ধ্যায় শ্মশানে তুলে দিলাম বিনা বিতর্কে । শুধু আমার মা ব্যতীত আর কোন ভাই বোন পিতাকে শেষ বিদায় দিতে আসতে পারলেন না । এমন করুণ ছিল সেদিনের দৃশ্য।
আমার উপাধ্যায় গুরু শিক্ষা গুরুকে গৌণ করে কর্ম গুরু ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরোকে আমার এমন আত্ম সমর্পণ দ্বারাই ১৯৭৬ এ জন্ম নিল মহামন্ডল ধর্মীয় শিক্ষা পরিষদ সেই কুমিল্লা থেকে সমগ্র উত্তর চট্টগ্রাম অন্চলে । সংঘরাজ ভিক্ষু মহামন্ডলের এই বিস্তীর্ণ এলাকার প্রতিটি বিহারে জন্ম নিল শান্তি শৃঙ্খলা । কোথাও বিহার নিয়ে কোন সমস্যার জন্ম হলে তা সমাধান কালবিলম্ব হতো না কোন সময়ে । সেই কারণে মহান্ডল এলাকায় আজ পর্যন্ত তেমন বড় কোন সমস্যার জন্ম হয়নি। আমি আর ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরোর প্রতিটি কর্ম পরিকল্পনায় ভিক্ষু মহামন্ডলের ভিক্ষুগণের ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা । তাই আমাদের হাতে জন্ম নিয়েছে ধর্ম ও সমাজ কল্যাণে একে একে অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন । আমি একপ্রকার ডুব দিয়েছিলাম এসব কর্মকাণ্ডে । সেই ডুবন্ত অবস্থা থেকে তুলে নিতেই গুরুদেব ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথেরো ১৯৮১ তে আমাকে এক মাস বেড়ানোর নাম করে শ্রীলংকায় চার বছর কাটিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন । (চলবে)
0 Comments