ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু
বুদ্ধ শব্দের অর্থ হল জাগ্রত মস্তিস্ক (Awakened One). জন্ম সূত্রে কেহ বুদ্ধ হননা। বুদ্ধ এক যোগ্যতা। যা নিজের অদম্য অবিরাম প্রচেষ্টায় অর্জন করতে হয়। কেহ যদি সে রকম প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন, তাহলে তিনি নিশ্চিত বুদ্ধ হতে সক্ষম হবেন। কারো পক্ষে নবী হওয়া, কিংবা ঈশ্বরের অবতার হওয়া বা ঈশ্বর পুত্র হওয়া সম্ভব নয়। কেননা ঈশ্বর যাঁকে যখন চাইবেন, তিনিই তখন কেবল নবী বা অবতার বা পুত্র বানাতে পারবেন। অন্যের পক্ষে কখনও সেরূপ হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু স্বীয় নিরন্তর প্রচেষ্টার দ্বারা যে কেহ বুদ্ধত্বে উপনীত হতে পারবেন। এতে কারো দয়া-দাক্ষিণ্যের প্রয়োজন নাই বা কারো ইচ্ছা বা হুকুমের প্রয়োজনও নাই।
বুদ্ধ হলেন জাগ্রত সত্তা এবং পরিপূর্ণ বিমুক্ত মহামানব। তিনি হলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। তিনি কোনো শক্তির মুখাপেক্ষী নন। কারো অধীনস্থও নন। তিনি যে ধম্ম শিক্ষা দিয়েছেন, তা হল জীবন-যাপনের এক অনুপম কলা, এক অনন্য মার্গ, যাকে বলা হয় বাস্তবিক সামাজিক বিজ্ঞান। বুদ্ধ হলেন পৃথিবীর প্রথম বৈজ্ঞানিক যিনি মানবতার জন্য নিষ্পাপ মধ্যম মার্গের অনুসন্ধান করেছেন, যে মার্গে আরোহন করে অগ্রসর হলে নিতান্ত দুঃখ মুক্তির অন্ত পর্যন্ত পৌঁছা সক্ষম হয়।
বুদ্ধ হলেন মহা সমুদ্রের মত অপার যেখানে সমস্ত ধর্ম সমাহিত হয়ে থাকে। বুদ্ধের দ্বারা প্রচারিত ধম্মই হল বিশ্বের প্রথম ধম্ম, যেখানে ধম্মের নামে কোনো অধম্ম নেই, ভণ্ডামি নেই, প্রতারণা নেই, মিথ্যা আশ্বাসন নেই, হত্যা নেই, যুদ্ধ নেই, হিংসা-বিদ্বেষ নেই। কাউকে ছোট এবং কাউকে বড় দৃষ্টিতে দেখার মানসিকতা নেই। সকল প্রাণীর প্রতি অপার প্রেম, মৈত্রী ও করুণা প্রদর্শনের শিক্ষা একমাত্র বুদ্ধই দিয়ে থাকেন। এজন্য বিশ্বে বুদ্ধের ধম্ম হল সবচেয়ে বড় এবং প্রথম মানব ধম্ম। যে শিক্ষায় জীবের প্রতি দয়া-ভালবাসা থাকেনা, মানুষের প্রতি মানুষের ভ্রাতৃত্বভাব জাগ্রত করেনা, তা কখনও মানবতার ধম্ম হতে পারেনা এবং সদ্ধম্ম হওয়া তো অনেক দূরের কথা।
বুদ্ধের শিক্ষায় কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই। জাতি, বর্ণ, গোত্রের ভিত্তিতে ভেদাভেদ নেই। মানুষ জন্মের দ্বারা সম্মানিত কিংবা ঘৃণিত হয়না। কর্মগুণেই মানুষ সমাদৃত ও তিরস্কৃত হয়। যিনি যত সদাচারী, শীলবান, প্রজ্ঞাবান, পরোপকারী, অসাম্প্রদায়িক, মৈত্রী ভাবাপন্ন, তিনি যেখানেই থাকুন না কেনো, যে গোত্রেই জন্ম গ্রহণ করুন না কেনো, তিনি সম্মানিত, শ্রদ্ধেয় ও পূজ্য হয়ে থাকেন। নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক নীতি-নৈতিকতাই হল সত্যিকার মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্র বা সম্প্রদায় মনুষ্যত্বের পরিচয় নয়।
বুদ্ধের শিক্ষায় মনুষ্য মাত্রই সমান। জন্মের কারণে উঁচু-নীচতার স্থান এখানে নাই। সকল মানুষের কেবল নয়, তথাগত বুদ্ধ সকল প্রাণীর জীবনকে সমান সম্মান ও শ্রদ্ধা করার শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কাউকে আঘাত করা, কাউকে বিদ্বেষ করা, কাউকে প্রতারণা করা বা বঞ্চনা করা বুদ্ধের শিক্ষায় নাই।
কারো ভাগ্যোন্নয়নের জন্য কিংবা ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য বুদ্ধ কোনো ঈশ্বর, দেবী-দেবতা বা কাল্পনিক অদৃশ্য শক্তির পূজা করতে বা স্তূতি পাঠ করতে শিক্ষা দেননা। কারো প্রতি বশ্যতা স্বীকার করলে নিজের কৃত পাপ বা অপরাধ হতে মুক্ত হওয়া যায়, এরূপ শিক্ষাও বুদ্ধ দেননা। যাগ-যজ্ঞ, বলি, পূজা পাঠ, স্তূতি, প্রার্থনা প্রভৃতিকে বুদ্ধ দাসত্ব বা কাপুরুষের লক্ষণ বলে বর্ণনা করেছেন। এগুলি মানুষকে স্বনির্ভরতা শিক্ষা দেয়না। সে রকম মনোবৃত্তি মানুষকে পর নির্ভর ও পর মুখাপেক্ষী করে তোলে। বুদ্ধ কখনও কাউকে ধম্মের নামে এ সমস্ত অন্ধবিশ্বাস, অন্ধভক্তি, ভণ্ডামি ও কপটতার শিক্ষা দেননি। তিনি কটু হলেও সত্যই প্রকাশ করেছেন।
কারো দাসত্ব স্বীকার না করে বা পর মুখাপেক্ষী না হয়ে স্বাধীন ও মুক্তভাবে জীবন-যাপন করার শিক্ষা দিয়েছেন তথাগত বুদ্ধ। সেজন্য তিনি আত্ম শক্তির উদ্বোধন করতে বলেছেন। নিজের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকা অনন্ত বোধিকে জাগ্রত করতে বলেছেন। নিজেকে আত্ম বিশ্বাসে এবং আত্ম শক্তিতে বলীয়ান হতে উপদেশ দিয়েছেন। বুদ্ধই বলেছেন-‘মনুষ্য জন্ম অতীব দুর্লভ।’ অর্থাৎ সবার উপরে মানুষ সত্য, তার উপরে নাই। মনুষ্য হয়ে কোনো অদৃশ্য শক্তির দাসত্ব স্বীকার হল কাপুরুষতার লক্ষণ। তা মানবতা ও মনুষ্যত্বের বিসর্জন ছাড়া আর কিছু নয়। তাই বুদ্ধ বলেছেন-‘তুমিই তোমার প্রভূ, তুমিই তোমার নাথ। অন্য কোথাও নাথ বা প্রভূ অনুসন্ধান করতে যেওনা।’
বুদ্ধ তাঁর শিক্ষায় স্পষ্ট ব্যক্ত করেছেন যে, জগতের সবকিছু হল নশ্বর, পরিবর্তনশীল ও ক্ষণভঙ্গুর। এখানে শাশ্বত, নিত্য ও অপরিবর্তনীয় বলে কিছু নেই। সময় ও স্থান বিশেষে সব কিছুই পরিবর্তন হয়ে থাকে। এরকম পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে জেনে এর অনুকুলে বুদ্ধ তথাগত জীবন-যাপনের শিক্ষা দিয়েছেন। যা হল একান্তই প্রকৃতি সঙ্গত। প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করার মানে ধম্ম লঙ্গনের সামিল।
বুদ্ধের শিক্ষায় কোনো লিঙ্গ বৈষম্য নাই। যোগ্যতানুসারে নারী-পুরুষ প্রত্যেকের সমানাধিকার এখানে নিশ্চিত করা হয়েছে। কেহ প্রভূ কেহ দাসী নয়। কেহ পবিত্র আবার কেহ অপবিত্রও নয়। যোগ্যতা অনুসারে সকলের সমান অধিকার ও সমান মর্যাদা রয়েছে। তথাগত বুদ্ধ তাঁর শিক্ষায় জীবের প্রতি অপার মৈত্রী, ভালবাসা এবং দয়া প্রদর্শনের গুরুত্ব দিয়েছেন। নিজের জীবনের সাথে তুলনা করে কোনো প্রাণীকে আঘাত বা হত্যা না করতে কিংবা একে অন্যকে বঞ্চনা অথবা প্রতারণা না করতে বুদ্ধের কঠোর শিক্ষা রয়েছে।
শিক্ষা এবং জ্ঞান অর্জনকে বুদ্ধের উপদেশে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মানুষকে শ্রেষ্ঠ আসনে অধিষ্ঠিত করে তাঁর শিক্ষা, সদাচার ও সদ্গুণাবলী। নীতি-নৈতিকতা ও মানবতা বিহীন শিক্ষাকে বুদ্ধ বর্ণ-গন্ধহীন পুষ্ফের সাথে তুলনা করেছেন। বুদ্ধ নিজেই সাম্য-মৈত্রীর মূর্ত প্রতীক এবং ধারক-বাহক। সেজন্য তাঁর বাণীর মধ্যে কোনোরূপ ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষের উপাদান নাই। বুদ্ধ শিক্ষায় যুদ্ধ-বিগ্রহের প্ররোচনাও নেই। বরং যুদ্ধ বন্ধ করে সাম্য-মৈত্রী ও বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠার শিক্ষায় বুদ্ধ জোর দিয়েছেন। কেননা হিংসাশ্রিত যুদ্ধ কখনও শান্তির পথ নয়। তা হল যুদ্ধের পথ বুদ্ধের নয়। বিশ্ব শান্তির জন্য জগতে অহিংসাশ্রিত বুদ্ধ মার্গ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প মার্গ নাই।
0 Comments