Hot Posts

6/recent/ticker-posts

Ad Code

উপেক্ষা

                               

                                    উপেক্ষা
                                    
  জোসেফ গোল্ডস্টেইন

 

বুদ্ধের ধর্মে উপেক্ষা একটি উপাদান আমাদের জীবনের সুখের ক্ষেত্রে যেমন ভূমিকা রাখে, তেমন আবার আধ্যাত্মিক বিমুক্তির ক্ষেত্রেও। একটা পরিপ্রেক্ষিত থেকে আমরা বলতে পারি যে পুরো আধ্যাত্মিক অভিযাত্রাটা নির্ভর করে এই একটি চৈতসিক (mental factor) অনুশীলনের ওপর আর একসময় চিত্ত বিমুক্তি লাভ করে। এবং এই চৈতসিক অবস্থাটি হলো উপেক্ষা। ইংরেজিতে সাধারণভাবে অনুবাদ করা হয়েছে ‘Equanimity’ হিসেবে। অভিধর্মে বলা হয় ‘সাধারণ শোভন চৈতসিক (Universal Beautiful Qualities) যা মনের কুশলময় অবস্থাগুলো যা প্রত্যেক কুশল মুহূর্তে তারা একসঙ্গে উৎপন্ন হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্মৃতি অনুশীলনের প্রতি মুহূর্তে সমস্ত সুন্দর অবস্থাগুলো মনের মধ্যে উপস্থিত থাকে যেমন: শ্রদ্ধা, অলোভ বা দান, অদ্বেষ বা মৈত্রী, অমোহ বা প্রজ্ঞা। তাই উপেক্ষা হলো শোভন কুশল চিত্তের একটি।

 

সাধারণত উপেক্ষা সংজ্ঞায়িত বা বোঝা হয় মনের নিরপেক্ষ অবস্থাকে। পণ্ডিত ভিক্ষু বোধি খুব সুন্দরভাবে উপেক্ষাকে ইংরেজিতে সংজ্ঞায়িত করেছেন: “Upekkha : There in the middleness: উপেক্ষার অবস্থান ঠিক মাঝখানে।“ আমার মনে হয় এই একটি বাক্যটির মধ্যে উপেক্ষার প্রকৃতগুণ ফুটে উঠেছে। উপেক্ষা হলো সেই গুণময় অবস্থা যেটি থাকে সবকিছুর মাঝখানে। এটা সেইগুণ মনের সমান অবস্থা এবং এটি যখন সর্বোচ্চ অবস্থাতে উন্নতি হয়, তখন মন হয় অকম্পিত।

 

যখন আমরা ‘উপেক্ষা’ কে ইংরেজিতে অনুবাদ করি ‘Neutrality of Mind’ ‘মনের নিরপেক্ষতা’-এটা অনেকটা বোঝায় কোন কিছু থেকে সরে থাকা, কোন কিছুতে সম্পৃক্ত না হওয়া। কিন্তু সত্যিকারভাবে ভাবনা অনুশীলনের মাধ্যমে যখন উপেক্ষা গুণধর্ম জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে, দেখতে পাবো যে এটা কোন কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা নয় আদৌ। তবে ‘Neutrality’ এর পরিবর্তে উপেক্ষার অনুবাদ ‘Impartiality’ অনেকটা ঠিক-যে মন থাকবে উদার ও পক্ষপাতহীন। সত্যিকারভাবে আমরা স্বাদ নিতে পারি, সেই অনুপম পক্ষপাতহীনতার উপেক্ষা গুণধর্ম ধারণ করে। আর তখনই আমরা বুঝতে পারবো, কেনো এটিকে শোভন চৈতসিক বলা হয়েছে। আমরা বুঝতে পারবো, পক্ষপাতহীন উপেক্ষা চর্চা আমাদের দৈনন্দিন সাধারণ জীবনযাপনে নিয়ে আসে শান্তি ও ভারসাম্য।

 

তথাগত বুদ্ধ বলেছেন আমাদের প্রাত্যহিক স্বাভাবিক জীবনে অষ্ট লোকধর্মের সম্মূখীন হই। সবার জীবনে পুনঃ পুনঃ অষ্ট লোকধর্ম সংঘঠিত হয়। লাভ-অলাভ, যশ-অযশ, নিন্দা-প্রশংসা, সুখ-দুঃখ। একটি চলে গেলে আরেকটি আসে। যখন উপেক্ষা গুণধর্ম উপস্থিত থাকবে আপনার মনে, অষ্ট লোকধর্মের যত বড় ঢেউ আসুক না কেন আমাদের কিছুই করতে পারবে না। আর যদি উপেক্ষা গুণধর্ম শক্তিশালী না হয় অষ্ট লোকধর্মের ঢেউ-এর আঘাতে জীবন হয় তচনচ। সেজন্য মানুষরা কোন ঘটনার মুখোমুখি হলেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং দুঃখে ভুগতে থাকে।

 

আমরা দেখতে পাই লাভ-অলাভের খেলা আমাদের জীবনে। সবসময় চিন্তা করি লাভ-অলাভের কথা বস্তুজাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, আমরা এক সময় লাভ করি, আবার কখনো ক্ষতির সম্মূখীন হই। কিন্তু সত্যিকারভাবে আমরা অনুভব করতে পারি যেকোন অবস্থায় লাভ-অলাভের প্রভাব যেখানে আমরা বিনিয়োগ করি বা আমরা নিজেদেরকে ভাবি আমি, আমার ও আত্ম (myself); এগুলো শুধুমাত্র বৈষয়িক পৃথিবীর আর্থিক লেনদেনের একটা স্বাভাবিক অবস্থা ধারণ করতে পারলে তাহলেই মনে চলে আসবে ভারসাম্য অবস্থা।

 

আমরা দেখি যে লাভ ও ক্ষতির সেই মানসিক চাপটাও থাকে ছোটখাটো বিশ্বাসবোধের মধ্যে। আমরা এটা হতে দেখি স্থানীয়ভাবে, আবার আন্তর্জাতিকভাবেও। এটাকে দেখা যায় তুলনামূলক ছোট অবস্থায় অথবা সত্যিকারভাবে বেদনাদায়ক ঘটনায়। আপনি যদি নিউ ইংল্যাণ্ডে থাকেন আর রেড সক্স খেলা দেখেন, আপনি মনের নড়াচড়ার অনুভূতি অনুভব করবেন। সেই অবাক করা অনুভূতিগুলো আসে সেই ছোটখাটোর বিশ্বাসবোধের কারণে। যদি নিজের পছন্দের দল জিতলে মনে যে কী আনন্দ আর হারলে অবসাদগ্রস্থ হয়ে থাকেন অনেকদিন ধরে। লাভ ও ক্ষতি হলো জীবনের অংশ। লাভ ও ক্ষতির চাপটা দৃঢ় ধর্মীয় বিশ্বাস বা জাতিগতবোধ এবং যুদ্ধক্ষেত্রেও ঘটে এবং সেজন্য একে অপরকে হত্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েও মানুষরা।

 

এই ভাবনা অনুশীলনে জীবনের লাভ-ক্ষতি/হারানো বিষয়টি আপনাদের মনে আসবে এবং মনের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হবে। ভাবনা অনুশীলন করছেন আপনি এতে করে আপনার মন শান্ত ও একাগ্র হলো আর আপনি এই প্রাপ্তিতে আনন্দিত হলেন। আশা করলেন পরবর্তীতেও সেটা আসবে কিন্তু এলো না। আপনার মনের মধ্যে চঞ্চলতা বা অনীহা কাজ করছে তখন, আপনি অনুভব করতে লাগলেন অলাভের মানসিক অবস্থা। চিন্তা করছেন আমি কী ভুল করেছি, কেন আমি এটা হারালাম। ভাবনা অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আপনি জানলেন, সমস্ত অনুভূতি লাভ-ক্ষতির সংশ্লিষ্ঠ।

 

উপেক্ষা ধর্মের দ্বারা লাভ-ক্ষতিতে মন থাকে অচঞ্চল, ভারসাম্যময়। উপেক্ষার সেই মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকলে আমরা দেখতে পাবো লাভ-ক্ষতির এই দোলাচল যা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলছে, লাভ-ক্ষতি আমাদের জীবনকে দাসত্বে পরিণত করেছে। এটা এমন নয় যে লাভ আর ক্ষতিকে থামিয়ে দিতে পারবো চিরতরে, যা কখনোই সম্ভব নয়। তাহলে এর থেকে কিভাবে মুক্ত হতে পারবো? আমরা কিভাবে মধ্যবর্তী অবস্থানে (middleness) থাকতে পারবো? আমরা কি ভারসাম্য মন নিয়ে থাকবো না লাভ-ক্ষতির সম্মূখীন হয়ে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া করে যাবো।? আমাদের জীবনতো সেটা নয় লাভ-ক্ষতির সম্মূখীন হলেই অন্যরূপ ধারণ করে ফেলবো।

 

নিন্দা ও প্রশংসা হলো জীবনের উত্থান-পতনের আরেকটি যুগল। এটা আমার ব্যক্তিগত জীবনে বেশী ঘটেছে এবং আমার মনে হয়, এটি সব লেখকের ক্ষেত্রেও সত্য। আমার ‘এক ধর্ম’ বইটি যখন প্রকাশ হয় আমাজন থেকে, সেই প্রথমকার দিনগুলোতে যারা বইটি ক্রয় করছিল তারা রিভিউ করছিল। কেউ কেউ লিখছিল ‘এক ধর্ম’ বইটি প্রজ্ঞালো (Enlightened) এনে দেবে, যা বৌদ্ধধর্মের আসল লক্ষ্য। আমি বইটি ভালোবাসি, এটি একটি বাস্তবসম্মত বই যা আমাকে পড়তে আগ্রহি করে তুলছে। আবার কেউ কেউ রিভিউ দিল, এই বইয়ে তাৎপর্যমূলক তেমন কিছুই নেই যেভাবে বইয়ের শিরোনাম করা হয়েছে। এটা যখন দেখলাম, আমি মাউসকে দিয়ে কারসারকে দ্রুত সরিয়ে ফেলছিলাম।

 

বইটি প্রকাশের পর আমি আনন্দে উদ্বেলিত হলাম। এক দিনে ২০ বারের ওপর দেখলাম অনলাইনে। প্রশংসামূলক কথাগুলো আমাকে সজীবতার অনুভবে হৃদয়কে ভরে তুলছিল, আর নিন্দামূলক মন্তব্যগুলো আমাকে অবসাদগ্রস্থতায় নিয়ে গেলো। ভাগ্য ভালো যে স্মৃতি অনুশীলনের মাধ্যমে আমি এ সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ করি। কারণ মনে পড়ে স্পষ্টভাবে আর আমি একে বলেছিলাম ‘প্রশংসা ও নিন্দার বৈশ্বিক প্রকৃতি।‘ বুদ্ধতো নিন্দা ও প্রশংসা থেকে বাঁচতে পারেননি। আমি আমার মনের তুমুল নড়াচড়া দেখলাম। স্মৃতি অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সেসবকে গ্রহণ করলাম, তাতে করে এরা শান্ত হয়ে গেল আর মন ভারসাম্যে এসে গেল একসময়। তাই বুদ্ধ বলেছেন, এ রকম অবস্থায় মনকে স্থির, অচঞ্চল রাখতে হবে আর এটা সম্ভব হয় উপেক্ষাধর্ম অনুশীলনের মাধ্যমে মন যখন উন্নত অবস্থায় পৌঁছে যায়।

 

ধর্মপদে উল্লেখিত হয়েছে:

 

‘সেলো যথা একঘনো বাতেন ন সমীরতি,

এবং নিন্দাপসংসাসু ন সমিঞ্জন্তি পণ্ডিতা।‘

 

‘কঠিন পর্বত যেমন বায়ু দ্বারা কম্পিত হয় না, তদ্রুপ পণ্ডিত ব্যক্তিরা নিন্দাপ্রশংসাতে বিচলিত হয় না।‘ গাথা ৮১

 

এরপর অন্য যে দুটি যুগল আমাদের জীবনকে নাড়ায় সুনাম (যশ) ও দুর্নাম (অযশ)। এটা অনেকটা নিন্দা-প্রশংসার মতোই। আমাদেরকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে আসলে সুনামটা কি। আমরা অনেকেই অল্প সুনামের জন্য কতো কিছু করি, আবার একটুও দুর্নাম সহ্য করতে পারি না। যদি আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে সুনাম-দুর্নাম অন্য মানুষের মনের অবস্থা, তাহলে আমরা যদি নিজেদের সুনাম-দুর্নামের অবস্থায় অটল, স্থির, ভারসাম্যময় এক মন রাখতে পারি, তাহলেই উপেক্ষাধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে বলতে পারবো। বাইরে কত কিছু ঘটবে আর মানুষের মনে থাকে অফুরন্ত চিন্তাধারা, কথাবার্তা কিন্তু যদি আমরা নিজেদেরকে জানি যে আমরা শীলে প্রতিষ্ঠিত, কারো ক্ষতির চিন্তা করি না, তাহলে সুনাম ও দুর্নাম এগুলো তেমন অর্থপূর্ণ  হয়ে ওঠে না জীবনে। এসব হলো মানুষের মনের প্রকল্পিত ধারণা।

 

শেষ যুগল দুটি হলো সুখ ও দুঃখ। আমাদের জীবনে মুখোমুখি হতে হয় এ দুটির এবং আমাদের কার্য কারণের জীবনকে খুব বেশি ছুয়ে যায়। আমরা সুখময় অবস্থাকে শক্তভাবে ধরে রাখতে চাই, আবার, কষ্টদায়ক বিষয়কে দূরে ঠেলে দিতে চাই। এ দুটি হলো আমাদের জীবনে ভয় ও আশার কারণ। আশায় থাকি সুখময় অবস্থার জন্য, আবার ভয়ে থাকি দুঃখময় পরিস্থিতির জন্য। মনের ভেতর সবসময় ঘুরপাক খেতে থাকে। বুদ্ধ বলেছেন, এসবকে আপনাকে গ্রহণ করতে হবে এবং দুঃখময় ও সুখময় অবস্থাকে ভাবনা অনুশীলনের সময় পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আমরা শুধুমাত্র সুখময় অবস্থাকেই গ্রহণ করতে চাই। অন্যদিকে, অতি ক্ষুদ্র দুঃখময় অবস্থাকে পর্যন্ত আমরা গ্রহণ করতে চাই না। আপনি যদি তা করেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনার উপেক্ষাধর্ম অনুশীলনের পরিপূর্ণতা পায়নি এখনো।

 

তাই আপনাকে ভাবনা অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞান ও দর্শনের (Clearity and understanding) সমৃদ্ধি করতে হবে। বুদ্ধের ধর্ম দার্শনিকের ধর্ম নয়। ভাবনা অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদেরকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে অভিজ্ঞতার স্রোতকে যা সর্বদা পরিবর্তনশীল: অষ্ট লোকধর্ম: লাভ-অলাভ, নিন্দা-প্রশংসা, যশ-অযশ ও সুখ-দুঃখ।

 

মনে রাখবেন যে উপেক্ষাধর্ম হলো যে মন অকম্পিত (imperturbable), ভারসাম্যময় (Balanced) যা সমস্ত কিছুকে গ্রহণ করে স্মৃতি অনুশীলনে পর্যবেক্ষণ করে নিরপেক্ষভাবে (impartially that embraces all) এবং তথাগত বুদ্ধ বলেছেন, এর চেয়ে উচ্চতম সুখ নেই যে চিত্তে থাকে শান্তি ও উপেক্ষাধর্ম।

 

================================================== 

টীকা: বিদর্শন আচার্য জোসেফ গোল্ডস্টেইন “Equanimity: ‘There in the Middleness” উপেক্ষা ধর্মের উপর দেশনাটি Insight Meditation Center, Massachusetts, USA এ প্রদান করেন এপ্রিল ১৭, ২০১২ সালে। (সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর)।

 

 --------------------------------------------------------------------------------------

ভাষান্তর: রতন জ্যোতি ভিক্ষু,      

শ্রী পঞ্ঞাসিহে ভাবনা কেন্দ্র,

পামডেল, ক্যলিফোর্ণিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

অক্টোবর ০৮, ২০২৪।

Post a Comment

0 Comments

Ad Code

Responsive Advertisement