Hot Posts

6/recent/ticker-posts

Ad Code

বুদ্ধগয়া মহাবোধি মহাবিহার মুক্তি আন্দোলনে অনাগারিক ধম্মপালের সহযোগীগণ ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু

 


আমরা অবগত হয়েছি যে, বৃটিশ পুরাতত্ববিদ লর্ড আলেক্সজান্ডার কানিংহাম (১৮১৪-১৮৯৩) ও তাঁর দল মাটির নীচ হতে মহাবোধি মহাবিহারকে জনসমক্ষে তুলে আনেন। এরপর তা ব্রাহ্মণমুক্ত করে বৌদ্ধদের হাতে সমর্পণের জন্য প্রথমে লেখালেখি শুরু করে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন বৃটেনের প্রখ্যাত গবেষক ও কবি ‘The Light of Asia’ নামক বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থের লেখক স্যার এডউইন আরনল্ড (১৮৩২-১৯০৪)। তাঁরই লেখা পড়ে অনাগারিক ধম্মপাল (১৮৬৪-১৯৩৩) শ্রীলঙ্কা হতে বুদ্ধগয়া এসেছিলেন ১৮৯১ সালে। ব্রাহ্মণ মহন্ত এবং তাঁর অনুগামীরা অনাগারিক ধম্মপাল এবং তাঁর সহযোগী তীর্থযাত্রীদের উপর তখন অমানবিক হামলা চালিয়েছিল। শ্রীলঙ্কা গিয়ে অনাগারিক ধম্মপাল সে বছরই বুদ্ধগয়া মহাবোধি মহাবিহার মুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্যে মহাবোধি সোসাইটির স্থাপনা করেছিলেন।
১৮৯৩ সালে অনাগারিক ধম্মপাল আমেরিকার শিকাগোতে অনিষ্ঠিত বিশ্ব ধম্ম সংসদে বৌদ্ধ প্রতিনিধিরূপে বক্তব্য প্রদান করে বিশেষভাবে বুদ্ধগয়া মহাবোধি মহাবিবারের দুর্দশার কথা তুলে ধরে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সে ধম্ম সংসদে ভারত থেকে স্বামী বিবেকানন্দজীও (১৮৬৩-১৯০২) যোগদান করেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অনিমন্ত্রিত। এজন্য কর্তৃপক্ষ তাঁকে বক্তব্য দানের সুযোগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। অবশেষে অনাগারিক ধম্মপালের সহযোগিতা এবং প্রচেষ্টায় তিনি বক্তব্য দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এজন্য স্বামী বিবেকানন্দ অনাগারিক ধম্মপালের প্রতি আমৃত্যু কৃতজ্ঞ ছিলেন।
অনাগারিক ধম্মপাল যখন বুদ্ধগয়া মহাবোধি মহাবিহারকে ব্রাহ্মণ মুক্ত করার জন্য সংঘর্ষ করছিলেন তখন ভারতের কিছু খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ এবং ইংরেজী মিডিয়া তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ (১৮৮৪-১৯৬৪), শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী (১৯০১-১৯৫৩), হিন্দু মহাসভা, ইংরেজী মিডিয়া, জজ এবং বেঙ্গলের কতিপয় প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ ছিলেন অন্যতম। তাঁরা অনাগারিক ধম্মপালকে সমর্থন দিয়ে বলেছিল যে, বুদ্ধগয়া মহাবোধি মহাবিহার বৌদ্ধদের হাতে সমর্পণ করা উচিত।
উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গের মতো আরো অনেক লোক এবং দু’জন বিচারপতির মধ্যে একজন বিচারপতি সমর্থন করায় কোর্টে অনাগারিক ধম্মপালের জয় হয়েছিল এবং মহাবিহার বৌদ্ধদের দেওয়ার কথা হয়েছিল। কিন্তু পরে অন্য বিচারপতি মহন্তের কাছ হতে বিরাট অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণ করে কোর্টের রায় উল্টিয়ে দিয়েছিলেন।
বর্তমান সময়েও বুদ্ধ এবং তাঁর ধম্মের প্রতি শ্রদ্ধা সম্পন্ন জনসাধারণ এবং বুদ্ধ কর্তৃক অনুসন্ধান কৃত বিদর্শন ধ্যান-ভাবনা অনুশীলনকারী অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকেরাও মত প্রকাশ করছেন যে, তথাগত বুদ্ধের সম্বোধি লাভের স্থান মহাবোধি মহাবিহারকে বৌদ্ধদের দখলে দেওয়া উচিত, যাতে সেখানে সবকিছু বৌদ্ধ রীতি-রেওয়াজ অনুসারে পূজা, বন্দনা ও ধ্যান-ভাবনা হতে পারে এবং মহাবিহারেরও সার্বিক বিকাশ হতে পারে।
মহাবোধি মহাবিহারের মুক্তি এবং ভারত তথা পৃথিবীব্যাপী ধম্ম প্রচারের জন্য পূজ্য অনাগারিক ধম্মপালজী মহাবোধি সোসাইটির স্থাপনা করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (RSS) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী মহাবোধি সোসাইটির ছয় বছর পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
অনাগারিক ধম্মপালকে বোধিসত্ব বলা হয়। তিনি যে কার্য সমূহ করেছেন সেগুলি বোধিসত্ব ব্যতীত সাধারণ লোকের পক্ষে করা সম্ভব নয়। বুদ্ধগয়া মহাবোধি মহাবিহারের মুক্তির জন্য মামলা-মোকদমদমা, বুদ্ধগয়া তথা ভারতের অন্যান্য স্থানে এবং বিশ্বের নানা জায়গায় অনাগারিক ধম্মপাল যেভাবে সদ্ধম্মের প্রচার-প্রসার এবং বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছিলেন তার মূলে যিনি অর্থ যুগিয়েছিলেন তিনি হলেন একজন আমেরিকান বিদূষী নারী। তাঁর নাম ছিল মেরী এলিজাবেথ ফস্টার (১৮৪৪-১৯৩০)। তিনি বুদ্ধ ধম্মের প্রচারে অনাগারিক ধম্মপালকে অকাতরে অর্থদান করেছেন। অত্যন্ত শ্রদ্ধাবতী এ উপাসিকা ছিলেন ধম্মপালজীর পোষণকারী মাতা সদৃশ। তাঁকে আধুনিক যুগের বিশাখা বললেও অত্যুক্তি হয়না। তিনি ভারত এবং পৃথিবী ব্যাপী বুদ্ধ ধম্মের পুনরুত্থানে অর্থদান দিয়ে অনন্য অবদান রেখেছেন।
মেরী ফস্টার আমেরিকার হাওয়াই রাজ্যের হনলুলু শহরের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি ছিলেন রাজপরিবারের কন্যা। তাঁর স্বামী ছিলেন আমেরিকার প্রসিদ্ধ ব্যাংক ব্যবসায়ী এবং অন্যতম ধনী।
ধম্মপালজী ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগোতে অনুষ্ঠিত ধম্ম সভায় সদ্ধম্মের পতাকা উড্ডীন করার জন্য গিয়েছিলেন। ফিরে আসার সময় তিনি সমুদ্র মার্গে শ্রীলঙ্কা আসছিলেন। সংযোগ বশত: একই স্টীমারে ছিলেন মেরী এলিজাবেথ ফস্টারও। সেখানে তাঁদের সাক্ষাত হয়েছিল। মেরী ফস্টার নিজের চরিত্রে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের জন্য অনাগারিক ধম্মপাল হতে পরামর্শ চেয়েছিলেন। ধম্মপালজী তাঁকে বুদ্ধ শিক্ষার আলোকে ধ্যান করার পরামর্শ দিয়ে কিছু পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছিলেন।
তাতে মেরী ফস্টারের জীবনের গতি পরিবর্তন হয়েছিল। তিনি ধ্যান করে উপকৃত হওয়ায় বুদ্ধের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। এরপর তিনি বুদ্ধ ব্যতীত অন্যদিকে আর কোথাও তাকিয়ে দেখেননি।
অনাগারিক ধম্মপাল মহাবোধি সোসাইটি স্থাপনার পর তখন কলকাতায় মহাবিহার মুক্তি আন্দোলন চালাতে গিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করছিলেন। মেরী ফস্টারের সাথে অনাগারিক ধম্মপালের পত্র যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। তিনি তাঁকে ফস্টার মাদার বা পালক মাতা বলে সম্বোধন করতেন। তাঁদের এ সম্পর্ক ছিল খুবই মধুর।
অনাগারিক ধম্মপাল কোলকাতা, বুদ্ধগয়া, সারনাথ, লন্ডন এবং অন্যান্য আরো অনেক দেশে ধম্মের প্রচার-প্রসার এবং প্রতিষ্ঠান গড়ার দিকে সবিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন। মেরী ফস্টার তাঁকে কার্যের গতি প্রদানের জন্য প্রচুর অর্থ যোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৩০ সালের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি অনাগারিক ধম্মপালকে তাঁর পৈতৃক ধন-সম্পদও ধম্মদানের প্রতিদান স্বরূপ বিলিয়ে দিয়েছিলেন।
তাঁরই দানের দ্বারা অনাগারিক ধম্মপাল কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটির বিশাল বিহার, বুদ্ধগয়ায় ধম্মশালা, গেষ্ট হাউজ, বিহার, সারনাথে মূলগন্ধকুঠি বিহার, যাদুঘর, স্কুল, কলেজ, ধম্মশালা, হাসপাতাল, লন্ডনে বুদ্ধ বিহার প্রভৃতি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি ধম্ম প্রচারের জন্য কয়েকটি সাময়িকী প্রকাশের কাজও করেছিলেন।
আমেরিকার হাওয়াই রাজ্যের মত অতীব সুন্দর ও বিকশিত হনলুলু শহরে সেখানকার প্রথম বৌদ্ধ মেরী এলিজাবেথ ফস্টারের স্মরণে এক বিশাল গার্ডেন নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানের মধ্যে রয়েছে সদ্ধম্মের মহান উপাসিকা ও পৃষ্টপোষক মেরী ফস্টারের সমাধি। যদি তাঁর অকাতর অর্থদান না থাকত তাহলে অনাগারিক ধম্মপালের পক্ষে বুদ্ধগয়া মুক্তি আন্দোলন এবং সদ্ধম্মের পুনরুত্থানের কাজ করা অনেক কঠিন হয়ে যেত। সদ্ধম্মের কল্যাণে এ বিদূষী নারীর অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।

Post a Comment

0 Comments

Ad Code

Responsive Advertisement