বুদ্ধের শিক্ষার মূল আলোচ্য বিষয়
নিপুন বড়ুয়া
শুধুমাত্র একটি শব্দ দিয়ে যদি বুদ্ধের শিক্ষার বিষয় প্রকাশ করতে হয় তাহলে সেই শব্দটি হল “ধম্ম” (ধর্ম নয় কিন্তু)। এই ধম্ম শব্দের বিশ্লেষণ ব্যাপক হতে পারে। এ প্রেক্ষিতে What the Buddha Thought বইতে Walpula Rahula ভান্তে বলেন, ‘ধম্ম’ শব্দ হতে ব্যাপক কোন শব্দ বৌদ্ধ পরিভাষায় নেই। এই ধম্ম শব্দের মাঝেই বুদ্ধের শিক্ষার প্রতিটি বিষয় লুকায়িত। সংক্ষেপে সমস্ত উপাদান সমন্বিত বা উপাদান বিযুক্ত (আকাশ ও নির্বাণ উপাদান বিযুক্ত) বিষয় আছে তৎসমুদয়ই ধম্মান্তর্গত। আবার, এই ধম্ম হল বিদর্শন ধ্যান তথা অন্তর্দর্শনের দর্শনের নির্দেশিকা, যদ্দারা ব্যক্তি জগত ও জীবনের সম্যকতা, যথাযথতা (মনো-দৈহিক সত্যতা) উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়ে সকল সৎ-অসতের, কুশল বা অকুশলের মূলোচ্ছেদ করেন, সহজ কথা তৃষ্ণা বা সর্বদুঃখের ক্ষয় সাধন করেন, নির্বাণ উপলব্ধি করেন।
বুদ্ধের এই ‘ধম্ম’ উপদেশ করার কারণ হল- আত্মা নামীয় যে কোন কিছুই নেই, সমস্ত কিছু যে বিভিন্ন অণু-পরমাণুর মিথষ্ক্রিয়া তা দেখানো এবং যা কিছু উৎপন্ন হয় বা জন্ম হয় সেগুলোর যে বিনাশ বিদ্যমান তা উপলব্ধি করানো; সর্বোপরি অন্তর্দর্শনের দ্বারা তাবৎ দুঃখের কারণ প্রদর্শন করে দুঃখকে সমূলে বিনাশ করা।
উপরোক্ত বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করতে গিয়ে বুদ্ধ মূলতঃ যেগুলো আলোচনা করেছেন, যে বিষয়গুলোর উপদেশ দিয়েছেন সেগুলো হল--
১. চারি আর্যসত্য: দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখের বিনাশ আছে এবং দুঃখ বিনাশের পথও আছে।
২. প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি: প্রতিটি বস্তু বা ব্যাপার পরস্পর নির্ভরশীল, একটির সংযোগে যে অন্যটি উৎপন্ন হয়, স্বতন্ত্র বিষয় যে কিছুই নেই তা।
৩. পঞ্চস্কন্ধ: ১.সংজ্ঞা, অর্থাৎ, কোন বিষয়ে সাধারণভাবে জানা; ২.সংস্কার, অর্থাৎ, সাধারণভাবে জ্ঞাত বিষয়কে মনের দ্বারা প্রদানিত রূপ; ৩.বেদনা যা জ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে অনুভূতি, এবং ৪. বিজ্ঞান, যা জ্ঞাত বা অনুভূত বিষয়কে বিশ্লেষণের দ্বারা বিষয়গুলো সুখ না দুঃখ, নাকি সুখও নয় দুঃখও নয় এটি সচেতনতার সাথে অবগত হওয়া। এবং ৪. রূপ- ভৌতিক চারি উপাদানকে রূপ বলা হয় (মাটি, পানি, তাপ ও বায়ু)। মূলতঃ এই পঞ্চস্কন্ধের সমন্বয়ই জীব। শুধু রূপ চারটি থাকলে তা জড়।
৪. দ্বাদশ আয়তন: চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক ও মন এবং এই ছয়টির সহগামী বিষয় দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ ও মনের বিষয়াবলী।
৫. আঠারো ধাতু: উক্ত দ্বাদশ আয়তন এবং সেগুলোর সম্পর্কিত বিজ্ঞান বা সচেতনতা (চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক ও মনের গ্রাহ্যভাব)।
৬. কর্ম বা কম্ম: বুদ্ধের পরিভাষায় যে সমস্ত কাজ সচেতনতার(চিত্ত সহযোগে) সাথে সম্পাদন করা হয় তাই কর্ম বলে।
৭. ত্রিলক্ষণ: প্রতিটি উৎপন্ন বস্তু বা বিষয়ই আত্ম বা আমিত্বহীন, দুঃখময়(চির বা পরম সুখহীন) ও অনিত্য(স্থায়ী নয়, ক্ষয়িষ্ণু)।
৮. শীল: কায়-মনো-বাক্যের দ্বারা নিজের ও অপরের জন্য কল্যাণময় কাজ করা।
৯. সমাধি: সহজ ভাষায় মনের একাগ্রভাব, অন্তর্দর্শন।
১০. প্রজ্ঞা: বিষয়কে যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা।
১১. বিমুক্তি: বিশেষ মুক্তি, নির্বাণ। লাভ-অলাভ, যশ-অযশ, সুখ-দুঃখ ও নিন্দা-প্রশংসা এই অষ্টবিধ পরিস্থিতিতে মন যখন বিচলিত হয় না সেই অবস্থা।
১২. চারি ঋদ্ধিপাদ: মনের উৎকর্ষ সাধন করে অসাধারণ কিছু করতে পারার ভিত্তি। (ছন্দ-সৎ কাজ করার সুদৃঢ় ইচ্ছা, বীর্য- উপযুক্ত প্রয়াস, উদ্যম; চিত্ত, বীমংস-সুক্ষ্ম প্রজ্ঞার ক্ষমতা)। এই চারটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে মানুষ ‘অলৌকিক’ কিছু করতে পারে। মূলত:বুদ্ধের শিক্ষায় অলৌকিক বলে কিছু নেই, মানুষের চিত্তকে শুদ্ধ করে উক্ত চারটি ঋদ্ধিপাদের দ্বারা মানুষ অতি অসাধারণ শক্তির অধিকারী হতে পারে।
১৩. সম্যক প্রধান: অতীতে করা অসৎ কাজ পুনর্বার না করা, আগামীতে কোনও অসৎ কাজ না করা, অতীতে করা ভাল কাজ বারবার করা এবং যে ভাল বা সৎ কাজ এখনো করা হয়নি তা করতে সচেষ্ট বা উদ্যমী হওয়া ও তা করা।
১৪. পঞ্চইন্দ্রিয়: শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধি ও প্রজ্ঞা (এ স্তরে কুশল অকুশল সমান থাকে, কুশল-অকুশলের একটি অন্যটিকে ছাপিয়ে যাবার প্রতিযোগিতা চলে)।
১৫. পঞ্চবল: শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধি ও প্রজ্ঞা(এ স্তরে কুশল অকুশলকে ছাপিয়ে গিয়ে মন সত্যকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে এগিয়ে চলে)।
১৬. সপ্ত বোধ্যঙ্গ: স্মৃতি, ধম্মবিচয় (ধম্ম’কে বিচার বিশ্লেষণ করা, যদ্বারা মনের নেতিবাচকতাকে বিলোপ করা যায়), বীর্য, প্রীতি, প্রশ্রদ্ধি (মনের শান্ত অবস্থা), সমাধি ও উপেক্ষা।
১৭. চারি স্মৃতি প্রস্থান: কায়ের দ্বারা যা কিছু সংগঠিত হচ্ছে, যা কিছু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভূত হচ্ছে, মনের দ্বারা যা কিছু ভাবিত হচ্ছে এবং ধম্ম-এর প্রতিটি বিষয়কে যথাযথ মনোযোগের সহিত জানা।
0 Comments