একপাশে বসে মিগারমাতা বিশাখা ভগবানকে বললেন, ‘ভন্তে, আমি ভগবানের কাছে আটটি বর যাচ্ঞা করতে চাই।’ ‘বিশাখে, তথাগত বরদানের অতীত হয়েছে।’ ‘ভন্তে, যা বিহিত ও অনবদ্য আমি সেই বরই যাচ্ঞা করব।’ ‘বিশাখে, তা হলে বলতে পারো।’
‘ভন্তে, ১. আমি ভিক্ষুসংঘকে আজীবন স্নানবস্ত্র (বর্ষার সময়ে পরিধেয় বস্ত্র) দিতে চাই, ২. আগন্তুক ভিক্ষুকে আহার্য দান, ৩. গমনকারী ভিক্ষুকে আহার্য দান, ৪. রুগ্ন ভিক্ষুকে আহার্য দান, ৫. রোগী-পরিচারক ভিক্ষুকে আহার্য দান, ৬. রোগী ভিক্ষুকে ওষুধ দান, ৭. ভিক্ষুসংঘকে নিত্য জাউ দান এবং ৮. ভিক্ষুণীসংঘকে স্নানবস্ত্র দান করতে চাই।’ ‘বিশাখে, তুমি কোন সুখদফল দেখে তথাগতের কাছে আটটি বর যাচ্ঞা করছ?’
১. ভন্তে, আমি দাসীকে আদেশ করেছিলাম, ওহে, বিহারে গিয়ে সময় জানাও, ভোজনের সময় হয়েছে, আহার্য প্রস্তুত। সেই দাসী বিহারে গিয়ে দেখতে পেল, ভিক্ষুগণ চীবর খুলে রেখে দেহে বারিবর্ষণ করাচ্ছেন। তা দেখে ‘বিহারে ভিক্ষু নেই, আজীবকগণ দেহে বারিবর্ষণ করাচ্ছেন’ এই ভেবে আমার কাছে গিয়ে বলল, ‘আর্যে, বিহারে ভিক্ষু নেই, আজীবকগণ দেহে বারিবর্ষণ করাচ্ছেন।’ ভন্তে, নগ্নতা বড়ো অপবিত্র, বড়ো জুগুপ্সিত এবং অতি ঘৃণিত। আমি এই কারণটা দেখে সংঘকে আজীবন বর্ষার স্নানবস্ত্র দিতে চাচ্ছি।
২. পুনরায়, ভন্তে, আগন্তুক ভিক্ষু রাস্তা এবং গ্রামের প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অভাবে ভিক্ষান্নসংগ্রহে কষ্ট পেয়ে থাকেন। তাঁরা আগন্তুকের উদ্দেশে আমার দেওয়া অন্ন আহার করে রাস্তা এবং গ্রামের পরিচয় লাভে সমর্থ হয়ে বিনা কষ্টে ভিক্ষান্নসংগ্রহ করতে পারবেন। ভন্তে, আমি এই কারণটা দেখে আজীবন ভিক্ষুসংঘকে আগন্তুকভোজন দিতে চাচ্ছি।
৩. পুনরায়, ভন্তে, গমনকারী ভিক্ষু নিজের আহার সন্ধান করতে করতে গাড়ি হতে বঞ্চিত হয়ে পড়েন অথবা যেখানে যেতে চান সেখানে উপস্থিত হতে বিকেল হয়ে যায়, ক্লান্ত হয়ে দীর্ঘপথ গমন করেন। তিনি যদি গমনকারীর উদ্দেশে আমার দেওয়া ভোজন আহার করেন তা হলে তাঁকে গাড়ি লাভে বঞ্চিত হতে হবে না, যেখানে যেতে চান সেখানে বিকেলে উপস্থিত হতে হবে না এবং বিনা কষ্টে দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে পারবেন। ভন্তে, আমি এই কারণটা দেখে ভিক্ষুসংঘকে আজীবন গমনকারীর ভোজন দিতে চাচ্ছি।
৪. পুনরায়, ভন্তে, রোগী ভিক্ষু অনুকূল ভোজন না পেলে তাঁর রোগ বাড়তে পারে অথবা মৃত্যুও হতে পারে। তিনি রোগীর উদ্দেশে আমার দেওয়া আহার্য আহার করলে তাঁর রোগটা বাড়বে না অথবা মৃত্যু হবে না। ভন্তে, আমি এই কারণটা দেখে আজীবন সংঘকে রোগীর ভোজন দিতে চাচ্ছি।
৫. পুনরায়, ভন্তে, রোগী-পরিচারক ভিক্ষু নিজের আহার্য সংগ্রহে ব্যস্ত থাকলে রোগীকে আহার্য প্রদানে দেরি করবে অথবা রোগীকে অনাহারেও রাখবে। তিনি যদি রোগী-পরিচারকের উদ্দেশে আমার দেওয়া অন্ন আহার করেন, তা হলে রোগীকে সকালে অন্ন দিতে পারবেন, রোগীকে উপবাসে রাখবেন না। ভন্তে, আমি এই কারণটা দেখে আজীবন সংঘকে রোগী-পরিচারকের ভোজন দিতে চাচ্ছি।
৬. পুনরায়, ভন্তে, রোগী ভিক্ষু অনুকূল ওষুধ না পেলে তাঁর রোগ বৃদ্ধি অথবা মৃত্যুও হতে পারে। তিনি যদি রোগীর উদ্দেশে আমার দেওয়া ওষুধ সেবন করেন, তা হলে তাঁর রোগটা বৃদ্ধি কিংবা মৃত্যু হবে না। ভন্তে, আমি এই কারণটা দেখে সংঘকে আজীবন রোগীর ওষুধ দিতে চাচ্ছি।
৭. পুনরায়, ভন্তে, ভগবান অন্ধকবিন্দে দশটি সুফল দেখে জাউয়ের বিধান দিয়েছেন। আমি সেসব সুফল দেখে আজীবন ভিক্ষুসংঘকে নিত্য জাউ দিতে চাচ্ছি।
৮. পুনরায়, ভন্তে, ভিক্ষুণীগণ অচিরবতী নদীতে বেশ্যার সঙ্গে এক ঘাটে নগ্ন হয়ে স্নান করে থাকেন। বেশ্যাগণ ভিক্ষুণীদের বলেন, ‘আর্যে, তোমরা যৌবনাবস্থায় কেন ব্রহ্মচর্য আচরণ করছ, কামসেবা করা কি উচিত নয়? যখন বৃদ্ধা হবে তখন ব্রহ্মচর্য পালন করতে পারবে। এভাবে তোমাদের উভয় কার্য সফল হবে।’ এভাবে বিদ্রুপ করে থাকে। তখন ভিক্ষুণীগণ বেশ্যাদের দ্বারা উপহসিত হয়ে নীরব থাকেন। ভন্তে, নারীজাতির নগ্নতা বড়ো অপবিত্র, বড়ো জুগুপ্সিত, অতি ঘৃণার্হ। আমি এই কারণটা দেখে আজীবন ভিক্ষুণীসংঘকে স্নানবস্ত্র দিতে চাচ্ছি।
‘বিশাখে, তুমি কী সুফল দেখে তথাগতের কাছে আটটি বর যাচ্ঞা করছ?’ ভন্তে, নানাদিকে বর্ষবাস শেষ করে ভিক্ষুগণ ভগবানকে দর্শন করার জন্য শ্রাবস্তীতে আসবেন। তাঁরা ভগবানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, “ভন্তে, অমুক ভিক্ষুর কালক্রিয়া হয়েছে, পরলোকে তাঁর কীরূপ গতি লাভ হলো?” তাঁর সম্বন্ধে ভগবান ব্যক্ত করবেন, “তিনি স্রোতাপত্তিফল, সকৃদাগামীফল, অনাগামীফল অথবা অর্হত্ত্বফল লাভ করেছিলেন।” তখন আমি তাঁদের (জিজ্ঞেসকারীদের) কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করব, “ভন্তে, সেই আর্য কি কোনো দিন শ্রাবস্তী এসেছিলেন?” যদি তাঁরা আমায় বলেন, “সেই ভিক্ষু শ্রাবস্তীতে এসেছিলেন।” তা হলে আমি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করতে পারব, সেই মৃত আর্যটা আমার দেওয়া বর্ষাকালের স্নানবস্ত্র, আগন্তুকভোজন, গমনকারীর ভোজন, রোগীর ভোজন, রোগীপরিচারকের ভোজন, রোগীর ওষুধ অথবা নিত্য দেওয়া জাউ গ্রহণ করেছেন। তা স্মরণ করলে আমার প্রমোদের সঞ্চার হবে, প্রমোদ হতে প্রীতির সঞ্চার হবে, প্রীতিসম্পন্ন হলে দেহ প্রশান্ত হবে, প্রশান্তকায়ে সুখানুভূতি হবে, সুখানুভূতিতে চিত্ত সমাধিপ্রাপ্ত হবে এবং তা-ই হবে আমার ইন্দ্রিয়ভাবনা, বলভাবনা, বোধ্যঙ্গভাবনা। ভন্তে, আমি এই সুফল দেখে তথাগতের কাছে আটটি বর যাচ্ঞা করছি।’
বিশাখে, সাধু সাধু, তুমি এই আটটি সুফল দেখে তথাগতের কাছে আটটি বর যাচ্ঞা করে উত্তম কাজ করেছ। বিশাখে, আমি তোমাকে উক্ত আটটি বর দিলাম।’
এরপর ভগবান মিগারমাতা বিশাখাকে এই গাথাযোগে অনুমোদন করলেন :
অন্ন-জল করে দান মনানন্দে শীলবতী সুগত-তনয়া,
করে দান স্বস্তিকর শোকনোদ সুখাবহ ছেড়ে অসূয়া,
সে-ই লভে দিব্যবল আর আয়ু ধরি পথ শুদ্ধ নিরঞ্জন,
চিরসুখী পুণ্যকামী নিরাময় স্বর্গলোকে আনন্দিত মন।
ভগবান মিগারমাতা বিশাখাকে এই গাথাযোগে অনুমোদন করে আসন হতে উঠে চলে গেলেন। ভগবান এ নিদানে, এ প্রকরণে ধর্মকথা উত্থাপন করে ভিক্ষুগণকে আহ্বান করলেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, আমি অনুজ্ঞা করছি, বর্ষাসময়ের স্নানবস্ত্র, আগন্তুকভোজন, গমনকারীর ভোজন, রোগীর ভোজন, রোগী-পরিচারকের ভোজন, রোগীর ওষুধ, নিত্য জাউ এবং ভিক্ষুণীসংঘের স্নানবস্ত্র।’—চীবর স্কন্ধ, মহাবর্গ
0 Comments