মনের খাবার
আচান লি ধর্মাধারো
--------------------------------------------------------
আমি বিভিন্ন জায়গায় যেতে পছন্দ করি, এটা শুধু শুধু আনন্দ করার জন্য নয়।
যাই এজন্য যে আমি কিছু শিখতে চাই। কিছু শিখতে তিনটি জিনিষের ওপর নির্ভর
করতে হয়: দেখা, শুনা এবং চিন্তা করা, অর্থাৎ আপনার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে ব্যবহার করা
, যাতে করে যে উদ্দেশ্যে ভ্রমণ তাকে সফল করা। অনেক সময় আপনি যাদের দেখা
পাবেন, খুঁজে পাবেন তাদের বিশ্বাস আর অনুশীলন আপনার চেয়ে অনেক কম।
আপনার সামনে একটা সুযোগ আসবে ভালো কিছু করার, আপনি তাদেরকে সঠিকপথে
চলার শিক্ষাগুলো দেখিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু যখন আপনি আপনার চোখ দিয়ে
দেখবেন, শুনবেন নিজের কান দিয়ে আর মন দিয়ে বিশ্বাস করছেন যে এটি আসলেই
খুব ভালো, চিন্তা করবেন না যে এটি আপনার বা অন্যের। মনে রাখুন এবং নিজের
জীবনে সেই ভালো বিষয়টা অনুশীলন করুন।
কারণ আমার মনটা তৈরি হয়েছে শাসন সদ্ধর্ম্মের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হতে, সেজন্য সবসময়
চেষ্ঠায় থাকি ভালো কিছু করতে। ভাবি না আমি কত উঁচু অবস্থানে আর নিচুতে আছি, সবসময়
চিন্তা করি আমার সৎ উদ্দেশ্যেকে। প্রশ্ন করতে পারেন- এটা কি রকমের – কীভাবে অগ্রসর
মানুষের উপকার করেন এবং যারা অগ্রসর নয় তাদের কিভাবে? এটা নির্ভর করে অবস্থার ওপর।
ধর্ম কারো বাড়ি বা বিহার, এই শহর বা এই জাতির একান্ত কোন সম্পত্তি নয়। ধর্ম হলো
এমন কিছু যা সব জায়গায় সবার জন্য উপকার বয়ে আনে। ধর্মের অধিকারি হলো বিশ্ব। যতই
আমরা একে ছড়িয়ে দিতে পারবো, ততোই মঙ্গল বয়ে আনবে।
যদিও সেই চিন্তাধারায় আমার ধর্মজীবন অনুশীলিত, তারপরও সমালোচিত হচ্ছি। সম্ভবত
এজন্য যে, যারা আমাকে সমালোচনা করছেন তারা আমাকে বুঝতে পারছেন না। খুব বেশি দিন
হয়নি-গত এপ্রিলের ২০ তারিখ, একজন সম্ভ্রান্ত উপাসকের সঙ্গে কথা বলছিলাম। আমার মনে
কোন চিন্তা ছিল না উনার মনে আঘাত দেবো। সংক্ষেপে বলি, আমার প্রতি উনার সমালোচনা ছিল,
“আপনি অযথা প্রচুর সময় ব্যয় করেন মানুষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে, আর আপনি কিভাবে
নিজেকে মুক্ত করতে ধর্ম অনুশীলন করেন?”
উনাকে খোলা মনে উত্তর দিলাম। প্রথমে জানতে চাইলাম ঠিকভাবে বুঝতে, “আপনি কি চান?”
তিনি বললেন, “মানুষকে নির্বানে পৌঁছতে শিক্ষা দিন। মানুষের সঙ্গে বেশি সংশ্লিষ্ঠ
হবেন না।“ বললাম, “আমিও পছন্দ করি মানুষকে নির্বানে পৌঁছার শিক্ষা দিতে, কিন্তু
এটা খুব কঠিন। আপনাকে বলছি, সত্যি আমি পছন্দ করি, কিন্তু আপনি যা বলছেন, তা যদি
করি, আমি উম্মাদ হয়ে যাবো। ধরুন, আপনি ধান রোপন করলেন। যখন এটি সোনালি আকার ধারণ
করলো আর পেকে গেলো, আপনি কি শুধু সেই ফসলের সাদা চালের দানা পাবেন? অন্য কিছু
পাবেন না? আমি সবকিছু নিই। মানুষ হয়তো আমাকে পাগল বলে, বলুন তো, আমি কেন এর ধার
ধারবো? আমি সম্পূর্ণ ধান গাছটি নিই কারণ, এর সবকিছু ব্যবহারযোগ্য। খড়গুলো আপনি
মহিষকে খাওয়াতে পারবেন বা বিক্রি করতে পারেন, বা আগুন ধরানোর কাজে ব্যবহার করতে
পারেন। চালের খোসা আপনি খাওয়াতে পারেন প্রাণীদের।“
তিনি বললেন,”আপনি তো সব জানেন। আসলেই ঠিক বলেছেন।“ আর এভাবেই শেষ হলো বিষয়টা। আমি
অন্যান্য ভিক্ষুদের চেয়ে আলাদা, কেননা আমি শুধু একটা খাবারের স্বাদ খেতে চাই না,
অর্থাৎ শারীরিক খাবার (কাবলিংকা আহার) যা আমরা প্রত্যেকদিন খাই। আমি পছন্দ করি সেই
রকম খাবার যা প্রতি কামড়ে তিন ধরনের স্বাদ পাই। এটাই আসল খাবার, এটা শরীরের খাবার
নয়, এটা হলো মনের খাবার। তিন ধরনের স্বাদের খাবার হলো স্পর্শ আহার, বিজ্ঞান আহার ও
মনোসঞ্চেতনা আহার। আপনি যদি একে ডুরিয়ান ফলের সঙ্গে তুলনা করেন, এটি হবে মিষ্টি আর
পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং খুবি অল্প তেতো, যা একসঙ্গেই আছে-সেই ধরনের ডুরিয়ান ফল আসলেই
মানুষরা খেতে পছন্দ করে।
এখানে স্পর্শ আহারের পুষ্টির অর্থ হলো পছন্দনীয় দৃশ্য: শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, কায়িক
স্পর্শ, এবং চিন্তা/ধারণা। বিজ্ঞান আহারের পুষ্টি হলো চোখ, কান, নাক, জিহবা, কায় ও
মনের দ্বারা পছন্দনীয় বিষয়কে জানা। মনোসঞ্চেতনা আহার হলো ভালো কর্মে সফলতা যেটার
জন্য কর্ম প্রচেষ্ঠা। তিনটিকে একসঙ্গে নেয়া হলো ‘ধম্ম আহার।‘ এক কামড়ে তিনটি
স্বাদ। যিনিই এ ধরনের খাবার খাবেন নিয়মিতভাবে, তিনি পাবেন দীর্ঘায়ু, সুখী ও
সুস্বাস্থ্যবান জীবন।
এই ধরনের খাবারই আমি চাই। সাধারণভাবে বললে, আমি ভীষণভাবে সন্তুষ্ট হই যখন
দেখি-আমার অধীনের ভিক্ষুরা, শ্রমনরা এবং উপাসক-উপাসিকারা ঠিকমতো ধর্ম অনুশীলন
করছে। এটা ভাত খাবার নয়, এটি হলো মানুষের খাবার। যদি কেউ আমাকে কোন কিছু করে খুশী
ও সন্তুষ্ট করতে চায়, তবে ধর্ম অনুশীলন করেই দেখাতে হবে, এতে আমি দীর্ঘায়ু পাবো।
যদি কেউ খারাপ ব্যবহার করে, তাতেই আমি দ্রুত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবো। কারণ
পৃথিবীতে আমার জন্ম শাসন সদ্ধর্ম্মের জন্য। আমি সেই ধরনের জীবন খুঁজছি, যা থেকে
মঙ্গল ও কল্যাণের ধারা প্রবাহিত হবে। আমি যে ধান রোপন করি, তা যদি প্রচুর ফসল দেয়,
দানাগুলো মোটা ও ভালো লাভ দেয়, তাহলেই আমার সুখ-শান্তি আসবে। আর রোপিত ধান থেকে
চাল কম পাই, তাহলে তো শুধুই ক্ষতি এবং জীবন চলবে নানা সংকটে।
তাইতো খাবার আর দীর্ঘ শ্বাস-প্রশ্বাস নিই যদি দেখি যে,
একটা কল্যাণময় উদ্দেশ্যে সাধনের সু-ইচ্ছায় বেঁচে থাকা হচ্ছে। আর যদি দেখি যে,
কোথাও থাকাটার মধ্যে মঙ্গল-কল্যাণজনক উদ্দেশ্যে নেই, তাহলে আমার চেষ্ঠা হয় হ্রস্ব
শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার, যতক্ষণ আমি দ্রুত সরে না যাই, সেটাতেই স্বস্তি পাই। যেই
ধরনের সুখ সমন্বয় করে না, কোন প্রয়োজন নেই বসে থেকে নিজের শরীরকে অত্যাচার দেয়ার,
কারো কোন সমস্যার কথা শোনার। উজ্জ্বল আলোকময় হওয়া, তা আমার ওপরই নির্ভর। কোন
দুঃশ্চিন্তা যা যেকোন বিষয়, মোটেও সংশ্লিষ্ট হবার প্রয়োজন নেই।
শরীরের জন্য যে খাবার খাই তা আমাকে খেতে হবে বলেই খাই। এই নয় যে আমি সত্যি চাই
এটি। আসলে এতে সত্যিকার সার নেই। আজ আপনি খাবেন আর আগামীকাল অধিকাংশ চলে গেল। যে
খাবার মনের জন্য, সেটি আপনি একদিন খেলেন, আপনার সঙ্গে থাকবে ১০ বছর, ১০০ বছর ধরে।
আপনি কখনো দুর্বলতা অনুভব করবেন না। থাকবেন আপনি ফুরফুরে ভরা মনে। যতদিন না আপনি
ভুলে যাবেন না ততদিন পর্যন্ত, যতদিন এটিকে আপনার ক্ষুধার্তের মত মনে হবে না ……!
মনের খাবার যতই ধর্মময়
হবে, অফুরন্ত পুণ্যময় শান্তিসুখে ভরে উঠবে জীবন।
টীকা: বুদ্ধের মতে, আহার চার প্রকার: ১। কাবলিংক আহার ২। স্পর্শ আহার ৩। বিজ্ঞান আহার ৪। মনোসঞ্চেতনা আহার
আচান লি ধর্মাধারো: থাইল্যণ্ডের একজন ধ্যানসাধক ভান্তে। মহান ধূতাঙ্গসাধক আচান মান ভান্তের সংস্পর্শে এসে ধূতাঙ্গব্রত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ব্যংককের সংলগ্ন স্থানে ওয়াট অশোকারাম বিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন।
ভাষান্তর: রতন জ্যোতি ভিক্ষু, বর্ষাবাস, নর্থ হলিউদ, ক্যলিফোর্নিয়া। ২০২০।
0 Comments