Hot Posts

6/recent/ticker-posts

Ad Code

দান

 


দান: দাতা ও গ্রহিতা উভয়ই সমান

ভদন্ত মাস্টার শিং য়ুন

 

 

বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারিগণ ছয়টি পারমী (মহাযান বৌদ্ধধর্ম: দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য, সমাধি ও প্রজ্ঞা) এর অনুশীলন করে এজন্য যে, এর মাধ্যমে নিজেকে ও অন্যদের বিমুক্তির পথে ধাবিত করবে। দান হলো প্রথম পারমী, যা আবার তিন ধরনের:

০১। আমিষ দান: আর্থিক বা বস্তুগত দানের ইচ্ছা বা দান

০২। ধর্মদান: সত্য ও ধর্ম দান করা

০৩। অভয় দান: আধ্যাত্মিক সহযোগিতা প্রদান ও অন্যদের ভয়কে কমিয়ে এনে মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করা

এই ত্রিবিধ দান অনুশীলনে এনে দিতে পারে প্রচুর উপকার জীবনে এবং বিমুক্তি এনে দেবে অন্যদেরকেও।

ছয় পারমী ছাড়াও , চার উপায় অনুশীলনের দ্বারা সবাইকে আপনত্বের এক অকৃত্রিম বন্ধনে আবদ্ধ করে। এই চারটি উপায় হলো  দান, প্রিয়বাক্য, অর্থচর্যা, সমানর্থতা বা সহৃদয়তা। এখানেও দান চর্যা প্রথমে রাখা হয়েছে। তাই, ধর্মচর্চার সর্বাগ্রে হলো দান, এটি সুন্দর একটি পথ যার মাধ্যমে আমরা একে অপরের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। দানের মাধ্যমে মানুষরা জানতে আগ্রহি হয় বুদ্ধধর্মকেও।

যাহোক, দান করার আগে প্রাক কিছু বিষয় থাকতে হয়। যেমন দাতার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন গ্রহীতার। অধিকাংশ মানুষই দেখে থাকে, দাতাকে উন্নত মনের মানুষ হিসেবে গ্রহীতার চেয়ে। কারণ, দেখা যায় দ্বিতীয়জনই বেশী উপকৃত হয় বেশী প্রথমজনের চেয়ে। তদুপরি, এটা দেখা যায় যে দাতা অনেক বেশী সামর্থ্যবান দ্বিতীয়জনের চেয়ে। বুদ্ধের ধর্ম অনুসারে, এটা একটা ভুল ধারণা কেননা বুদ্ধ বলেছেন, দাতা ও গ্রহীতা সমান আনিশংস লাভী হন এবং দাতা ও গ্রহীতা উভয়ই পুণ্যবান।

একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। ধরুন, প্যাট্রিক জনকে খাবারের জন্য নিমন্ত্রণ করলো। জন এলো ও খেলো খুব ভালোভাবে আর ধন্যবাদ জানালো প্যাট্রিক জনকে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে এসেছে বলে। এতে কী বোঝা যায় না যে গ্রহীতাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ? ঠিক তদ্রুপভাবে, পুণ্য লাভের আশায় দাতারা ভিক্ষুসংঘকে দান করেন, দাতারা শুধু দান দিয়ে পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে না, উনারা গ্রহীতাদের দান গ্রহণের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। যখন এটি ঘটে, দেখবেন দাতারা গ্রহীতাদের দান গ্রহণের জন্য হাতজোড় করে প্রত্যেকের কাছে গিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন দান করার সুযোগ দেয়ার জন্য। এজন্যই দাতা ও গ্রহীতা উভয়ই সমানভাবে পুণ্যবান।

বর্তমান সময়ে মানুষদের মধ্যে দান নিয়ে ভুল দৃষ্টিভঙ্গী দেখা যাচ্ছে। তারা বিশ্বাস করে যে দাতাই হলো শ্রেষ্ঠ এবং গ্রহীতাকে অবশ্যই দাতার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। এ দৃষ্টিভঙ্গী বুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে মিলে না। যখন কেউ একজন দান দিতে আগ্রহী হন, ঠিক অনুরূপভাবে, গ্রহীতাকেও দান গ্রহণের জন্য আগ্রহী হতে হয়। যদি এমন হয় যে দাতা দান করতে আগ্রহী, গ্রহীতা গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়, তাহলে দান সম্পাদন করা যায় না। বুদ্ধের ধর্মে দানের জন্য যে অনুশাসন দেয়া হয়েছে, তাহলো যে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে একে অপরের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সেজন্য দানে থাকে যুগপৎ শ্রদ্ধা ও সম্মান, নিজে ও অন্যদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকে না।

‘ডায়মন্ড সূত্র’ অনুসারে, দান অনুশীলনে প্রয়োজন তিনটি বিষয়-দাতা, গ্রহীতা ও দানীয় বস্তু-শূন্যতায় অবস্থিত (abiding in emptiness)। যে কোন জন এই তিনটি বিষয়ে ভেদাভেদ ও অনুরক্তি (attachment) দেখানো উচিত নয়। অন্য ভাবে বললে, দাতাকে দেখানো উচিত নয় অনুরক্তি ও নিজেকে নিয়ে চিন্তা করা যে সামর্থ্যবান দাতা হিসেবে। অধিকন্তু, তিনি না করবেন চিন্তা গ্রহীতাদের নিয়ে যারা ভাববেন যে তিনি তাঁদের প্রতি পছন্দ প্রকাশ করছেন, তিনি দানীয় বস্তুর প্রতি অনুরক্তি দেখাবেন না এবং এগুলোর মূল্য নিয়ে। এ ধরনের দান হবে শুধু জাগতিক দান এবং এটা বুদ্ধের ধর্মের মতো হয় না। এমনকি সামাজিকতায়ও ধন্যবাদ জানানো এটা এক ধরনের প্রত্যাশিত সৌজন্যতা, যা বৌদ্ধ ধর্মের শূন্যতা দর্শনের সঙ্গে মিলে যায়।

২০০৮ সনে চীনের সিচুয়ানে (Sichuan) ভূমিকম্প হয়। ৯০০০০ এর মতো মানুষ মারা যায়, কয়েক মিলিয়ন মানুষ মারাত্মক আঘাত প্রাপ্ত হয় আর ক্ষয়ক্ষতি তো হয় বিশাল। আমি দুটি স্কুল, দুটি হাসপাতাল, বায়াত্তরটি এমবুলেন্স, এবং অন্যান্য সামগ্রী ফু গোয়াং সান (FO GUANG SAN) সংস্থার পক্ষ হয়ে সিচুয়ানে দান করি। এসব পেয়ে এলাকার মানুষরা কৃতজ্ঞতা জানায় ও আমাকে কিছু বলতে অনুরোধ করে।

 দাঁড়ানো হাজার মানুষের সামনে আমি বলি, “প্রিয় সিচুয়ানবাসীগণ, আমি এখানে এসেছি কিছু দান করার জন্য নয়, এসেছি আপনাদের দয়া ও করুণার ঋণ শোধ করতে।“ কেন আমি এটা বলেছি? সিচুয়ান ছিল আমার বেড়ে ওঠার স্মৃতিময় দিনগুলোর স্থান। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, এখানেই আমার অনেক প্রিয় কবির জন্মস্থান এই সিচুয়ানে। সেই কবিরা হলেন ডু ফু ( Du Fu), লি বাই ( Li Bai), এবং সু ডুং ফু ( Su Dong Pu)। তাদের কবিতাগুলো আমার সাহিত্য চেতনাকে গড়েছে, করেছে সমৃদ্ধ । আমি তাদের কাছে চিরদিনের জন্য কৃতজ্ঞ। তাছাড়াও, আমার তারুণ্য বয়সে এই সিচুয়ানের গর্বিত জন গোয়াং য়ানচাং (Guang Yanchang) এর কর্ম, আচার-আচরণ ও প্রজ্ঞা আর উনার ‘ওট অব দা পীচ গার্ডেন( Oath of the Peace Garden)’ এর দ্বারা আমি খুব প্রভাবিত হই। এছাড়াও, কতো যে বিনিদ্র রজনী কেটেছে জুগে লিং (Zhyge Liang) এর কৌশলগুলো এবং অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর রেকর্ড শিখতে। এগুলো সত্যিকারভাবে ছিল খুবি উৎসাহব্যঞ্জক ও মহা উপকারী আমার জীবনের জন্য।  

সেই দিনগুলোতে ছিল না পড়ার মতো কোন পত্রিকা, দেখার মতো কোন টিভি। সিচুয়ান প্রদেশের ধ্রুব সাহিত্যে ছিল আমার তারুণ্যময় সময়ে নিত্যসঙ্গী। যখন সেই দিনগুলোতে ফিরে যাই, আমি সুস্পষ্ঠভাবে দেখতে পাই, আমার জীবন আসলেই সিচুয়ানের কাছে অসম্ভবভাবে ঋণগ্রস্থ হয়ে আছে!

সেই কারণে, যখন জানতে পারলাম যে সিচুয়ানের মানুষেরা ভূমিকম্পের মতো মহাদুর্যোগে পতিত হয়েছে, আমি ছুটে এসেছি আমার ঋণের কিছুটা শোধ করতে, কৃতজ্ঞতা জানাতে, আমি এখানে আসিনি আপনাদের কাছে ত্রাণ বিতরণ করতে। যদি আমি এখানে আসতাম ত্রাণ বিতরণের জন্য, তাহলে এর মানে হলো আমি নিজেকে আপনাদের চেয়েও অনেক ওপরের মানুষ হিসেবে দেখা দেওয়া এবং আপনাদের চেয়েও আমি অনেক  বড় একজন সেভাবেই দেখা হবে যা বুদ্ধের ধর্মের সঙ্গে একেবারেই যায় না।

 কয়েক দশক ধরে ভিক্ষুজীবন যাপন করছি, আমি এসেছি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতার হৃদয় নিয়ে। আমি চিন্তা করিনি যে সিচুয়ানের ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন, বরং আমি ভেবেছি, আমার প্রয়োজন সিচুয়ানের কাছে আমার ঋণ শোধ করা। আরো আমাকে খুউব ভাবিয়েছে যে সিচুয়ানবাসিরা আমাকে যে দান দিয়েছে সেই দিনগুলোতে, এখন সময় সেই দানের প্রতিদান দেয়া। আমাদের একে অপরের সঙ্গে নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সংযোগ হওয়া উচিত কেননা আমরা একে অপরের সঙ্গে জড়িত, আমরা একে অপরের সঙ্গে দাতা ও গ্রহীতা। আমরা সবাই সমানভাবে পুণ্যভাগ দেয়া নেয়া করি।

এটাই ছিল আমার বক্তব্য। বৌদ্ধধর্মে চর্চায় জোর দেয় যে আত্ম(Self) বলতে কোন ধারণা নেই, আবার অন্য বলতেও কোন ধারণা নেই, এবং দীর্ঘায়ু বলতেও কোন ধারণা নেই। যদি যেকোন জন “অনুরক্তি ছাড়া দান দিতে পারেন, এবং সকল প্রাণীকে মুক্ত করতে পারেন অনাত্মভাবে”, তাহলেই সেইজন সব প্রাণীকে সমানভাবে দেখেন ও সেভাবে আচার আচরণ করেন এবং নিজের জীবনে বুদ্ধের ধর্মকে সত্যিকারভাবেই ধারণ করেন।

[টীকা: ভদন্ত মাস্টার শিং য়ুন এর “BUDDHA-DHARMA: PURE AND SIMPLE (Vol:2) থেকে “Equanimity in Giving and Receiving” লেখাটির অনুবাদ]

 


ভদন্ত মাস্টার শিং য়ুন: মূল চীনের জিয়াংসু প্রদেশের জিয়াংডু গ্রামে ১৯ আগস্ট ১৯২৭ সনে জন্মগ্রহণ করেন। প্রব্রজ্যিত হবার আগে মাকে নিয়ে হারিয়ে যাওয়া বাবাকে খুঁজতে আসেন নানজিং, কিন্তু অসফল হন। ১৯৩৮ সনে প্রব্রজ্যিত হন ১২ বছর বয়সে ও ১৯৪১ সালে উপসম্পদা লাভ করেন। ১৯৪৯ সনে চীনে যুদ্ধের কারণে চীন ছেড়ে তাইওয়ানে চলে যান। ১৯৬৬ সনে তাইওয়ানের কাউসিং (Kaohsing) এ জায়গা কেনেন বিহার নির্মাণের জন্য। এই বিহারেই প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৭ সনে “Fo Guang Shan Buddhist Order” যার মাধ্যমে “Humanistic Buddhism” নামে একটা বৌদ্ধ ধারার কার্যক্রম সূচনা করেন। পরবর্তীতে সংস্থার কার্যক্রম পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

এই মহান গুণী সাংঘিক ধর্মগুরু Fo Guang San বিহারে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ভাষান্তর: রতন জ্যোতি ভিক্ষু

পামডেল, ক্যালিফোর্নিয়া।

সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫

Post a Comment

0 Comments

Ad Code

Responsive Advertisement