Hot Posts

6/recent/ticker-posts

Ad Code

ভদন্ত প্রজ্ঞাজ‍্যোতির ব‍্যক্তিত্ব ও বিশ্বময় বুদ্ধ সাসনে অবদান; ৯২ তম জন্ম দিন স্মরণে ঃ (২য় পর্ব)

 ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতির ব্যক্তিত্ব ও বিশ্বময় বুদ্ধ সাসনে অবদান; ৯২ তম জন্ম দিন স্মরণে ঃ

(২য় পর্ব)
**************



আমি প্রজ্ঞাবংশকে বুদ্ধ প্রেমিক করার মূল কারিগর তিনি । সেই কারিগরের মুখে শুনেছি গৃহীকালে প্রাইমারি শিক্ষা সমাপ্তির পর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার সূচনাতেই তিনি পিতৃহারা হন। ফলে সেই পিতৃহারা হিমাংশু স্কুল শিক্ষা ত্যাগ করে মা ও এক বোন , এক ভাইয়ের ভরণ পোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাকেই নিতে হলো জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে। গ্রামের এক আত্মীয়ের সহায়তায় চট্টগ্রাম শহরের আছাদগন্জ এলাকার এক টিনের পেটিকা তৈরীর দোকানে যোগানদারের সামান্য বেতনে চাকুরী নিলেন।কিন্তু অল্প সময়ে নিজেও কারিগর হয়ে উঠলেন। ফলে বেতন বৃদ্ধিতে পরিবারের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হলেন । বোনকে পাত্রস্থ করার পর মন আর এভাবে জীবন কাটাতে চাইলো না।
কারণ হিমাংশু শৈশব থেকেই পারিবারিক জীবনের প্রতি একপ্রকার উদাসীন বিরাগতা অনুভব করতেন। তাই সময় পেলেই নিকটবর্তী বিহারে গিয়ে প্রায় সারাক্ষণ বুদ্ধি মূর্তির সামনে বসে থাকতেন।বুদ্ধের মুখাবয়ব যতই দেখেন যেন দেখার স্বাদ মিটেনা। কি ভাবনায় যে থাকেন অনেক সময় মনেও থাকেনা। কিন্তু সম্বিৎ ফিরতেই দুই চোখের জল গন্ড পর্যন্ত গড়ানোর বিষয় টের পেতেন। এভাবে দিন যেতে যেতে এক সময় মনের আনন্দে ছোট ছোট বুদ্ধ মূর্তি নিজেই নির্মাণ শুরু করে দিলেন এঁটেল মাটি দিয়ে । তন্ময় হয়ে করা মূর্তি গুলো বেশ প্রাণবন্ত হতো প্রায় প্রত্যকটি। এগুলোর উপর রং তুলির কাজ করলে হয়তো বাণিজ্যিক লাভবান হতে পারতেন । কিন্তু, বুদ্ধের প্রতি অতি গৌরব বশে বিষয় টি মনে কখনো জাগলে পরক্ষণে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতেন । বুদ্ধকে কি করে বাণিজ্যিক পণ্য করবেন?
হিমাংশুর বাড়ির পাশেই ছিল শ্মশান । আর অনতিদূরে ছিল পেলাগাজীর দিঘির পাড়ে নির্জন বিশালাকার জঙ্গল । কখনো শ্মশানে বসে জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব নিয়ে ভাবতেন । কখনো দিঘীর জঙ্গলে বসে মনকে শান্ত স্থির করার চেষ্টা করতেন চোখ বন্ধ করে। এসব বিষয়ে কেহ তাঁকে উপদেশ দেননি; শিক্ষা প্রশিক্ষণও দেননি। আপন মনে আপন মনের তাগিদেই এসব করতেন। বয়োজ্যোষ্ঠ কারো সাথে প্রয়োজনের বাইরে কোন বাক্যালাপ করতেন না। মা বাবার প্রতি কোন আবদার করতেন না। যা পেতেন তাতে সন্তুষ্ট থাকতেন। সমবয়স্কদের সাথে দৌড়ঝাঁপ খেলা ধুলা, হাঁস্য রসিকতা করার ইচ্ছাও জাগতো না। কিন্তু লেখাপড়া, মা বাবা ভাই বোনের প্রতি যথা দায়িত্ব পালনে কোনো ত্রুটি ছিল না ।
কিশোর হিমাংশুর এমন হাবভাবের কারণে গৃহী জীবনেই গ্রামের লোক আর নিকট স্বজনেরা তাঁকে সম্বোধন করতেন সাধু নামে ।
গৃহী জীবনের এই কাহিনী গুরুদেব ভদন্ত প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথেরো আমাকে বলেছিলেন। তিনি গৃহী জীবনে ধ্যানের সমধি স্থরে যখন উন্নীত হতেন তখন মন ও মুখমন্ডলের বিপ্রসন্নতা হতে ধ্যানজ আলো বিচ্ছুরিত হতো । তাতে রাতের অন্ধকারে প্রদীপের আলো ছাড়া চলাফেরা করতে পারতেন । একদিন বিহারে বিকেল বেলায় ধ্যান অনুশীলনের এই পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার পর সন্ধ্যা অতীত করে যখন বাড়ি ফিরছিলেন ; তখন দেখলেন পথের পাশে এক শুকনো পুকুরে একটি গরু জলজ ঘাস খেতে গিয়ে কাদায় আটকে গেল । কিছু লোক বহু চেষ্টা করেও গরুটি উদ্ধার করতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছিলেন । সাধুজী তা দেখে পরম মৈত্রী চিত্তে গরুটির লেজ ধরা মাত্রই আশ্চর্যজনক ভাবে গরুটি লাফ দিয়ে উঠে আসলো। উপস্থিত সবাই আবাক বিস্ময়ে সাধুর প্রশংসা করতে থাকলেন । কয়েক দিনের মধ্যে সমগ্র এলাকায় ঘটনাটি রটে গেল । গ্রামের জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ সবাই সেই থেকে সাধুকে সম্মান সমীহ করে চলতেন।
পিতার অকাল প্রয়াণে সাধু সুধাংশু বিমলের বিদ্যালয়ের পাঠ , ধ্যান অনুশীলন সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেল । তার পরও তিনি সৌভাগ্যবান যে চট্টগ্রাম শহরে কর্মরত অবস্থায় সন্ধান পেছিলেন উনাইনপুরার উন্নতপর্যায়ের সাধক ভদন্ত জ্ঞানীশ্বর মহাথেরোর । সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন এই নিবেদিত সাধকের পরশ ধন্য হতে । গৃহী জীবনে বীতশ্রদ্ধ মন , ভেঙে পড়তো প্রাণের মানুষটির সম্মুখে । আমি পূজ্য সংঘরাজ ভদন্ত ধর্মসেন ভান্তের মুখে বহুবার শুনেছি আমার ভাবি গুরু এই সাধুজী উনাইনপুরা লংকারাম বিহারে গিয়ে গুরুর পদতলে অনাথের মতো অঝোরে অসহায় কান্নার বিষয়টি।
একদিকে গৃহী জীবনের বদ্ধ খাঁচায় দিবারাত্রি মনের ছটপট্ ; অপরদিকে অসহায় প্রিয় মা আর ছোট ভাই বোনের দায়িত্ব। পিতার একটি ভিটাবাড়ী ব্যতীত আর কিছুই ছিল না যে ; তার উপর ভরসা রেখে তিনি মুক্তির শান্তির জীবনে চলে যাবেন । এভাবে অসহনীয় মানসিক কষ্টের মাঝেও এক সময় বোনকে সুপাত্রস্থ করলেন ; ছোট ভাই মা কে রক্ষার উপযুক্ত হলো । আর তারপরেই নীরবে একদিন নিরুদ্দেশ হলেন । মা পাগল প্রায় হয়ে খুঁজে পুণঃ ঘরে নিয়ে আসলেন । কিন্তু ঘরে ধরে রাখা অসম্ভব দেখে জ্ঞাতি ভিক্ষু উপসংঘরাজ গুণালংকার মহাথেরোর কাছে শ্রামণ্য জীবনে দীক্ষা দিলেন ১৯৫৮খৃঃ ১৬ই আষাঢ়ে । গুরু নামাকরণ করলেন শ্রামণ প্রজ্ঞাজ্যোতি । জেনেরাখা ভালো এটা তাঁর দ্বিতীয় বারের প্রব্রজ্যা । প্রথম বার প্রব্রজ্যা নিয়ে ছিলেন পিতা ভগীরত বড়ুয়ার মৃত্যুতে সপ্তাহিক সংঘদান উপলক্ষে অপর জ্ঞাতি ভিক্ষু পূজ্য সংঘরাজ ধর্মানন্দ মহাথেরোর নিকট । সেবারও মা স্বর্ণময়ী জোরপূর্বক চীবর ত্যাগ করায়ে ছিলেন।
এখন মাতার সম্মতিতে এই প্রব্রজ্যা নিলেন বটে ; কিন্তু মনের মতো গুরু পেলেন না। উপ-সংঘরাজ গুণালংকার মহাস্থবির চাইতেন প্রথমে ধর্ম বিনয় শিক্ষা অনুশীলন আর স্কুল কলেজে অধ্যয়ন করা । অতঃপর বিভিন্ন বিহারে অবস্থান করে গৃহীদের ধর্ম কর্মে সহায়তা করা । কিন্তু শ্রামণ প্রজ্ঞাজ্যোতি তো নিরবচ্ছিন্ন ধ্যান সাধনের জন্যই পাগল। তাই এক প্রকার গুরুর মতামত ছাড়াই তিনি চলে গেলেন উনাইনপুরা সধক ভদন্ত জ্ঞানীশ্বর মহাস্থবিরের কাছে । ভদন্ত জ্ঞানীশ্বর তো শ্রামণের মানসিকতা তাঁর গৃহী জীবন থেকেই জানতেন। তবুও প্রব্রজ্যা জীবনের প্রধান ভিত্তি ধর্ম বিনয় না জেনে , ধ্যান ভাবনা প্রব্রজ্যিতের জন্যে মঙ্গল দায়ক নহে বিধায় তিনি পার্শ্ববর্তী গ্রাম কত্তালা সদ্ধর্মলংকার বিহারে অবস্থানরত বিনয়াচার্য বংশদ্বীপ মহাস্থবিরের শিষ্য ভদন্ত আনন্দমিত্র মহাস্থবিরের উপর দায়িত্ব দিলেন শ্রামণ প্রজ্ঞাজ্যোতি কে ধর্ম বিনয় ও ধ্যান সাধনা শিক্ষা দানের জন্যে। কারণ সেসময়ে ভদন্ত আনন্দমিত্র মহাস্থবির ছিলেন আধুনিক শিক্ষায় এবং ধর্ম বিনয় ও ধ্যান সাধনায় সুশিক্ষিত একজন ভিক্ষু। সাধক ভদন্ত জ্ঞানীশ্বর মহাথেরো শ্রামণ প্রজ্ঞাজ্যোতিকে ভদন্ত আনন্দমিত্র থেরোর হাতে তুলে দিলেন এই বলে ; আনন্দ ! এই শ্রামণ আমার পুত্র । তুমি তাকে ধর্ম বিনয়ে ও ধ্যান সাধনায় সুশিক্ষিত করো । তার দ্বারা বুদ্ধ সাসনের অনেক কল্যাণ হবে।
হা ! এই মহাপুরুষের অভিজ্ঞান ভূল ছিলনা। শ্রামণ প্রাজ্ঞাজ্যোতি শ্রামণ জীবনেও বহু চীবর ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়া ভিক্ষুকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে সক্ষম হয়েছিলেন। ভিক্ষু হওয়ার পর বহু দিন মজুর যুবক থেকে কলেজ পড়ুয়া যুবকদের কে ধর্ম বিনয় আর ধ্যান সাধনা শিক্ষা দিয়ে ; প্রব্রজ্যা জীবনের মহনীয়তায় বুদ্ধ অনুরাগী করে গেছেন । এমন কি সেই পরশ পাথরের সান্নিধ্য প্রাপ্ত কোন ভিক্ষু শ্রামণ পরিস্থিতির শিকার হয়ে যদি অনিচ্ছাকৃত চীবর ত্যাগ করতেন ; তাপরও সারা জীবন প্রব্রজ্যিত চিত্ত নিয়েই জীবন যাপন করতে দেখা গেছে । তিনি কখনো ভাবতেন না , এই শ্রামণ , এই ভিক্ষু আমার শিষ্য ; তাই তাকে একটু বিশেষ বিবেচনায় রাখা দরকার । নিজের শিষ্য , পরের শিষ্য নির্বিশেষে যখনই তিনি শুনেছেন অমুক প্রব্রজ্যিত প্রব্রজ্যা ত্যাগের চিন্তা করছে ; কালবিলম্ব না করে তিনি তার কাছে উপস্থিত হতেন । ঘন্টার পর ঘণ্টা বুঝাতেন বিমতি গ্রস্ত মনে বৈরাগ্যের জন্ম দানের জন্যে । এমন বুদ্ধ প্রেমী, এমন বুদ্ধ সাসন দরদী কল্যাণমিত্র আমার সারা জীবনে দ্বিতীয় জন দেখিনি । (চলবে)

Post a Comment

0 Comments

Ad Code

Responsive Advertisement