Hot Posts

6/recent/ticker-posts

Ad Code

পারমী

পারমী

নারদ থেরো

==============================




“অপরের কল্যাণে কর্ম করুন”- সুত্ত নিপাত।

বুদ্ধত্ব লাভ করে সম্যক সম্বুদ্ধ হবার জন্য বোধিসত্ত্ব দশ পারমী অনুশীলন করেন। সেগুলো হলো দান, শীল, নৈষ্ক্রম্য, প্রজ্ঞা, বীর্য, ক্ষান্তি, সত্য, অধিষ্ঠান, মৈত্রী এবং উপেক্ষা।

চারিয়া পিটক অর্থকথা অনুসারে, দশপারমী গুণধর্ম চর্চা হয় করুণা দিয়ে, কারণ দ্বারা পরিচালিত, স্বার্থপর উদ্দেশ্য দ্বারা অপ্রভাবিত, মিথ্যাবিশ্বাস আর সকল আত্ম-অহংকার অনুভূতির নিষ্কলঙ্কতায়।

একজন বোধিসত্বের কর্মকাণ্ডগুলো সবসময় অত্যন্ত নিঃস্বার্থময়, সকল প্রাণীর প্রতি রাখেন করুণাময় চিত্ত। সীমাহীন মৈত্রীতে ভরা থাকে মন আর অসীমভাবে ছড়ান করুণা নিরবচ্ছিন্নভাবে জন্ম-জন্মান্তর ধরে, চেষ্ঠায় থাকেন দুঃখ দূর করতে, দরিদ্র আর নিম্নশ্রেণী মানুষের জীবনের উন্নতি সাধনে চেষ্ঠায় থাকেন, এবং অসহায়দের সাহায্য করেন সম্ভবপর সব পথে।

তিনি কখনো আত্ম-সুখে আনন্দে থাকেন না যখন তার কম ভাগ্যবান ভাই-বোনেরা থাকেন দু্র্দশায়। দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে তিনি কুণ্ঠিত হন না নিজের খুব ভালোলাগা সম্পদ আত্মত্যাগ করতে-এমনকি নিজ জীবন দিতেও যা ব্যাঘ্র জাতকের কাহিনীতে দেখা যায়।

পরিপূর্ণ করুণাচিত্তে বোধিসত্ব কাজ করেন সকল প্রাণীর কল্যাণ ও সুখের জন্য; যদিও যুক্তিযুক্ত বিবেচনার দ্বারা পরিচালিত হন। সাধারণত তিনি সমস্ত গুণে গুণান্বিত থাকেন, হৃদয় ও মননে উভয়ের উন্নতি করে যা উৎসর্গিত হয় বৃহৎ পরিসরে পৃথিবীর কল্যাণে।

পরের কল্যাণে নিবেদিত বোধিসত্ব ক্ষমতা ও জাগতিক সম্পদে আকাঙ্খিত থাকেন না। তিনি জানেন যে সুনামের যোগ্য হলে তা অনায়াসেই চলে আসবে, সেটার জন্য কেন ছুটতে হবে?

তিনি তাঁর উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণরূপে পরার্থ পরায়নে থাকেন এবং অহংকার কোন ভূমিকা রাখে না তার কাজ-কর্মে।  

“মমেব কতমঞ্ঞন্তু গিহী পব্বজিতা উভো,

মমেবাতিবসা অস্সু  কিচ্চাকিচ্চেসু কিস্মিচি।

ইতি বালস্স সংকপ্পো ইচ্ছা মানো চ বড্ঢতি।“

“গৃহী ও প্রব্রজিত উভয়েই (বিহারের যাবতীয়) কাজ আমার দ্বারা কৃত মনে করুক, সমস্ত কর্তব্যাকর্তব্যে আমারই বশবর্তী হউক-এইরূপে নির্বোধের সঙ্কল্প, আকাঙ্খা ও অভিমান বৃদ্ধি পায়।“ ধম্মপদের ৭৪তম গাথায় দেখিয়েছেন বোধিসত্ত্বের মনে অনুদারতা আর স্বার্থপরতা প্রবেশ করতে পারে না।

 

১। দান পারমী

দান হলো প্রথম পারমী। ইহা দাতাকে দ্বিগুণ আশীর্বাদ প্রদান করে, মনে থাকা স্বার্থপর অকুশল চিত্ত দূরীভুত হয়ে যায়, আর নিঃস্বার্থ পরায়ণতা কুশল চিত্তে ভরে ওঠে।

“যা দেন তা তাকে আশীর্বাদপুষ্ট করে, আবার, যা গ্রহণ করেন তাই তাকে আশীর্বাদপুষ্ট করেন।“

বোধিসত্ত্ব কখনো ভাবেন না গ্রহীতার সত্যিকারভাবে দানীয় সামগ্রীর প্রয়োজন কি প্রয়োজন নেই। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য দান অনুশীলনের মনের গহীনে থাকা লোভকে দূর করা। সেবার আনন্দ, এর গ্রহীতাদের সুখ, এবং দুঃখ দূর হওয়া হলো দানের অন্যান্য আশীর্বাদ।

অতি উত্তম দান চেতনা ছড়াতে তিনি কখনোই ভেদাভেদ করেন না এক প্রাণীর সঙ্গে অন্যদের; কিন্তু তিনি দানে বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন হন। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন মদ্যপায়ি সাহায্য চান, যদি তিনি মনে করেন মদ্যপায়ি তার দান খারাপভাবে ব্যবহার করবেন, বোধিসত্ত্ব কোন দ্বিধাদ্বন্ধ ছাড়া দান দেয়া বন্ধ করেন, কেননা এ ধরনের দানের দ্বারা পারমী পূর্ণ হয় না।

যে কেউ সৎ উদ্দেশ্যের জন্য তাঁর সাহায্য চাইলে তিনি কোন প্রকার আত্ম-মর্যাদার বশবর্তী না হয়ে কিংবা কোন ভান বনিতা ছাড়াই, তিনি দেখান গভীর বাধ্যবাধকতার কিছু করার সুযোগ পাওয়ার জন্য, এবং সুইচ্ছায় আর প্রদান করেন সম্ভবপর সব সহযোগিতা। তারপরও, তিনি কখনো তাঁর কৃতিত্ব দেখান না যে তিনি যে সাহায্য দিয়েছেন অন্য কাউকে, অথবা তিনি গণ্য করেন না যাকে তিনি সাহায্য করেছেন ঋণী হিসেবে। তিনি খুশী হন তাঁর কৃত কুশল কর্মের জন্য, কিন্তু এর থেকে আর কিছুই আশা করেন না। তিনি প্রত্যাশা করেন না কোন প্রতিদান, এমনকি এর থেকে তিনি কোন সুনামের জন্য আশা আকাঙ্খা করেন না।

একজন বোধিসত্ব যদিও সবসময় প্রস্তুত থাকেন সাহায্য সহযোগিতা করতে, খুব কচিৎ তিনি না করেন কারো প্রতি। ব্রহ্মা জাতকে (৩২৩) দেখা যায় যে একদা বোধিসত্ত্ব তাপস জীবন যাপন করতেন আর বসবাস করতেন রাজ উদ্যানে, যেখানে রাজা আর মন্ত্রীরা আসতেন প্রতিদিন দেখা করতে তাদের প্রয়োজনে। বার বছর চলে গেল, কোনদিন তিনি চাননি একজোড়া জুতার, পাতার ছাতা, ছোটখাটো যেকোন জিনিষের।

তাঁর আশ্চর্যজনক এ গুণ দেখে প্রশ্ন করলে, তিনি বিনীতভাবে রাজাকে প্রত্যুত্তর করলেন,

“পঞ্চল মহারাজ, যিনি চান তিনি অজ্ঞান হয়ে কান্না করে,

আর যারা প্রত্যাখ্যান করে তাদের কান্নাই যথাযথ।“

তিনি অন্যদের দান করেন প্রচুর, শ্রেণী, গোত্র, বা বর্ণের পার্থক্য বিবেচনা ছাড়াই, চান না কিছুই প্রতিদানে। তাঁর মনের চারিত্রিক গুণ হলো সন্তোষময় জীবন। 

কৃঞ্চ জাতকে (৪৪০) উল্লেখিত হয়েছে যে দেবরাজ ইন্দ্র বোধিসত্ত্বের ধার্মিক জীবনের উদাহরণে আকৃষ্ঠ হন। তিনি বোধিসত্ত্বের কাছে আসলেন এবং বর প্রার্থনা করতে বললেন। দেবরাজ ইন্দ্রের কথা শোনার পর, তিনি নিম্নরূপ গাথা বললেন:

১। আমি আমার প্রতিবেশীর প্রতি কোনরূপ বিদ্বেষ বা ঘৃণা যেন না করি।

২। আমি আমার প্রতিবেশীর সহায় সম্পত্তি যেন লোভ না করি।

৩। আমি যেন নির্দিষ্ট কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করি।

৪। আমি যেন উপেক্ষা অনুশীলন করি।

এটা শুনে দেবরাজ ইন্দ্রের মন খারাপ হয়ে গেলো কারণ বোধিসত্ত্ব কোন কিছুই বর প্রার্থনা করেনি। আবার অনুরোধ করলো বর প্রার্থনা করতে।

বোধিসত্ত্ব প্রত্যুত্তর করলো:-

“যে বনে আমি বসবাস করি,

যেখানেই একা থাকি,

যেন শান্তি বিনষ্টকারী কোন রোগাক্রান্ত না হই

কিংবা যেনো ধ্যান ভঙ্গ না হয়।“

এটা শুনে দেবরাজ ইন্দ্র বললো, “জ্ঞানী কৃঞ্চ, বর প্রার্থনা করতে গিয়ে খাদ্যাদি কিছুই চাইলেন না, যা চাইছে তা তো তাপস জীবন সংশ্লিষ্ট।“

দেবরাজ ইন্দ্র বললো, ”একটা বর প্রার্থনা করুন।“

বোধিসত্ত্ব উত্তর করলেন,

“দেবরাজ ইন্দ্র, আপনি এক বর ঘোষণা করুন, আমাকে যেন কোন প্রাণী ক্ষতি না করে শরীরে ও মনে, এটাই আমার প্রার্থনা।“

বোধিসত্ত্ব দান পারমী এমনভাবে অনুশীলন করেন তিনি শুধু সম্পদ আর নিজের অধিকারে থাকা সম্পত্তি পরিত্যাগে নিজেকে প্রস্তুত রাখেন না, এমনকি তাঁর রাজ্য, দেহের অঙ্গাদি এবং এমনকি পুত্র-কন্যা এবং সহধর্মিনী পরিত্যাগে প্রস্তুত থাকেন; এবং সবসময় প্রস্তুত থাকেন তাঁর জীবন উৎসর্গের জন্য যেখানেই মানুষের উপকারে সে রকম আত্মত্যাগ প্রয়োজন পড়ে।

বেশ্বান্তর জাতকে (৫৪৭) বোধিসত্ত্বের দান পারমী পূরণের কাহিনী দেখা যায় কিভাবে রাজপুত্র বেশ্বান্তর যখন আট বছর বয়সেই চিন্তা করলেন নির্মল মনে: “যদি কেউ আমার হৃদয় চায়, বুক কেটে সেই হৃদয় নিয়ে দান করবো; যদি কারোর আমার চোখের প্রয়োজন হয়, সেই চোখ তুলে নিয়ে দান করবো; যদি কারো আমার শরীরের মাংস প্রয়োজন হয়, তার যা প্রয়োজন হয় তা দান করবো।“

ব্যাঘ্র জাতকে খুব সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে বোধিসত্ত্ব সুইচ্ছায় ও আনন্দ চিত্তে তারঁ জীবনকে অন্যের মঙ্গল ও সুখের জন্য উৎসর্গ করেছেন। জাতকটি যেভাবে বর্ণিত হয়েছে:-

“এক সময় বোধিসত্ত্ব যখন একটি বন অতিক্রম করছিলেন, সঙ্গে উনার শিষ্যসহ, দেখলেন এক বাঘিনী এবং তার তিন বাচ্চাকে যারা প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি দীর্ঘ সময় উপবাসের কারণে। করুণাময় চিত্তে ভরে উঠল বোধিসত্ত্বের মন এবং শিষ্যকে বললো কিছু খাবার সংগ্রহ করতে তাদের জন্য। পরক্ষণে ভাবলেন এটাতো একটা ভুল চিন্তা:

“কেন আমি আরেক জনের দেহের মাংস সন্ধান করছি যখন আমার দেহে মাংস আছে? আরেক জনের মাংস সন্ধান এটাতো ভাগ্য নির্ভর, আর আমি সুযোগ হারিয়ে ফেলবো একটা কর্তব্য সম্পাদনে। এই শরীরতো অশুচিতে ভরপুর এবং দুঃখের উৎস, তিনি জ্ঞানী হন না যিনি আনন্দিত হন না পরের উপকারে নিজেকে উৎসর্গ করে। দুটি বিষয় মানুষরা ভাবে না অন্যের দুঃখ-দুর্দশা – নিজের সুখে আক্রান্ত থাকে এবং অন্যকে সাহায্য সহযোগিতা করার মানসিকতার অনুপস্থিতি। কিন্তু আমি নিজে আনন্দে থাকতে পারি না যখন অন্যরা দুঃখ-দুর্দশায়, যতক্ষণ সম্ভব হয় আমার দ্বারা সাহায্য করা। তাই আমি কেন নিরপেক্ষ থাকবো?”

 

২। শীল পারমী

অতি উত্তম দান চেতনা সমৃদ্ধ বোধিসত্ত্ব অনুশীলন করেন শীল। পালিতে ‘সীল’ এর অর্থ হলো শৃঙ্খলা। শীল হলো ‘চারিত’ ও ‘বারিত’ এ দুটির সমষ্ঠি। চারিত শীল হলো অবশ্যই সম্পাদন করতে হয় চরিত্র নির্মলতার জন্য আর বারিত হলো যা থেকে বিরত থাকতে হয়। এসব দায়িত্ব সম্পাদন করতে হয় পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বন্ধু, ভিক্ষু-শ্রমণ, অধীনস্থজনসহ প্রমুখদের প্রতি যা ‘সিগালোবাদ সুত্ত’ এ সবিস্তারিত উল্লেখিত হয়েছে।

একজন বোধিসত্ত্ব যিনি সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন করেন গৃহী কর্তব্য। তিনি সত্যিকারভাবে হন একজন বিশুদ্ধ ধার্মিক মানুষ। তিনি এসব বাধ্য বাধকতা গৃহী কর্তব্য ছাড়াও সর্বোচ্চ চেষ্ঠায় থাকেন পালন করতে ‘বারিত শীল’ এবং তাকে আদর্শ বৌদ্ধ হিসেবে পরিণত করেন।

কর্মের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকায় নিজের মঙ্গলময় জীবনের জন্য তিনি নিজেকে অকুশল কর্ম থেকে বিরত রাখেন এবং তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য অনুযায়ী কুশল কর্ম সম্পাদন করেন, মানুষ বা প্রাণীর প্রতি কোন অভিশাপ দেন না, অমঙ্গল কামনা করেন না।

জীবন যেহেতু সবার জন্য সবচেয়ে মূল্যবান এবং কারো অধিকার নেই অন্য কারো জীবনকে মেরে ফেলা, সেজন্য তিনি ছড়ান করুণা ও মৈত্রী প্রত্যেক প্রাণীর প্রতি, এমনকি অতিক্ষুদ্র প্রাণীদের প্রতি যারা দু পায়ে ভর দিয়ে চলে, এবং প্রাণী হত্যা কিংবা যেকোন প্রাণীর হত্যার কারণ থেকে বিরত থাকেন। মানুষের মধ্যে থাকা পশুত্বভাবই নিষ্ঠূরভাবে দুর্বল প্রাণীদের হত্যা এবং তাদের মাংস ভক্ষণ করে। খাবারের জন্য বা আনন্দের জন্য হোক অসহায় প্রাণী হত্যা বা এর কারণকে ন্যায়সঙ্গত বলা যায় না সেটা নিষ্ঠূর কিংবা মানুষ কতৃক হোক। যদি প্রাণী হত্যা কোন খারাপ কর্ম নয়, তাহলে যে কেউ বলতে পারে নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা করাও মহৎ উদ্দেশ্য যখন দেখবে এ রকম দৃশ্য।

বোধিসত্ত্ব সবসময় বিরত থাকেন অদত্ত বস্তু গ্রহণ থেকে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, এবং এভাবেই সততা, বিশ্বস্ততা এবং ন্যায় পরায়নতার উন্নয়ন সাধন করেন। তিনি ব্যভিচার থেকে বিরত থাকেন, যা মানুষকে নিন্মদিকে নিয়ে যায়, তিনি থাকেন পবিত্র এবং সংসার জীবনে থাকেন খুব সৎ। তিনি বিরত থাকেন মিথ্যা, কর্কষ, পিশুন ও সম্প্রলাপ বাক্য কথন থেকে আর বলেন সত্য, সুমধুর, সম্মিলনি আর সহযোগিতাধর্মী বাক্য। তিনি সুরা, মদ নেশাদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন যেসব দ্রব্য মনকে বিশৃঙ্খল ও সংশয়িত করে এবং তিনি সবসময় অনুশীলন করেন স্মৃতি ও সম্প্রজ্ঞান।

বোধিসত্ত্ব পঞ্চশীলকে ধারণ করেন নিজের কায় ও বাক্যকে সংযত করতে, নিজের ইচ্ছের বিপক্ষে হোক বা না হোক। ঠিক সময়ে তিনি শুধু ধন সম্পত্তি পরিত্যাগ করেন না, এমন কি নিজের নীতিধর্মের জন্য জীবনও আত্ম উৎসর্গ করেন।

এটা বোঝা উচিত যে বোধিসত্ত্ব সংসার পরিভ্রমণের সময় ধর্মানুকূল জীবনেই থাকেন। গৃহী হওয়ায় তিনি জানেন নিজের ব্যর্থতা আর সীমাবদ্ধতা। কণবের জাতকে (Kanavera Jataka 318 ) দেখা যায় বোধিসত্ত্ব দুধর্ষ ডাকাত ছিলেন। যাহোক, এটিই একমাত্র ব্যতিক্রম বোধিসত্ত্ব সংসারে পরিভ্রমণে লঙ্ঘিত শীলময় জীবন।

সম্যক সম্বুদ্ধ হওয়ার জন্য যে অভিপ্রায় গ্রহণ করেন বোধিসত্ত্ব আর শীলময় জীবন যাপন করতেন ‘শীলমীমংশ জাতকে’ বলতে দেখা যায়: “শীল ছাড়া প্রজ্ঞার কোন মূল্য নেই।“


 ৩। নৈষ্ক্রম্য পারমী

একজন বোধিসত্ব প্রদর্শন করেন নৈষ্ক্রম্য কেননা প্রকৃতিগতভাবে তিনি নির্জনতা প্রিয়। নৈষ্ক্রম্য দুটি বিষয়কে বোঝায় ১। জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে পরিত্যাগ করে সন্ন্যাস জীবন ধারণ ২। ধ্যানের দ্বারা পঞ্চ নীবরণকে সাময়িকভাবে দূর করা

একজন বোধিসত্ত্ব না হন স্বার্থপর না হন বিষয় অধিকারি। তবে তিনি হন তাঁর কর্মে নিঃস্বার্থবান মহানজন। তিনি সদা প্রস্তুত থাকেন পরের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য, এমনকি জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হন না। হয়তো তাঁর যাপিত জীবন বিলাসিতাময় প্রাচুর্য্য, জাগতিক আনন্দ উল্লাসে সমর্পিত, তারপরও তাঁর মধ্যে জানা থাকে এসবের ক্ষণস্থায়িত্ব স্বভাব আর নৈষ্ক্রম্যতার মহামূল্যতা।

উপলব্ধিতে আসে নশ্বর বৈষয়িক আনন্দ-সুখ, তিনি স্ব-ইচ্ছায় পরিত্যাগ করে জাগতিক সহায় সম্পদ এবং সাদাসিদে গৈরিক বসনে নিজেকে আচ্ছাদিত করেন, এবং অবিরত চেষ্ঠায় থাকেন সন্ন্যাস জীবনের পবিত্রতা সুরক্ষা করতে। তিনি অধিশীলে অনুশীলনে থাকেন যা তাঁকে নিয়ে যায় সর্বক্ষেত্রে এক নিঃস্বার্থবান জনে। কোন সুনাম, সম্পদ, সম্মান, বা জাগতিক অর্জনের পেছনে উনি ছুটেন না, সন্ন্যাস জীবনের নিয়ম নীতির বিরুদ্ধে কোন কিছুতেই জড়ান না।

মখাদেব জাতক দেখায়, বোধিসত্ত্ব বুঝে ওঠে যখন প্রথম সাদা চুলটি দেখে, সময়টি হয়েছে ঝামেলাপূর্ণ রাজ্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া আর স্বাধীন আনন্দময় নির্জন জীবন করা। আবার, ঝড়ে পড়া শিশির বিন্দু বা পাতা দেখেও বুঝে যান অনিত্য এই সংসার আর বেছে নেন সন্ন্যাস জীবন। নিয়ম অনুযায়ি, বোধিসত্ত্ব সংসার যাত্রায় মহাভিনিষ্ক্রমণ করেন না।

কুশ জাতকে (৫৩১) দেখা যায়, বোধিসত্ত্ব ছিলেন অত্যন্ত হাহাকার অপূর্ব সুন্দরী রাজকন্যা প্রভাবতীকে জয় করে জীবনসঙ্গিনী করতে।

আবার, দরিমুখ জাতকে (৩৭৩) উল্লেখিত হয়েছে যে এক পচ্চেক বুদ্ধ ছিলেন বোধিসত্ত্বের বন্ধু। 

 

বুদ্ধ শূন্য চক্রে বোধিসত্ত্ব সন্ন্যাসজীবন ধারণ করেন না এবং নির্জন ব্রহ্মচর্য জীবন যাপন করেন না। যদি বুদ্ধ চক্রে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি ভিক্ষু জীবন ধারণ করেন আর কঠোরভাবে শীল-বিনয় পালনে রত থাকেন। একজন আদর্শবান ভিক্ষু যিনি উদাহরণীয় জীবনযাপন করেন, তিনি যেমন হন নিজের জন্য আশীর্বাদ আর ঠিক অপরের জন্যও। তিনি শিক্ষা দেন উদাহরণ হয়ে এবং শীলানুশীলনে।

নিজের ভেতর যেমন পরিশুদ্ধ করে তোলেন, বাইরেও পরিশুদ্ধ করে তোলেন।

তিনি নিজেকে নিবেদিত করে তোলেন তাঁর নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য, একই সময়ে তিনি সহযোগিতা করেন ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী, উপাসক-উপাসিকাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রয়োজনের চারি-প্রত্যয়। তিনি সমাজের জন্য ভার হন না কারণ তিনি কাউকে সমস্যায় ফেলেন না। তিনি হলেন ঠিক মৌমাছির মতো, ফুলকে কোনরূপ ক্ষতি না করে মধু সংগ্রহ করে। তিনি কোন সম্পত্তি রাখেন না কেননা তিনি জাগতিক সবকিছু পরিত্যাগ করেছেন। তার প্রয়োজন খুবি অল্প, এবং সন্তুষ্টি হলো তার সম্পদ। তিনি অতীতের জন্য অনুশোচনা করেন না, না ভোগেন দুঃশ্চিন্তায় ভবিষ্যতের জন্য। তিনি সবসময় বর্তমানে থাকেন, সাংসারিক সব দায়-দায়িত্বমুক্ত। তিনি সর্বদা প্রস্তুত থাকেন চলে যেতে সেখানে যেখানেই মানুষের জন্য ভালো কিছু করা যাবে, কেননা তিনি থাকেন অনাসক্ত কোন আবাসের প্রতি। অষ্ট লোকধর্মময় জীবনে তিনি সুরক্ষা করেন এক ভারসাম্যময় মন। তাঁর নিঃস্বার্থ সেবা সবসময় থাকে অন্যের সুখ-শান্তির জন্য নিবেদিত।

‘পরিব্রাজক’ বলা হয় তাদের যারা অন্য ধর্মের মতাবলম্বী সন্ন্যাসী যেমন আজীবক। ‘ভিক্ষু’ শব্দটি হলো যিনি বুদ্ধের ধর্মকে ধারণ করেছেন।

বিনয় বিধান করা হয়েছে একজন ভিক্ষু অন্যের কারো কাছ থেকে ভিক্ষা চাইতে পারবেন না। তবে তিনি চারি প্রত্যয়- চারি প্রত্যয়: চীবর, পিণ্ডপাত, শয়নাসন, ওষুধ প্রতিগ্রহণ করতে পারবেন। যদি প্রয়োজন হয়, তাকে অনুমতি দেয়া হয়েছে তার মাতা-পিতা, ঘনিষ্ট আত্মীয়, প্রত্যয় দানে ইচ্ছুক ব্যক্ত দাতাদের বলতে।

একজন ভিক্ষু আজীবন ভিক্ষু জীবন ধারণের জন্য বাধ্যবাধকতা নেই। তিনি নিজের ইচ্ছায় পবিত্র ভিক্ষু জীবন যাপনের জন্য প্রবেশ করেন, আবার যদি চান ভিক্ষু জীবন ছেড়ে দিয়ে গৃহীজীবনে ফিরেও যেতে পারেন। যখন পূত পবিত্র কাষায়বস্ত্র ধারণ করেন, তিনি বাধ্যবাধকতায় থাকেন, শীল-বিনয় প্রতিপালনে।

অত্যুত্তম পবিত্র জীবন যাপনে এবং নিঃস্বার্থ দেব-মানবের হিতে কল্যাণব্রতী হতে, শান্তভাবে মনকে নিয়ন্ত্রণ ও পবিত্র করতে, যথাভূত জ্ঞানদর্শন করতে, সঠিক ও গভীরভাবে চিন্তা করতে, মনুষ্যত্বকে উঁচু জায়গায় নিয়ে যেতে, পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক জীবনের মূল্যকে প্রশংসা করতে, ভিক্ষুজীবনের মতো এমন সুযোগ ও সুবিধাময় জীবন আর অন্য কোন জীবনে নেই।

একজন ভিক্ষু হয় ধ্যান সাধনাময় জীবন কিংবা শাস্ত্র অধ্যায়নময় জীবন ধারণ করতে পারে। তবে ধ্যান সাধনাময় জীবন হলো প্রশান্তিময় গৈরিক জীবন, যে জন্য কাষায় বস্ত্র ধারণ করা হয়, যে কাষায়বস্ত্র প্রতীক হিসেবে দেখা হয় সাধু/সন্ত আর সুবিনীত জীবন, যা আবেগ সমূলে দূর করে দেয় এবং পরম শান্তি নির্বান লাভ করায়।

 

৪। প্রজ্ঞা পারমী

নৈষ্ক্রম্য প্রজ্ঞার দ্বারা আসে। এটি হলো অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম এর আলোকে পৃথিবীর প্রকৃতিকে সঠিকভাবে বোঝা। বোধিসত্ত্ব ভাবনা-সাধনা করেন এই ত্রিলক্ষণের ওপর, তবে সেই অনুশীলনটা অরহত্ব ফল লাভ করায় না, কেননা তিনি বোধিসত্ত্ব হিসেবে পারমীসমূহ পূর্ণ করেছেন।

একই সময়ে তিনি জাগতিক প্রজ্ঞাকেও খারাপভাবে দেখেন না। তিনি চেষ্ঠায় থাকেন জ্ঞান অর্জন করতে এমনকি তার কর্মচারিদের থেকেও। তিনি কখনো দেখান না তার আকাঙ্খা মানুষকে তিনি অনেক জ্ঞানের অধিকারি, তিনি স্বীকার করেন সবার সামনে যা জানেন না। যেকোন পরিবেশে তিনি চেষ্ঠা করেন না তিনি খুবি জ্ঞানী মানুষ। তিনি যা জানেন সবসময় অপরকে জানাতে প্রস্তুত থাকেন, এবং তিনি অন্যদের জানিয়ে দেন সংরক্ষণ না করে। তিনি অবিরত চেষ্ঠায় থাকেন মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসতে।

জ্ঞান তিন প্রকারের। প্রথমটি হলো মুখস্ত করা জ্ঞান (শ্রুতময় প্রজ্ঞা)। প্রাচীনকালে যখন ছাপানো কিছু ছিল না, জ্ঞানার্জন করতো শুনে, আর যে মানুষটি প্রচুর জ্ঞানের অধিকারি হতো ‘বহুশ্রুত’ (যিনি অনেক শুনেছেন। দ্বিতীয় ধরনের জ্ঞান হলো চিন্তাময় জ্ঞান যা অর্জিত হয় চিন্তার মাধ্যমে (চিন্তাময় প্রজ্ঞা)। পাশ্চ্যত্যের কার্যকরি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান চিন্তাময় প্রজ্ঞারই প্রত্যক্ষ বহিঃপ্রকাশ। তৃতীয় জ্ঞানটি হলো সর্বোত্তম জ্ঞান যা আসে ধ্যানের ও ভাবনা  মাধ্যমে। এটিকে বলা হয় ভাবনাময় প্রজ্ঞা। এই জ্ঞান আসে সেই ভাবনা সাধনার দ্বারা যিনি আধ্যাত্মিক সত্যকে জেনে ধারণ করেন, সেই জ্ঞান কিন্তু যুক্তিগ্রাহ্যতার বাইরে। ভাবনা কোন চিন্তায় হারিয়ে যাওয়া নাহ, এটি হলো বীর্যময় প্রচেষ্ঠা যা নিয়ে যায় অনুশীলনকারিকে অতি উচ্চ পর্যায়ের আধ্যাত্মিক উন্নতিতে: আত্ম-শৃঙ্খলায়, আত্ম-নিয়ন্ত্রণে এবং আত্ম-আলোকিত জীবনধারায়। এটা হৃদয়ের টনিকও বটে।

প্রজ্ঞাই হলো বৌদ্ধধর্মের সর্বোত্তম অবস্থা। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের প্রথমটি সম্যক দৃষ্টি যা প্রজ্ঞার অংশ। সপ্ত বোধ্যঙ্গের মধ্যে ধর্মবিচয় হলো প্রজ্ঞার অন্তর্গত। চারি ইদ্ধিপাদের মধ্যে বিমংসা ইদ্ধিপাদ হলো প্রজ্ঞা। পঞ্চবল ও পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মধ্যেও এটি বিদ্যমান। প্রজ্ঞাই ধাবিত করে পরিশুদ্ধময় জীবন গড়তে আর পরম বিমুক্তিতে পৌঁছতে।

৫। বীর্য পারমী

প্রজ্ঞার সঙ্গে যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তা হলো বীর্য। এখানে বীর্য মানে শারীরিক শক্তি নয় যদিও এ শক্তি সম্পদ, কিন্তু বীর্য হলো মানসিক শক্তির ধারক যা শারীরিক শক্তির চেয়েও শক্তিশালি। এটি হলো অবিশ্রান্ত প্রচেষ্ঠা চিন্তা ও কাজের মাধ্যমে অপরের কল্যাণে কাজ করতে। নিজের বীর্য ধর্মের প্রতিষ্ঠা করে বোধিসত্ত্ব নিজেকে করে তোলেন আত্ম নির্ভরশীল এবং এক প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে তৈরী করেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় বোধিসত্বের বীর্যগুণ প্রকাশ পেয়েছে:

‘বিপদে মোরে রক্ষা করো,

এ নহে মোর প্রার্থনা,

বিপদে আমি যেনো না করি ভয়।‘

মহাজনক জাতকে (৫৩৯) অত্যন্ত নিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে বোধিসত্ত্বের বীর্যগুণ। গভীর সমুদ্রের জাহাজ ডুবে গেলে ক্রমাগত সাতদিন সাঁতার কাটলেন তীর পেতে। তিনি এতটুকুন আশা ছাড়লেন না যতক্ষণ না নিজেকে উদ্ধার করতে পারলেন ভীষণ এ বিপদ থেকে।

ব্যর্থতাকে তিনি দেখতেন সাফল্যের একধাপ হিসেবে। বাধাগ্রস্থতা তাঁকে করে তুলতেন দ্বিগুণ শক্তিশালী, যেকোন বিপদ সাহসী করে তুলতো তার উত্তরণে। নানা সমস্যা যা সাহসকে দু্র্বল করে, সেগুলোকে অতিক্রম করেছেন, পর্বতসম বাধা যা সাধারণ হৃদয়কে থামিয়ে দেয়, কিন্তু সেসব বাধাকে অতিক্রম করে লক্ষ্য পৌঁছার চেষ্ঠার স্থির প্রচেষ্ঠায় থাকতেন। কখনোই তিনি থামতেন না যতক্ষণ না লক্ষ্যে পৌঁছতেন।

মার বারবার বোধিসত্ত্বকে অনুরোধ করতেন ধর্মসত্য সন্ধানকে পরিত্যাগ করতে আর তিনি বলতেন , “মোহ/আবেগ-এর সঙ্গে যুদ্ধের মৃত্যুকে আমি মনে করি অধিকতর সম্মানজনক পরাজিত জীবনের চেয়ে।“

ঠিক যেমন তাঁর প্রজ্ঞা সবসময় পরিচালিত করতো অপরের কল্যাণ সাধনে নিবেদিত হতে, ঠিক তদ্রুপ এটি শক্তির ভান্ডার। একে ব্যক্তিগত উপলব্ধির সমাপ্তিতে নিয়ে যাবার সীমায়িত চিন্তায় সংজ্ঞায়িত করার পরিবর্তে, তিনি পরিচালিত করেন একে খোলাখুলি কার্যক্রমে যা বয়ে আনে বৈশ্বিক সুখশান্তি। অশেষ ও অবিশ্রান্তভাবে তিনি কাজ করে যান অপরের জন্য, আশা করেন না কোন প্রতিদান এর বিনিময়ে। তিনি সবসময় প্রস্তুত থাকেন তাঁর সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিতে মানুষের জন্য।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রজ্ঞার চেয়েও বীর্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে লক্ষ্য অর্জনে। যিনি আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গযুক্ত জীবনে ধাবিত হয়েছেন তিনি সম্যক ব্যয়ামের দ্বারা উৎপন্ন অকুশলকে দমন করেন, অনুৎপন্ন অকুশলকে উৎপন্ন হতে দেয় না, অনুৎপন্ন কুশলকে উৎপন্ন করে আর উৎপন্ন কুশলকে সবসময় অনুশীলন করে। সপ্ত বোধ্যঙ্গের মধ্যে ‘বীরিয় বোধ্যঙ্গ’ একটি, চারি ইদ্ধিপাদের মধ্যে ‘বীরিয় ইদ্ধিপাদ’ একটি। চারি সম্মাপ্রধানে বীর্য হলো মৌলিকভাবে কাজ করে। এটি পঞ্চবলের একটি এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের একটি।

এজন্য বীর্যকে গণ্য করা হয় কর্মকর্তা হিসেবে যিনি নয়টি কার্য সম্পাদন করেন। বীর্য প্রজ্ঞার সঙ্গে যুগপৎ হয়ে কার্যক্রমে রত হয়, যা শক্তিশালি হাত হয়ে দুঃখময় সংসার থেকে বিমুক্ত করে চিরশান্তি নির্বাণ সাক্ষাৎ করায়।

৬। ক্ষান্তি পারমী

বীর্য পারমীর মতো ক্ষান্তি পারমীও খুবি গুরুত্বপূর্ণ। এটি হলো ধৈর্যশীল সহনশীল চারিত্রিক গুণে গুণান্বিত হওয়া যা অন্যের দ্বারা প্রদেয় দুঃখের প্রচণ্ড কষ্ট পাওয়ার সময়, এবং অন্যের ভুলের কারণে সৃষ্ট দুঃখ কষ্টকে সহ্য করা।

একজন বোধিসত্ব ক্ষান্তি পারমী এমনভাবে অনুশীলন করেন তিনি একটুও কুপিত হন না হাত-পা ছেদন করলেও। ক্ষান্তিবাদী জাতকে (৩১৩) বোধিসত্ত্ব শুধু দেখাননি নিষ্ঠূর মদ্যপায়ি রাজার দেয়া তীব্র কষ্ট-যন্ত্রণার আনন্দময় সহনশীলতা, যে রাজা আদেশ দিয়েছিলেন বোধিসত্ত্বের দু’হাত, দু’পা, নাক, কান কেটে ফেলার। তিনি ফিরে পান সমস্ত আঘাতগ্রস্থ শরীর ধর্মশক্তির দ্বারা।

মাটিতে পড়ে আছেন বোধিসত্ত্ব, রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, তিনি বললেন, “মহারাজ দীর্ঘজীবি হোন, যিনি নিষ্ঠূর হাতে আমার দেহকে টুকরো টুকরো করছেন। আমার বোধিচিত্তে এধরনের কর্মকে রাগ-দ্বেষ-দিয়ে কখনোই প্রকাশ করে না।“

অসীম ধৈর্য নিয়ে সহ্য করেছেন বোধিসত্ত্ব আর বলা হয় যে যখনই তিনি নিষ্ঠূরতার স্বীকার হচ্ছেন; তিনি চিন্তা করছেন সেই নিষ্ঠূর রাজার কর্মকাণ্ডকে এভাবে,

“এই ব্যক্তিতো আমার মতো একজন মানুষ, সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে হোক, আমি নিজে তো প্রতিশোধের কারণ হতে পারি না, বা এটা হয়তো আমার অতীতের অকুশল কর্মের ফল। যেহেতু এটা আমার নিজের কর্মের বহিঃপ্রকাশ, কেন আমি রাগান্বিত হবো তাঁর প্রতি?”

উল্লেখ করার বিষয় হলো বোধিসত্ত্ব কখনোই উত্তেজিত হন না, যেকোন মানুষের নির্লজ্জ আচার আচরণে।

বুদ্ধ শিষ্যদের ক্ষান্তি অনুশীলন কিভাবে করতে হবে তা ককোচুপম সূত্রে দেখিয়েছেন:

“যদি মহাসড়কে থাকা শক্তিমান ডাকাতরা করাতের দুপ্রান্ত ধরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছেদনও করে, তারপরও যদি তোমার মন ক্রোধ পরায়ন হয় তাহলে বুঝবে, তুমি আমার ধর্মের অনুসারি নও।“

“এভাবে নিজেকে নিজে ধর্মানুশীলনে নিয়োজিত হবে: আমার মন নির্মল হয়ে থাকবে। কোন খারাপ শব্দ আমার মুখ থেকে যেনো বের না হয়। মৈত্রীময় চিত্তে যেন থাকে মৈত্রী ও করুণা, হিংসা নিয়ে যেন আমরা না থাকি, এসব ডাকাতদের প্রতি যেন মৈত্রী পরায়ন থাকি। এবং তাদের থেকে এতো কষ্ট পাওয়ার পরও আমাদের মন এই ভাবনায় এগিয়ে থাকুক, আমরা মৈত্রীময় চিন্তাযুক্ত যা বিশাল, অমূল্য, অপরিমেয়, কল্যাণময় ও একতাময় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেবো।“

অপরের কুৎসিৎ কর্মকাণ্ড দেখার পরিবর্তে ধৈর্য ও সহনশীলতা অনুশীলনের মাধ্যমে একজন বোধিসত্ত্ব সবসময় চেষ্ঠা করেন সবকিছুর মধ্যে ভালো ও সু্ন্দরকে দেখার।

 

৭। সত্য পারমী

সত্য পারমী হলো সপ্তম পারমী। এখানে সত্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে যিনি প্রতিজ্ঞা পরিপূর্ণ করেছেন। এটি বোধিসত্ত্বের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ঠ্য, কারণ তিনি কখনো বাক্য ভঙ্গ করেন না। যা করেন, তাই বলেন, যা বলবেন তাই করেন (যথাবাদি তথাকারি, যথাকারি তথাবাদি)।

হারিত জাতক (৪৩১) অনুসারে, বোধিসত্ত্ব সংসারে পরিভ্রমণ করছেন, তিনি কখনোই ৪র্থ শীল ভঙ্গ করেননি, যদি অন্য ৪টি শীল কখনো কখনো লঙ্ঘন করেছেন।

নিজেকে শিষ্ট দেখাতেও কখনো সত্যকে লুকিয়ে রাখেননি।

সত্যকে করেছেন পথ প্রদর্শক হিসেবে, এবং ধারণ করেন অবধারিত কর্তব্য হিসেবে তার বাক্যকে সৎ রাখতে। তিনি কোন কিছুর প্রতিজ্ঞা করা বা প্রতিশ্রুতি দেবার আগে গভীরভাবে ভাবেন, আর যখন একবার প্রতিজ্ঞা করবেন তা তিনি যেভাবেই হোক পূরণ করে ছাড়বেন।

হ্রী জাতকে (৩৬৩) দেখা যায় বোধিসত্ত্ব উপদেশ দিয়েছেন।

আবার, মহা সূতসম জাতকে (৫৩৭) দেখা যায় যে প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে নিজেকে প্রস্তুত রেখেছিলেন জীবন উৎসর্গ করতে।

একজন বোধিসত্ত্ব হন বিশ্বস্ত, সহানুভূতিশীল এবং সৎ। যা চিন্তা করেন, তাই বলেন। তাঁর চিন্তায়, কথাবার্তায় ও কাজে থাকেন সঙ্গতিপূর্ণ।

তিনি যা কিছু করেন থাকেন অবিচলিত ও সোজাসাপটা। যেহেতু তিনি ধারণ করেন ন্যায় পরায়ন জীবন তাই কখনোই কপটতা করেন না। উনার ভেতরের রূপ আর বাইরের রূপের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। তাঁর ব্যক্তি জীবন সবসময় সবার জীবনের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় সত্যশীলতার কারণে।

তিনি কখনোই তোষামোদি হন না অন্যদের মন পেতে, তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেন না বাহবা পেতে, কখনো লুকান না নিজের অপরাগতাকে বা নিজের মধ্যে যা নেই তা শুধু শুধু দেখান না। যা প্রশংসাযোগ্য তিনি করেন মনে কোন অপ্রীতিকর ভাব না রেখেই, আর দোষেরযোগ্য ব্যক্তিকে তিনি দোষী বলেন বিচারিক জ্ঞান দিয়ে, তিনি কখনোই ঐ ব্যক্তিকে অবজ্ঞা বা ঘৃণার চোখে দেখেন না, বরং ঐ ব্যক্তির প্রতি তা করেন করুণাচিত্ত দিয়ে।

তিনি সবসময় সব সত্য উচ্চারণ করেন না। যে সত্য উচ্চারণে নিয়ে আসে না অনেকের মঙ্গল ও সুখ, আর তখনই তিনি থাকেন নীরব। যদি তিনি দেখেন যেকোন সত্য অন্য সবার জন্য বয়ে আনে উপকার, তিনি সেটা নির্ধিদ্বায় উচ্চারণ করেন, এমনকি সেই উচ্চারণে নিজের ক্ষতি আনলেও। এবং তিনি অন্যদের কথাবার্তাকে সম্মান করেন ঠিক যেমন নিজের কথাকে সম্মান করেন।

৮। অধিষ্ঠান পারমী  

সত্য পারমী অনুরিত হয় অধিষ্ঠান পারমীর দ্বারা। অধিষ্ঠান পারমীর সুদৃঢ়তা ছাড়া অন্যান্য পারমী পূর্ণ করতে পারে না। এটাকে বিল্ডিং এর ভিত্তির সঙ্গে তুলনা করা যায়। এই ইচ্ছা শক্তি ক্ষমতা বোধিসত্ত্বের সামনে আসা সমস্ত বাধাবিঘ্ন দূর করে দেয়, এবং কোন ব্যাপারই নয় তার সামনে যাই আসুক নাহ: অসুস্থতা, শোক, বা বিপর্যয়-তিনি তাঁর লক্ষ্য থেকে চোখকে সরান না।

উদাহরণস্বরূপ, বোধিসত্ত্ব গৌতম সুদৃঢ় সংকল্প করলেন তাঁর রাজকীয় ভোগৈশ্বর্য পরিত্যাগ করবেন এবং বোধিজ্ঞান লাভী হবেন। সেজন্য সুদীর্ঘ ছয় বছর ধরে অতিমানুষিক সংগ্রাম চালিয়েছিলেন তিনি। তাঁকে সইতে হলো বহুমুখি কষ্ট এবং মুখোমুখি হতে হলো অসংখ্য কঠিন অবস্থার। এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যখন তাঁর খুব সাহায্যের প্রয়োজন, তাঁর পাঁচজন শিষ্য তাঁকে ছেড়ে চলে গেলেন। এরপরও তিনি তাঁর প্রচেষ্ঠা থামিয়ে দেননি। বরং তাঁর বিমুক্তির অন্বেষণ দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল। একা একা ধ্যান সাধনা চালিয়ে গেলেন এবং একসময় পৌঁছে গেলেন লক্ষ্যে।

“ঠিক যেমন পাথরের পাহাড় চূড়া,

অনড় দাঁড়িয়ে থাকে, ভীত থাকে শক্ত,

প্রবল বাতাসেও থাকে অটল,

এবং নিজের স্থানে সবসময় অবস্থান করেন।

ঠিক তেমনি তিনি থাকেন সর্বদা

সুদৃঢ় অধিষ্ঠানে সুরক্ষিত।“

একজন বোধিসত্ত্বের থাকে লৌহ সংকল্প যার সুউচ্চ নীতিগুলো কখনোই এদিক-ওদিক হয় না। তিনি সহজেই কল্যাণ কর্মে নিয়োজিত হন, কোন কিছুই যা তাঁর নীতির বিরুদ্ধে সেটাতে জড়ান না। যদি সময় বলে যে হতে তিনি ফুলের মতো তখন নরম হয়ে যান, আবার হয়ে যান পাথরের মতো শক্ত।

 

৯। মৈত্রী

পারমীগুলোর মধ্যে মৈত্রী হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মৈত্রী হলো কোন ভেদাভেদ না রেখে সকল প্রাণীর মঙ্গল সুখ কামনা করা। এই মৈত্রীই বোধিসত্ত্বকে প্ররোচিত করে সংসার ত্যাগি হয়ে বিমুক্তি লাভ করেন সবার কল্যাণের জন্য। তিনি অপ্রমেয় মৈত্রী ছড়ান সকল প্রাণীর প্রতি শ্রেণী, গোত্র, বর্ণ বা নারী-পুরুষ ভেদাভেদ না করেই। যেহেতু তিনি বিশ্বমৈত্রী গুণধর্মে নিজের জীবনকে গুণান্বিত করেছেন না করেন কাউকে ভয়, না হন কারো দ্বারা ভীত। গভীর জঙ্গলের হিংস্র পশুরাও হয়ে যান তাঁর বন্ধু। তিনি তাঁদের মাঝে আসলে একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বের আচরণে আনন্দময় সময় তৈরি হয়ে যায়। হৃদয়ের সমস্ত মৈত্রী তিনি ঢেলে দিয়ে তাঁদের সঙ্গে হাসিখুশিতে থাকেন।

বৌদ্ধধর্মে মৈত্রী ব্যক্তিগত স্নেহ বা জাগতিক ভালোবাসা থেকে আলাদা সেটা আমাদের জানতে হবে। স্নেহ বা জাগতিক ভালোবাসা থেকে ভয় ও শোক আসে, কিন্তু মৈত্রীচিত্তে এসব আসে না। মৈত্রী অনুশীলন করতে গিয়ে অনুশীলনকারি যেন নিজেকে অগ্রাহ্য না করে। নিজের প্রতি সমানভাবে মৈত্রী চর্চা করতে হবে যেমন মৈত্রী ছড়ান অন্য সবার প্রতি। একজন বৌদ্ধ মৈত্রীময় ভালোবাসায় সারা পৃথিবীকে জড়িয়ে ধরেন সেখানে নিজেও অন্তর্ভুক্ত।

মহা ধর্মপাল জাতকে (৩৮৫) দেখা যায় যে তরুণ বোধিসত্ত্ব সমানভাবে মৈত্রী ছড়ান তাঁর নিষ্ঠূর পিতার প্রতি যিনি আদেশ দেন ব্যথা যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলতে, ঘাতককে ও ক্রন্দনরত তাঁর প্রিয় মা, এবং নিজের প্রতিও।  

মৈত্রীর থাকে এক রহস্যময় শক্তি যা সহজে কাছে বা দূরের প্রাণীদের প্রভাবিত করে। নির্মল মৈত্রীময় চিত্তের বিচ্ছূরিত অতি উপকারী এ শক্তি হিংস্র প্রাণীকে দমিয়ে ফেলা, খুনিকে সাধু-সন্ত করার সামর্থ রাখে।

এই রহস্যময় শক্তি সবার মধ্যেই নিহিত থাকে। একটু মৈত্রী ভাবনা অনুশীলন করে চিত্তে প্রতিষ্ঠা করতে হয় মাত্র।

“পর্বতে ঢালুতে বসবাস করতাম” বুদ্ধ বললেন, “মৈত্রী শক্তির দ্বারা সিংহ আর বাঘরা আমার প্রতি আকৃষ্ট হত। সিংহ আর বাঘ, চিতাবাঘ, বুনো মহিশ, কৃষ্ণসারমৃগ (এন্টেলপ), হরিণ এবং বুনো শূকর পরিবেষ্ঠিত হয়ে বসবাস করতাম। কোন প্রাণীই আমাকে ভয়ংকর মনে করতো না, বিপরীতভাবে আমিও কোন প্রাণীকে ভয় পেতাম না। মৈত্রী শক্তি ছিল আমার সহায়ক। এভাবেই আমি পর্বতের পাশে বসবাস করতাম।“

একজন মানুষ সবাইকে ভালোবাসলে, তাঁকেও সবাই ভালোবাসবে। কোন বিরুদ্ধ শক্তি, কোন শত্রুতার কম্পন (Vibrations), কোন খারাপ চিন্তা প্রভাব ফেলতে পারে না যিনি মৈত্রী জ্যোতি দ্বারা প্রতিরক্ষিত থাকেন। শান্তিময় মন নিয়ে তিনি বসবাস করেন নিজের সৃষ্ট স্বর্গে। এমনকি যারা তাঁর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ ঘটে তারাও সেই স্বর্গসুখের ছোঁয়া পায়। যখন একজন মানুষ নিজের মধ্যে মৈত্রীগুণ ভরে যাওয়াটা অনুভব করে এবং বাক্যে ও কর্মে প্রদর্শন করে, তখন কঠোর মনও গলে পানির মতো হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সমস্ত ভেদাভেদ দূরীভূত হয়ে যায়, আর “আমি” মিশে যায় “সবার” মধ্যে। বস্তুত, “আমি” বলতে আদৌ কোন অস্তিত্ব থাকে না। পরিশেষে, তিনি নিজেকে খুঁজে পান সবার সঙ্গে আর এটাই হলো মৈত্রীর সর্বোচ্চ অবস্থা।

একজন বোধিসত্ত্ব এই মঙ্গলময় মৈত্রী শক্তি ছড়ান প্রত্যেক প্রাণীর প্রতি এবং নিজেকে খুঁজে পান সবার সঙ্গে, কোন ভেদাভেদ করেন না সে যে জাতি, গোত্র, বর্ণ, বা নারী-পুরুষ যাই হোক। এটাই বুদ্ধের মৈত্রী যেটি প্রচেষ্ঠা থাকে সমস্ত বাধাবিঘ্নকে ভেঙ্গে ফেলার যেসব বিষয়গুলো একে অপরকে আলাদা করায়। বোধিসত্ত্বের কাছে দূরে বা কাছের, শত্রু বা বহিরাগত, বিশ্বাসঘাতক বা অস্পৃশ্য বলতে কিছু থাকে না, তিনি বিশ্বমৈত্রীকে গভীরভাবে বোঝার মাধ্যমে উপলব্ধি করেছেন, সকল প্রাণীর মাঝে ভাতৃত্ববোধ স্থাপিত করেছেন। একজন বোধিসত্ত্ব হলেন সত্যিকার বিশ্ব নাগরিক, সর্বদা দয়াবান, বন্ধুত্বসুলভ, এবং করুণাপ্রাণ।

 

১০। উপেক্ষা

দশম পারমী হলো উপেক্ষা।

পালিতে উপেক্ষাকে সন্ধি বিচ্ছেদ করা হয়েছে উপ যার অর্থ হলো ন্যায়সঙ্গত, পক্ষপাতিত্বহীন বা যুক্তিসম্পন্ন এবং ঈক্ষা মানে দেখা, জ্ঞাত হওয়া বা মত (View)। উপেক্ষা হলো সত্যিকারভাবে বোঝা, সঠিক মত প্রকাশ করা, বা পক্ষপাতিত্বহীনভাবে দেখা, যা কোন আসক্তি বা বিদ্বেষ ছাড়া, কোনরূপ পছন্দ বা অপছন্দ না দেখিয়ে।

এখানে উপেক্ষাকে নিরপেক্ষ বা আগ্রহশূন্য অনুভূতি সেই অর্থে বোঝানো হয়নি।

সবগুলো পারমীর মধ্যে খুব কঠিন ও খুবি প্রয়োজনীয় হলো এই উপেক্ষা পারমী, বিশেষ করে গৃহী মানুষদের জন্য যারা বসবাস করে ভারসাম্যহীন পৃথিবীতে যেখানে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত হয়।

মান আর অপমান এই মানব সমাজে স্বাভাবিক বিষয়। তেমনই প্রশংসা আর দোষারোপ, লাভ ও ক্ষতি, সুখ ও দুঃখও। এই অষ্ট লোকধর্মের মধ্যেও বোধিসত্ত্ব চেষ্ঠায় থাকেন অটল থাকতে ঠিক যেমন পাথরের পাহাড়, অনুশীলন করে যান পরিপূর্ণ উপেক্ষা।

সুখ ও খারাপ অবস্থার সময়ে, প্রশংসা ও দোষারোপে তিনি নিজেকে রাখেন ভারসাম্যময়। ঠিক যেমন সিংহকে কোন শব্দই বিচলিত করতে পারে না, বিষময় ময়লাযুক্ত অসংযম মুখের বলা কথা দ্বারা তিনি মোটেও অস্থির হন না। ঠিক যেমন বাতাস কোন জালে আটকায় নাহ, তিনি এ পরিবর্তনের পৃথিবীর মোহময় আনন্দ উল্লাসেতে আক্রান্ত হন না। ঠিক যেমন পদ্মফুল কাদা ছোঁয় না যদিও কাদাতেই বর্ধিত হয়, ঠিক তেমনি জাগতিক প্রলোভন দ্বারা প্রলোভিত হন না, থাকেন সবসময় স্থির, নির্মল এবং শান্তময়।

“ঠিক যেমন পৃথিবীর ওপর যা কিছুই ছুঁড়ে দেয়া হোক

হোক মিষ্টি বা দুর্গন্ধ যুক্ত বস্তু,

নিরপেক্ষ নীরব থাকেন সবার প্রতি,

না দেখান ঘৃণা, না দেখান বন্ধুত্ব,

ঠিক তেমনি তিনি ভালোতে ও মন্দতে,

অবশ্যই ভারসাম্যতা বজায় রাখেন সর্বদা।“

“ঠিক যেমন কোন ঢেউ মহাসাগরের গভীর স্থিরতাকে কিছুই করতে পারে না, অচঞ্চল থাকতে হবে তাঁর মন।“

অধিকন্তু, একজন বোধিসত্ত্ব সবার প্রতি ন্যায়শীল থাকেন ইচ্ছা-আকাঙ্খা, ঘৃণা, ভয় এবং মোহের প্রভাবিত না হয়েই।

 

উপসংহারে বলা যায় যে উল্লেখিত দশ পারমী থেকে বোধিসত্ত্ব জীবন হলো পারমীগুলোর সম্পূর্ণতা, আত্মত্যাগময়তা, সুশৃঙ্খলতা, নৈষ্ক্রম্যতা, গভীর প্রজ্ঞা, বীর্য পরায়ন, ক্ষান্তি, সত্যবাদিতা, অধিষ্ঠান, অপ্রমেয় মৈত্রী, এবং পরিপূর্ণ মানসিক ভারসাম্য।

(টীকা: “The Buddha and His Teachings By Narada Thero” বই থেকে “Parami-Perfections Chapter 41” এর অনুবাদ)

=======================================



নারদ থের : (১৪ জুলাই ১৮৯৮-২ অক্টোবর ১৯৮৩) কলম্বোতে জন্মজাত ইংরেজী মাধ্যমের মেধাবী ছাত্র বুদ্ধশাসনে প্রব্বজিত হয়ে ধর্মবিনয়ে পারদর্শী হয়ে ইংরেজী শিক্ষিত সিংহলীদের মাঝে সদ্ধর্ম প্রচারে ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, সিংগাপুর, যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশে ‘ধর্মদূত” হয়ে সদ্ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। মহাপণ্ডিত এ মহান সাংঘিক পুরুষ অসংখ্য বই লেখেন সিংহলী ও ইংরেজীতে। “The Buddha and His Teachings” বইটি অত্যন্ত সদ্ধর্ম প্রচারে অনন্য ভূমিকা রাখছে।


 

                        ভাষান্তর : রতনজ্যোতি ভিক্ষু


Post a Comment

0 Comments

Ad Code

Responsive Advertisement