হুসেন সাগর বুদ্ধমূর্তি
(বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী জ্যোতি বিকাশ বড়ুয়া)
হায়দরাবাদ-সেকেন্দ্রাবাদ
২০১৪
সালের নভেম্বরে সস্ত্রীক ভারত ভ্রমণে গেলে
কর্নাটক ও অন্ধ্র প্রদেশের
বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখে, সব শেষে হাজির
হই হায়দরাবাদে। হায়দরাবাদে যাওয়ার ব্যাপারে সাধারণ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাওয়া ছাড়াও আরো একটি বিশেষ
কারণও ছিল।
বাংলাদেশের চট্টগ্রামের এক কৃতি সন্তান
বর্তমান ভারত প্রবাসী ড.
সঙ্ঘরক্ষিত মহাথেরো হায়দরাবাদ সংলগ্ন সেকেন্দ্রবাদের মহেন্দ্র হিলস্’এর সুরম্য অবস্থানে
অপূর্ব স্থাপত্যমন্ডিত এক অতীব
সুন্দর বিহার প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিহারের নাম ‘আনন্দ বিহার’। নির্মাণ কার্য
সমাপ্ত হলে ২০০৩ সালে
মহামান্য দালাই লামা এর শুভ
উব্দোধন করেন। বয়সে আমার চেয়ে
তিন/চার বছরের ছোট
সঙ্ঘরক্ষিত মহাথেরো, সম্পর্কে আমার দূর সম্পর্কীয়
মামাতো ভাই হোন। ছোটবেলা
ও কৈশোরে মামার বাড়িতে গেলে দেখা হতো,
একসাথে খেলাধুলা ও ঘোরাঘুরি করতাম।
তারপর বহুযুগ কেটে যায়। তিনি
বড় হয়ে সংসারধর্ম ত্যাগ
করে সন্ন্যাসী হন। তাই সঙ্গত
কারণে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়। পরবর্তীকালে তাঁর
সাথে আবার যোগাযোগ হলে
তিনি বলতেন, কোনো সময়ে হায়দরাবাদ
গেলে, আমি যেন তাঁর
অতিথি হই। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা
যখন হায়দরাবাদে পৌঁছি তখন তিনি হায়দরাবাদে
ছিলেন না। আমরা এক
হোটেলে অবস্থান করি। পরদিন অমরাবতী,
নাগার্জুনকোন্ডা ঘুরে এসে
রাতে ওনার টেলিফোন পাই,
জানালেন তিনি হায়দরাবাদে ফিরে
এসেছেন। আমরা আমাদের ইতিমধ্যে
সম্পাদিত ভ্রমণ বৃত্তান্ত জানাই। বল্লাম- হায়দরাবাদ দেখা হয়নি, তার
জন্য আমাদের হাতে শুধু কালকের
দিনটি রয়েছে। তিনি জানালেন, কাল
খুব ভোরে উনি গাড়ি
নিয়ে আসবেন, আমরা যেন তৈরী
হয়ে থাকি।
পরদিন অর্থাৎ ২৯শে নভেম্বর সকাল
ঠিক সাতটায় সঙ্ঘরক্ষিত মহোদয় মারুতি ভ্যান গাড়ি নিয়ে আমাদের
হোটেলে হাজির হোন। সেই ছোটবেলা
থেকে অনেক বছর পরে
তাঁর সাথে সাক্ষাতে, কিশোর
বয়সের নানা স্মৃতির কথা
স্মরণ করে দুজনেই নষ্টালজিয়ায়
আক্রান্ত হই। পুরনো দিনের
স্মৃতি রোমন্থন করি।
প্রথমে তিনি ব্রেকফাস্টের জন্য
আমাদের নিয়ে যান একটা
রেস্টুরেন্টে। ব্রেকফাস্টের পর ভন্তে তাঁর
বিহারে নিয়ে যান।
ভন্তে আমাদের প্রথমে সারাদিন ধরে হায়দরাবাদের দ্রষ্টব্যসমূহ দেখে নিতে বল্লেন। গাড়ির চালক কাম গাইড হিসেবে আমাদের সাথে দিলেন স্থানীয় বাসিন্দা স্কুল ইনস্পেক্টর শারদ বাবুকে। গাড়ি থেকে নেমে এক ঝলক ভন্তের বিহার দেখি। ছোট বিহার, কিন্তু তার স্থাপত্য এবং পাহাড়ের কোলে তার অপূর্ব অবস্থান দেখে বিস্মিত হই। বেশী সময় নষ্ট না করে আবার তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসি। শারদ আমাদের হায়দরাবাদ ঘুরে দেখানোর জন্য রওনা দেন। প্রথমে নিয়ে চলেন শহরের বাইরে গোলকুন্ডা দুর্গ দর্শনে।
ড. সঙ্ঘরক্ষিত মহাথেরোর ‘আনন্দ বিহার’
গোলকুন্ডা দুর্গ ও কুতুবশাহী সুলতানদের সমাধিসৌধগুলি দেখে, স্থানীয় এক রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সারি। লাঞ্চের পর হয়দরাবাদের সালারজং মিউজিয়াম, চারমিনারসহ আরো কিছু দ্রষ্টব্য দর্শন করে আমরা আসি সেকেন্দ্রাবাদের হুসেন সাগরের পাড়ে। তখন প্রায় সন্ধ্যা।
হুসেন
সাগর : শহরে পর্যাপ্ত জল
সরবরাহ নিশ্চিত করতে ১৫৬২ সালে
ইব্রাহিম কুলী কুতুবশাহ মুসীর
এক উপনদীতে বাঁধ দিয়ে এই
লেক বা সরোবর সৃষ্টি
করেন। এটার পরিকল্পনা ও
বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত জামাতা হুসেন শাহ ওয়ালির নামানুসারে
এর এর নাম হয়
‘হুসেন সাগর’। এই
বাঁধ সেকেন্দ্রাবাদকে হায়দরাবাদের সাথে সংযুক্ত করেছে।
লেকের বর্তমান আয়তন ১৩ বর্গকিলোমিটার।
১৯৮৭-৮৮ সালে লেকের
বাঁধকে প্রশস্ততর করা হয় এবং
লেককে বেষ্টন করে নির্মাণ করা
হয় সুপ্রশস্ত রাজপথ। বৃত্তাকার রাজপথটি রাতের আলোকমালায় মুক্তোর নেকলেসের মতো দেখায় বলে
এর অপর নাম ‘নেকলেস্
রোড’। এই সড়কের
পাশে পাশে গড়ে তোলা
হয়েছে বহু সুদৃশ্য পার্ক
ও ঝর্ণা। মূল বাঁধে স্থাপন
করা হয়েছে রাজ্যের ৩৩ জন বিখ্যাত
ব্যক্তির প্রতিমূর্তি।
এন টি রামা রাও অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে (১৯৮৩-৮৯) একবার আমেরিকার নিউ ইয়র্ক ভ্রমণে গেলে, সেখানে ’স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ দেখে অনুপ্রাণিত হন। নিজ রাজ্যে এরকম কিছু একটা গড়ে তোলার সংকল্প নিয়ে দেশে ফিরেন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৮৫ সালে রাজ্যের প্রাচীন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে আবার ফিরিয়ে আনার জন্য ‘বুদ্ধপূর্ণিমা কমপ্লেক্স প্রজেক্ট’ নামে এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এতে লেকের পাড়ে লুম্বিনী পার্ক ও লেকের মাঝে এক বৃহৎ মনোলিথিক পাথরের বুদ্ধমূর্তি তথা ‘স্ট্যাচু অব উইস্ডম’ (জ্ঞান-এর মূর্তি) প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা অন্তর্ভূক্ত করা হয়। অন্য কোনো মূর্তির কথা না ভেবে ‘বুদ্ধের মূর্তি’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত তিনি কেন নিলেন ? প্রথমে তিনি হিন্দু দেব-দেবতা ব্রহ্ম, বিষ্ণু, শিব বা অন্য কোনো দেব-দেবীর কথা চিন্তা করেন। পরিশেষে সিদ্ধান্ত নেন- বুদ্ধের মূর্তিই নির্মাণ করবেন। তাঁর মতে এর কারণ- “তিনি (বুদ্ধ) একজন মহামানব, যিনি সব সত্য জনগণের জন্য বলে গেছেন, যাহা আমাদের অহংকার” (Rama Rao chose to depict Gautama Buddha because “He is a humanitarian who told the whole truth to the people. It is our pride”).
এন টি রামা
রাও’এর নির্দেশে শুরু
হলো মূর্তি নির্মাণের কাজ। প্রথমে শুরু
হলো মূর্তির জন্য একক বৃহৎ
সাদা গ্রানাইট পাথর খুঁজে বের
করা। অনেক অনুসন্ধানের পর
হায়দরাবাদ থেকে ৪০ মাইল
দূরে নলগোÐা জেলার
রায়গিরিতে পর্বতের ধারে এরকম এক
খÐ বিশাল পাথরের হদিস মেলে। সেখানে
এক বছরেরও বেশী সময় ধরে
শত শত দক্ষ কারিগর
ও ভাস্করদের সাহায্যে স্থপতি এস এম গণপতি
মূর্তি তৈরী করেন। মূর্তির
দৈর্ঘ্য ৫৮ ফুট এবং
ওজন ৪৫০ টন। ১৯৯০
সালে মূর্তি তৈরীর কাজ সমাপ্ত হয়।
তখন কিন্তু রামা রাও ক্ষমতায়
ছিলেন না। তার এক
বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮৯তে
তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। তাতে অবশ্য
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো ব্যাঘাত ঘটে
নি। নির্মাণ
শেষ হলে ৪৫০ টন
ওজনের মূর্তিটি বহনের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত
বহু চাকা বিশিষ্ট বিশেষ
ট্রেইলারে করে হুসেন সাগরের
তীরে নিয়ে আসা হয়।
মূর্তি স্থাপনের জন্য হুসেন সাগরের
মাঝে জিব্রালটার রকে ১৫ ফুট
উঁচু পদ্মবেদী তৈরী করা হয়।
১৯৯০ সালের ১০ই মার্চ তারিখে
মূর্তিটিকে জিব্রালটার রকে স্থাপনের জন্য
একটি বার্জে তোলা হয়। এসময়
ঘটে এক মর্মান্তিক বিপর্যয়-
মূর্তিসহ বার্জটি ডুবে যায়, প্রাণহানি
ঘটে আট জনের। মূর্তির
উদ্ধার প্রচেষ্টায় দুবছর সময় লেগে যায়।
অবশেষে বিপুল প্রয়াসে লেকের তলদেশ থেকে মূর্তি তুলে
জিব্রালটার রকে বেদীর ওপর
স্থাপন করা হয় ১৯৯২এর
এপ্রিলে। আনুষ্ঠানিক উম্মোচন করেন মহামান্য দালাই
লামা ১৯৯৩’র মে
মাসে। এভাবে হুসেন সাগরের বুকে এন টি
রামা রাওয়ের স্বপ্ন ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র
অনুকরণে ‘স্ট্যাচু অব উইস্ডম’ স্থাপিত
হয়। আর হায়দরাবাদ ধন্য
হয় ভারতের সবচেয়ে গৌরব-উজ্জ্বল সভ্যতা
ও ঐতিহ্যের এই মহান স্মারক
ধারণ করে।
লেকের পাড়ে ৭.৫
একর জমির ওপর গড়ে
তোলা হয়েছে বুদ্ধপূর্ণিমা কমপ্লেক্স তথা লুম্বিনী পার্ক।
পার্কের প্রবেশপথে ফুলের ঘড়িটিও অনবদ্য। লুম্বিনী পার্কে রয়েছে আকর্ষণীয় মিউজিক্যাল ফোয়ারা। রাতে নানা বর্ণের
আলোয় ঝর্ণার নাচন খুবই উপভোগ্য।
আমরা যখন হুসেন
সাগরের পারে আসি তখন
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। শারদ
তার গাড়ি হুসেন সাগরের
পার দিয়ে চলা আলোকমালায়
সজ্জিত বৃত্তাকার ‘নেকলেস্
রোড’এ অনেকখানি ঘুরিয়ে
এনে লুম্বিনী উদ্যানে প্রবেশ করান। গাড়ি থেকে নেমে
দেখি, লেকের চারিদিকে আলোর মালা। দূরে
লেকের মাঝে বর্ণময় আলোর
সজ্জায় দণ্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি।
রাতের আলোক সজ্জায় লুম্বিনী
পার্ক ও হুসেন সাগরের
দৃশ্য অনবদ্য। একটুক্ষণ পর পর জিব্রালটার
রকে বুদ্ধমূর্তির ওপর প্রক্ষিপ্ত আলোর
রং বদলায়- বেগুনী, সবুজ, গোলাপী, গেরুয়া, হলুদ। ভিন্ন ভিন্ন রংএর আলোয় বুদ্ধমূর্তিকে
অপরূপ দেখায়। এই দৃশ্য লেখায়
বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। আমরা
লুম্বিনী পার্কে মিউজিক্যাল ফোয়ারা দেখি। আলোর নাচন দেখে
মুগ্ধ হই।
লুম্বিনীপার্কে আলোর ফোয়ারা
লুম্বিনী পার্ক থেকে বুদ্ধমূর্তির দ্বীপে
(জিব্রালটার রকে) যাওয়ার জন্য
রয়েছে ‘বোট-রাইড’ বা
নৌবিহারের ব্যবস্থা। লুস্বিনী পার্ক থেকে বোটে দর্শনার্থীরা
সারাক্ষণ জিব্রালটার-রক দ্বীপে বুদ্ধমূর্তি
দেখার জন্য যাতায়ত করে।
সন্ধ্যার পর সবচেয়ে বেশী
জনসমাগম হয়। আজ শনিবার
বলে ভীড় আরো বেশী।
আমরা দ্বীপে যাবার জন্য একটি লঞ্চে/বোটে উঠি। অতি দ্রুত খোলা বোট
যাত্রীতে পূর্ণ হয়। অল্পক্ষনের মধ্যে
আমাদের নিয়ে বোট রক-দ্বীপে পৌঁছে যায়। নৌবিহারে জিব্রালটার
রকে বুদ্ধমূর্তি দর্শনে যাওয়া একটি অতি রোমাঞ্চকর
অভিজ্ঞতা।
লঞ্চ থেকে আমরা
রক-দ্বীপে উঠি। দেখি, লোকে
লোকারণ্য। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সামনে বর্ণিল আলোয় উদ্ভাসিত দ্বিতল
ভবনের সমান উঁচু বেদীর
ওপর দণ্ডায়মান বিস্ময়কর
বিশাল বুদ্ধমূর্তি দেখে মুগ্ধ, হতবাক
হই। বেদীর গাত্রের ভাস্কর্য-কর্ম অনবদ্য। ভীড়
ঠেলে কোনোরকমে বেদীর চারিদিকে ঘুরে দেখি। দেখি,
জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলে মাথা নুইয়ে
জ্ঞানের প্রতিমূর্তিকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। বোরকা পরা মহিলাদেরকেও দেখলাম
বুদ্ধমূর্তিকে প্রণাম করছে। বেশ কিছুক্ষণ জিব্রালটার
রকে কাটিয়ে আবার বোটে করে
লুম্বিনী পার্কে ফিরে আসি।
হুসেনসাগর বুদ্ধমূর্তি
তারপর আমরা ফিরে আসি আনন্দ বৌদ্ধবিহারে, ড. সঙ্ঘরক্ষিত মহাথেরোর কাছ থেকে বিদায় নিতে। ভন্তে আমাদের জন্য যা করেছেন বলার মতো না। সারাদিনের জন্য গাড়ি, খাওয়া দাওয়া, বিভিন্ন স্থানে প্রবেশের টিকেটের মুল্য, ইত্যাদি সব খরচের টাকা ভন্তে শারদকে দিয়ে রেখেছিলেন। বিশেষ করে অনেক রাত অবধি সারাদিনের জন্য এরকম ব্যক্তিগত গাড়ি না হলে আজকে আমরা ইচ্ছে মতো যা ঘুরেছি, দেখেছি তা ভাড়ার গাড়িতে দুই দিনেও সম্ভব হতো না। তাছাড়া শারদের মতো একজন গাইড পাওয়াও কম ভাগ্যের কথা নয়। ভন্তের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে রওনা দিই। পথে শারদ আমাদের জন্য বিরিয়ানির প্যাকেট কিনে দেয়। হোটেলে পৌঁছে শারদকে বিদায় দিই। শারদের সাথে হয়তো জীবনে আর কোনোদিন দেখা হবে না, কিন্তু আজ আমাদের জন্য যা করেছে তা চিরকাল মনে থাকবে।
জিব্রালটার রকে বুদ্ধমূর্তির চত্বর
লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী জ্যোতি বিকাশ বড়ুয়া
ইমেইলঃ baruajb43@yahoo.com
0 Comments