তথাগত বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ ঘোষণা দিবসের শিক্ষা ও অনুধাবন:
“প্রস্তুতি নিয়ে মৃত্যু” আর “মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত”-এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য কী উপলব্ধি করা যায়?
তথাগত বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ ঘোষণা দিবসের শিক্ষা, উপরোক্ত দুই চিরন্তন সত্যকে বাস্তবিকভাবে উপলব্দি করতে সহায়তা করে। অকস্মাৎ মৃত্যু জীবনকে গ্রাস করে নেওয়ার চেয়ে, প্রত্যহিক স্বল্পতর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতিতে মৃত্যুকে বরণ করতে সমর্থ হওয়া, শ্রেয়তর মনে করি। প্রমত্ত মানুষের মৃত্যু এবং অপ্রমত্ত মানুষের মৃত্যু – দুটোই সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। বৌদ্ধ সাহিত্যে তাই সাধারণ মৃত্যু ও পরিনির্বাণ লাভ - এ দুটিকে পৃথকরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
তাই, প্রস্তুতি নিয়ে ক্রমে মৃত্যু আর মৃত্যুর জন্য যে কোন সময়ই প্রস্তুত-এ দুটোর মধ্যে বহু পার্থক্য বিদ্যমান। বিষয় দুটোকে আরেকটু গভীরভাবে এভাবেও অনুভব করা যায়-
সাধারণত যে ব্যক্তি জানে যে, মৃত্যু-নামক এক চিরশ্বাসত সত্য আছে। ভবিষ্যতে, একদিন, যে কোন সময়, মরতে হবে। তিনি সেভাবেই মৃত্যুর জন্য চিন্তা করেন। পরন্তু, যে আলোকিত ব্যক্তি কিংবা ধ্যান-সাধনায় প্রতিনিয়ত নিবেসিত সচেতন ব্যক্তি, সম্যকভাবে জীবন যাপনের পর, সম্যকজ্ঞানে অবগত হয়ে প্রস্তুত থাকেন, যে কোন সময়ই মৃত্যকে বরণ করে নিবেন। কার্মিক তত্ত্বে, তাই গভীরভাবে ভাবলে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি ও মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত - এ দুটোর মধ্যে বহু পার্থক্য, চিরসত্য মৃত্যুকে বরণ নিতে সহায়তা করে। স্বাভাবিক মৃত্যু ও অকস্মাৎ মৃত্যু-এ দু’ধারায়, প্রত্যক প্রাণীর স্বকীয় কর্মতত্ত্বকে এতে আরো বেশী প্রকটতর করে। ইদানিং কেন জানি মনে হয়, Peaceful Death সম্পর্কে, বৌদ্ধিক দর্শনের প্রথাগত ধারায়, আমাদের আরো গভীর চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন।
উল্লেখিত দৃষ্টিকোণে অনুধাবন করলে, তথাগত বুদ্ধের ৪৫ বছরের ধর্মপ্রচারের জীবনের বহু ঘটনাপ্রবাহকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারা যায়। তথাগত বুদ্ধের জীবন সয়াহ্নের শেষ ৯০ টা দিন কেমন ছিলো? বৈশালীর চাপালচৈত্য থেকে কুশীনগরের মহাপরিনির্বাণ শয্যা অবধি, তথাগত বুদ্ধ প্রতিটি পদক্ষেপ-বিচরণ, প্রতিটি কথাবার্তা, কতোই না অপ্রমত্তভাবে, সতর্ক-সচেতনতার সাথে, প্রতিটি শেষ-মুহুর্তকে অতিবাহিত করেছিলেন। সেই ভাবনায়, যতই মনোনিবেশ করি, ততই তথাগত বুদ্ধের অনন্তগুণের প্রতি চিত্ত-প্রসন্নতার উদয় হয়। এ মৃত্যু ভাবনা তাই নেতিবাচক অর্থে নয়, বরং আমাদের জীবনকে যথার্থ ও সম্যকভাবে প্রতিটি মুহুর্তকে উদযাপন করতে, আরো সার্থক ও অর্থপূর্ণভাবে অতিবাহিত করতে, একান্তভাবে কার্যত সহায়তা করে।
আজকের দিনে, মহাপরিনির্বাণ সূত্রে দেশিত, নিন্মোক্ত বুদ্ধবাণী স্মরণ-অনুসরণ করা যায়:
“অপ্পমত্তা সতিমন্তো সুসীলা হোথ ভিক্খবে।
সুসমাহিত সঙ্কপ্পা সচিত্তমনুরক্খথ॥”
“হে ভিক্ষুগণ! তোমরা অপ্রমত্ত, স্মৃতিমান, শীলবান, সু-সমাহিত [ধ্যান পরায়াণ] ও সংকল্প পরায়ণ হও এবং স্বীয় চিত্তকে সতত রক্ষা কর।”
সেই নিরীখে, সুফলস্বরূপ, তথাগত বুদ্ধের নিন্মোক্ত বাণীও আরো অধিকতর উৎসাহব্যঞ্জক-অনুপ্রেরণাময়:
“যো ইমস্মিং ধম্মৰিনযে, অপ্পমত্তো ৰিহস্সতি।
পহায জাতিসংসারং, দুক্খস্সন্তং করিস্সতী’তি॥”
“যে ব্যক্তি এই ধর্ম-বিনয়ে অপ্রমত্ত হয়ে বিহার করবেন, সে জন্মা[ন্তর] ও সংসারকে অতিক্রম করে, সমস্ত দুঃখের অন্তসাধন করতে সমর্থ হবেন।”
জগতের সকল সত্ত্বের, সমস্ত দুঃখের অন্তসাধন হোক।
বিশ্বের সকল প্রাণী সুখী হোক।
0 Comments