ভিয়েতনাম যুদ্ধের দিনগুলোতে…..!
•••••••••••••••••••••••••••••••
থিক নাথ হান
●●●●●●●●●●●
৪৬ বছর আগে!
নিউইয়র্কের ইত্থিকায় অবস্থিত কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে আমন্ত্রণ জানায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ংকর যুদ্ধে আক্রান্ত ভিয়েতনামের অবস্থার ওপর কয়েকটি বক্তব্য দিতে।
তখন ভিয়েতনামে যুদ্ধ মারাত্মক আকার ধারণ করে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি বয়ে আনছিল-চারিদিকে ধ্বংস আর ধ্বংস, অসংখ্য মৃত্যুর রক্তের বন্যা আর আহত মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের তীব্র আর্তনাদে ভরে উঠছিল!
আর অনেকেই আমরা চাচ্ছিলাম না যুদ্ধ চলতে থাকুক, কিন্তু আমাদের অধিকার ছিল না সেটা বলার। অধিকাংশ মানুষই চাইছিল না যুদ্ধ চলুক। ভিয়েতনামীরা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল বৈদিশিক মতবাদ আর বাইরের অস্ত্র দিয়ে। এক পক্ষে ছিল লেনিনবাদ/মার্কসবাদ আর অন্য পক্ষে পুঁজিবাদী, কমিউনিস্ট বিরোধী। আমরা বাইরে থেকে নিয়ে এসেছি মতবাদ এবং অস্ত্রও বাইরে থেকেই এসেছে। কমিউনিস্ট মতবাদীদের সোভিয়ত ইউনিয়ন ও চীন দ্বারা আর কমিউনিস্ট বিরোধীরা আমেরিকা ও তার সহযোগিদের দ্বারা। বুঝতেই পারছেন, আমরা ফাঁদে আটকে গেছি।
এর মধ্যই ভিয়েতনামে গোপনে শান্তি আন্দোলনে আয়োজন চলছিল। কারণ, যদি আপনি সরাসরি যুদ্ধ বন্ধের কথা বলেন, শান্তি সম্বন্ধে কথা বলেন,
আপনার জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যাবে! আমিও তখন কাজ করছিলাম তরুণদের নিয়ে, চেষ্ঠা করছিলাম সাহিত্যের মাধ্যমে শান্তির বাণী ছড়াতে।
আমি যুদ্ধ-বিরোধী অনেক কবিতা লিখি কিন্তু অনুমতি ছিল না সেগুলো প্রকাশ করার। তারপরও একদল তরুণ ছাত্ররা চেষ্ঠা করলো সেগুলো ছাপাতে। সেই কবিতার বইয়ের শিরোনাম ছিল “চলুন আমরা অন্জলী করে প্রার্থনা করি আর তাই শান্তির শ্বেত কবুতর ডানা মেলে উড়বে আমাদের দেশে।“ বইটি খুব বিক্রি হয় যদিও গোপনে। ঝুঁকি হলো যদি আপনার কাছে একটি কপি পায়, আপনাকে গ্রেফতার করবেই। এবং আমি আরেকটি বই লিখি, আহবান করি শত্রুতার অবসানের জন্য। বইয়ের শিরোনাম ছিল “আগুনের সমুদ্রে এক পদ্মফুল।“ বইটি নিউইয়র্কের হিল এন্ড ওয়াং থেকেও প্রকাশিত হয়।
সিস্টার চান কুং (Chan Khong True Emptiness) আজকে আমাদের সঙ্গে আছেন, তিনি হিউতে গ্রেফতার হন কারণ তারা পেয়েছিল এক কপি বই তার কাছ থেকে।
আমরা শুধু বলতে চাইছিলাম যে আমরা এই যুদ্ধ চলুক চাই না। আমরা চাই শান্তিময় পূর্ণমিলন। সেই সময়ে আমি প্রতিষ্ঠিত করি ‘উচ্চতর বৌদ্ধধর্ম অধ্যয়ন ইনিস্টিটিউট’ এবং একটি বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়: ভন হন বিশ্ববিদ্যালয় (Van Hanh University) ও ‘সমাজ কল্যাণের জন্য তরুণদের বিদ্যালয়‘ যেখানে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো তরুণদের সাহায্য করতে যে গ্রামগুলো বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে এবং শরণার্থী শিবির গঠন করতে নতুন গ্রামে মানুষরা যাতে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারে। আমরা প্রচুর তরুণ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিই কাজ করতে, যত্ন নিতে যারা আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে আর যারা অনাথ হয়েছে, এবং আমরা পাইলট গ্রাম করি যেখানে কৃষিজীবি মানুষরা নিজেরা একত্রিত হয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ে ব্যবস্থা করতে পারে।
এভাবেই আমরা তরুণ সমাজকর্মিদের প্রশিক্ষণ দিই যেখানে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীরাও ছিল, গৃহীরাও ছিল। সবাই শান্তি ও পুনর্গঠন কাজে খুবই নিবেদিত ছিলেন। এবং আমাদের অনেক কর্মি তারা যখন সাহায্য সহযোগিতা করছিল তাদেরকে আটক করে নিয়ে যায়, অনেককে বিতাড়িত করে যুদ্ধরত দুদলের দ্বারা। আমার অনেক শিষ্য হারিয়ে যায় যখন কাজ করছিল দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের জন্য, তাদেরকে ধরে নিয়ে যায়, কোনদিনই তারা আর ফিরে আসেনি। তারা কোন বন্দুক ধারণ করেনি, তাদের হৃদয় ছিল ভালোবাসায় পূর্ণ আর মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। তারা আমাদের অনেক কর্মিকে খুন করে। আমরা শুধু পুনর্গঠনের জন্য কাজ করছিলাম, অথচ তারা আমাদেরকে পছন্দ করছিল না।
এ ধরনের যুদ্ধরত অবস্থায়, আপনি যদি নিজেকে নিরাপদ রাখতে চান, তাহলে আপনাকে যুদ্ধরত একপক্ষে থাকতে হবে, একটা পক্ষ অবলম্বন করতে হবে। যদি আপনি এক পক্ষ নেন, আপনি সেই পক্ষের দ্বারা অন্তত পক্ষে রক্ষিত হবেন।
কিন্তু যদি আপনি পক্ষ না নেন, আর তখন আপনি দুদল থেকেই অত্যাচারিত হবেন। যে শান্তি আন্দোলন আমরা শুরু করি ভিয়েতনামে সেই রকম ভয়ংকর অবস্থায় ছিলাম। এবং উভয় পক্ষ এতো সন্দেহ করত যে আমরা কাজ করছি অপর পক্ষের জন্য।......
একদিন আমি ‘সমাজ কল্যাণের জন্য তরুণদের বিদ্যালয়‘ এ আসি এবং তারা আমাদের আক্রমন করে। আমরা শুধু দুর্দশাগ্রস্থদের জন্য কাজ করছিলাম, তারপরও ভাবছিল আমরা অপর পক্ষের জন্য কাজ করছি। অন্ধ ক্যাথলিক, অন্ধ কমিউনিস্ট, তারা আসলো আমাদের বিদ্যালয়ে এবং আমাদের সমাজ কর্মীদের হত্যা করল, এবং আমার কক্ষে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারল। এর আগেই ওরা এসে দেখে গিয়েছিল কোন কক্ষে আমি ঘুমাই। সেটি ছিল পাআপ ভন বিহার। বিহারটি ছিল পারিবারিক উপাসনালয়ের মতো যেখানে তরুনদের জন্য বিদ্যালয় যারা নিবেদিত সমাজ কর্মের জন্য।
সমাজ কল্যাণের জন্য তরুণদের বিদ্যালয় ঘরটি আমাদের কর্মীদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। আমরা ইট তৈরী করি, সেগুলো দিয়ে বিদ্যালয় গৃহ, থাকার কক্ষ আর বাদবাকী সবকিছু নির্মাণ করি। এবং আমরা সরকার থেকে কোন সাহায্য নিইনি কারণ, যদি আমরা সাহায্য নিই, তাহলে আমরা যুদ্ধরত একটা দলের মধ্যে পড়ে যাই। তাই আমরা সাধারণ মানুষদের ওপর নির্ভর করছি নানা সামগ্রী পেতে: নির্মাণ সামগ্রী, খাবার ও অন্যান্য দ্রব্য..।
সেজন্য সে রাতে তারা গ্রেনেড ছুঁড়ে মারল আমার কক্ষে। ভাগ্যক্রমে, আমি ছিলাম না। ঘটনার একদিন আগে আমি আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা দিই কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দিতে। না হলে আজ আপনাদের সামনে আমাকে দেখতে পেতেন না…!
এবং আপনারা জানেন যে তখন থেকেই আমি চেষ্ঠা শুরু করি আমেরিকা আর ইউরোপকে বলতে যে আমরা যুদ্ধ চাই না, আমি বলছিলাম ভিয়েতনামের সব মানুষের জন্য আর সে জন্যই ভিয়েতনাম সরকার আমাকে দেশে ফিরতে অনুমতি দিচ্ছে না এই ভ্রমণের পর।
এরপর থেকেই আমি পশ্চিমে নির্বাসিত জীবন শুরু করি, আর ৪০টি বছর সেই নির্বাসিত জীবন আমার কাটতে হয়!
এ রকম জীবন যাপন সত্যিকারভাবে ভীষণ কষ্টদায়ক!
আমার সব বন্ধুরা ভিয়েতনামে তখন, আমার সব কর্মকাণ্ড ভিয়েতনামেই, এবং হঠাৎ আমি নিজেকে খুঁজে পেলাম গভীর একাকীত্বের জীবনে বন্দী হয়ে গেছি, কারণ আমি কিছুই করতে সমর্থ হচ্ছিলাম না।
সে অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে ধর্ম অনুশীলনে নিজেকে গভীরভাবে সঁপে দিলাম, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে আমি শুরু করলাম নতুন বন্ধুত্ব করতে যাদের সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে, সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশ। শুরু করলাম ভাবনা অনুশীলন করা ও অন্যদের মধ্যেও সেটা ছড়িয়ে দিতে চাইলাম।
আমেরিকায় কয়েকটি জায়গায় বক্তব্য দিলাম। এরপর আমি ফ্রান্সের প্যারিসে আসলাম রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করার জন্য, এবং প্রতিষ্ঠা করলাম শান্তি প্রতিনিধি দল যেন সাধারণ মানুষের জন্য কথা বলতে পারি। ভিয়েতনামে যারা কথা বলতে পারছিল না তাদের জন্য।
তখন ভাবনা অনুশীলনের জন্য আমাদের বড়সর কোন জায়গা ছিল না। তাই আমরা কোয়াকার (খ্রীস্টান ধর্মের একটি দল) বন্ধুদের অনুরোধ করলাম বসে ভাবনা অনুশীলনের জন্য একটা জায়গা দিতে।
প্যারিসের রেও ভাউগিরারডে (Rue Vaugirard) একটি কোয়াকার কেন্দ্র ছিল। আমরা জানতাম তারা শান্তির জন্য কাজ করছে। বুঝতে পারছিলাম আমাদের কঠিন মানসিক সমস্যার জীবন; যদি ভাবনা অনুশীলন না করি তাহলে দিশেহারা হয়ে যাবো আমরা। তাই ভাবনা অনুশীলন চালিয়ে যাওয়া অপরিহার্য শান্তি বা সমাজের জন্য কাজ করতে। ভিয়েতনামে থাকতেই বুঝিয়েছিলাম ‘সমাজ কর্মের জন্য তরুণদের বিদ্যালয়ে” যদি আপনি দীর্ঘ সময়ের জন্য কাজ করতে চান, তাহলে আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে, না হলে আপনি নিজে হারিয়ে যেতে পারেন হতাশায় বা ক্রোধে বা পরাজয় মনোভাবে।
তাই আমি চাইছিলাম প্যারিসেও সেইভাবে ভাবনা অনুশীলন চলুক, সর্বোচ্চ চেষ্ঠা চালিয়ে গেলাম ভিয়েতনামে যুদ্ধ বন্ধ করতে, এবং আমরা ভাবনা অনুশীলন চালিয়ে যাবার চেষ্ঠা করি যাতে করে আমরা শান্তি কর্মী হিসেবে টিকে থাকতে পারি।
অধ্যাপক জর্জ কাহিন ছিলেন কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার, রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক। তিনিই ভিয়েতনামে আমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছিলেন আমাকে আমেরিকা আসতে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ধারাবাহিক কয়েকটি বক্তব্য দিতে। আমাকে তাঁর সেই চিঠিকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয় এ কারণে যে সেই চিঠির জন্যই আমি ভিয়েতনাম পাসপোর্ট ও ভিসা পাই।
যখন কতৃপক্ষ পাসপোর্ট দিচ্ছে আমায় বললো, “শান্তি নিয়ে কোন কথাবার্তা বলবেন না।“ এবং মনে মনে ভাবছি সেসময় আমার উদ্দেশ্যে তো সেখানে গিয়ে সেটাই বলা।
তাদের কথাই আমি কিছুই বলিনি, শুধু হাসলাম।
সেটি ছিল ১৯৬৬ সাল।
🕊🏜🕊🏜🕊🏜
◇◇◇◇◇◇◇◇◇◇
Ref: youtube: Touch life with every Breath:
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
ভাষান্তর: রতন জ্যোতি ভিক্ষু,
শ্রী পঞ্ঞাসিহে ভাবনা কেন্দ্র,
পামডেল, ক্যলিফোর্ণিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।
July 28, 2024।
====================
0 Comments