Hot Posts

6/recent/ticker-posts

Ad Code

মহাউন্মার্গ-জাতক (পর্ব ১) (সূত্রপিটক, খুদ্দকনিকায়ে-৬ষ্ঠ খন্ড)

 

মহাউন্মার্গ-জাতক (পর্ব ১)
(সূত্রপিটক, খুদ্দকনিকায়ে-৬ষ্ঠ খন্ড)
[শাস্তা জেতবনে অবস্থিতিকালে প্রজ্ঞাপারমিতার সম্বন্ধে এই কথা বলিয়াছিলেন। একদিন ভিক্ষুরা ধর্ম্মসভায় উপবিষ্ট হইয়া তথাগতের প্রজ্ঞা পারমিতা বর্ণনা করিতেছিলেন। তাঁহারা বলিতেছিলেন, ‘অহো! তথাগতের কি অসামান্য প্রজ্ঞা। ইহা মহিয়সী ও বিশ্বব্যাপিনী; ইহা যেমন রসবতী, তেমনই প্রত্যুৎপন্না; ইহা সুতীর্ণা ও বিরুদ্ধবাদ-খণ্ডনকুশলা। এই অপার প্রজ্ঞাবলে তিনি কূটদন্ত প্রভৃতি ব্রাহ্মণদিগকে, সভিক প্রভৃতি পরিব্রাজকদিগকে, অঙ্গুলিমাল প্রভৃতি দস্যুদিগকে, আলবক প্রভৃতি যক্ষদিগকে, শক্র প্রভৃতি দেবতাদিগকে এবং বকপ্রভৃতি ব্রহ্মাদিগকে সম্পূর্ণরূপে বিনয়ী করিয়া স্বমতে দীক্ষিত করিয়াছেন, সহস্র সহস্র লোককে প্রব্রজ্যা দিয়া মার্গফলের অধিকারী করিয়াছেন। ভিক্ষুরা এইরূপে শাস্তার মহাপ্রজ্ঞার মহিমা কীর্ত্তন করিতেছিলেন, এমন সময়ে তিনি সেখানে উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ভিক্ষুগণ, তোমরা এখানে বসিয়া কোন্‌ বিষয়ের আলোচনা করিতেছ?’ তাঁহারা আলোচ্যমান বিষয় বিজ্ঞাপিত করিলে শাস্তা বলিলেন, ‘ভিক্ষুগণ, তথাগত যে কেবল এখনই প্রজ্ঞাবান হইয়াছেন, এমন নহে, যখন তাঁহার জ্ঞানের সম্পূর্ণ পরিপক্বতা জন্মে নাই, যখন তিনি বুদ্ধত্বপ্রাপ্তির আশায় বোধিসত্ত্বরূপে বিচরণ করিতেছিলেন, সেই অতীতকালেও তিনি অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়াছিলেন।’ অনন্তর তিনি সেই অতীত কথা আরম্ভ করিলেন 🙂
(১)
পুরাকালে মিথিলায় বিদেহ নামে এক রাজা ছিলেন। সেনক, পুক্কুশ, কবীন্দ ও দেবেন্দ্র, এই চারিজন পণ্ডিত তাঁহার ধর্ম্মানুশাসকের কাজ করিতেন। যেদিন বোধিসত্ত্ব মাতৃকুক্ষিতে প্রতিসন্ধি লাভ করেন, সেইদিন প্রত্যূষকালে রাজা এই স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন-রাজাঙ্গণের চারিকোণে চারিটী অগ্নিস্তম্ভ যেন মহাপ্রাকারের সমান উচ্চ হইয়া জ্বলিতেছিল; পরে তাহাদের মধ্যে খদ্যোতপ্রমাণ অগ্নিস্ফুলিঙ্গ উত্থিত হইয়া মুহূর্ত্তমধ্যে অগ্নিস্তম্ভ চারিটীকে অতিক্রমপূর্ব্বক ব্রহ্মলোকপ্রমাণ উচ্চতা লাভ করিল এবং চক্রবালসকল এরূপে উদ্ভাসিত করিয়া রহিল যে, ভুপতিত সর্ষপবীজ পর্য্যন্ত দেখা যাইতে লাগিল, দেবমানব প্রভৃতি সমস্ত লোক মাল্যগন্ধাদি দ্বারা তাঁহার পূজা করিতে লাগিল, বহুলোক তাঁহার ভিতর দিয়া গতায়াত করিল; কিন্তু কাহারও লোমকূপমাত্রও উষ্ণতা অনুভব করিল না।
এই স্বপ্ন দেখিয়া রাজা ভীত ও ত্রস্ত লইয়া শয্যাত্যাগ করিলেন এবং না জানি ইহা হইতে কি অনর্থই ঘটিবে, অরুণোদয় পর্য্যন্ত বসিয়া বসিয়া এইরূপ ভাবিতে লাগিলেন। পূর্ব্বকথিত পণ্ডিত চারিজন, প্রাতঃকালেই তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মহারাজ, সুখে নিদ্রা গিয়াছেন ত?’ রাজা বলিলেন, ‘সুখ কোথায় পাইব? আমি এই দুঃস্বপ্ন দেখিয়াছি।’ তাহা শুনিয়া সেনক পণ্ডিত বলিলেন, ‘ভয় পাইবেন না, মহারাজ। এ সুস্বপ্ন; ইহাতে আপনার শ্রীবৃদ্ধিই হইবে।’ ‘কিরূপে বুঝিলেন?’ ‘এমন একজন পঞ্চম পণ্ডিতের আবির্ভাব হইবে, যিনি আমাদের এই চারিজনকে অতিক্রমপূর্ব্বক নিষ্প্রভ করিবেন। আমরা আপনার স্বপ্নদৃষ্ট অগ্নিস্তম্ভ চারিটী; তাহাদের মধ্যস্থলে যে অগ্নিস্তম্ভ দেখিয়াছেন, তাহাই সেই পঞ্চম পণ্ডিত। দেবলোক ও নরলোকে, কুত্রাপি তাঁহার তুল্যকক্ষ কেহ থাকিবে না।’ ‘তিনি এখন কোথায়?’ সেনক নিজের বিদ্যাবলে দিব্যচক্ষুদ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়া বলিলেন, ‘মহারাজ, তিনি অদ্য হয় প্রতিসন্ধি গ্রহণ করিয়াছেন; নয় মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়াছেন।’ তখন হইতে রাজা এই কথা স্মরণ করিয়া রাখিলেন।
তৎকালে মিথিলা নগরীর চতুর্দ্বারসমীপে পূর্ব্ব যবমধ্যক, দক্ষিণ যবমধ্যক, পশ্চিম যবমধ্যক ও উত্তর যবমধ্যক নামে চারিখানি গ-গ্রাম ছিল। ইহাদের মধ্যে পূর্ব্ব যবমধ্যক গ্রামে শ্রীবর্দ্ধন নামে এক শ্রেষ্ঠী বাস করিতেন। তাঁহার ভার্য্যার নাম সুমনা দেবী। যে দিনের কথা হইল, সেইদিন রাজার স্বপ্নদর্শন সময়ে, মহাসত্ত্ব ত্রয়স্ত্রিংশদভবন ত্যাগ করিয়া এই রমণীর গর্ভে প্রবেশ করিলেন। অপর এক সহস্র দেবপুত্রও ত্রয়স্ত্রিংশদভবন ত্যাগ করিয়া সেই গ্রামেই অন্যান্য শ্রেষ্ঠী ও অনুশ্রেষ্ঠীদিগের কুলে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করিলেন। সুমনা দেবী দশমাস গর্ভধারণ করিয়া এক হেমবর্ণ পুত্র প্রসব করিলেন। ঐ সময়ে শক্র নরলোক পর্য্যবেক্ষণ করিতেছিলেন। মহাসত্ত্ব মাতৃগর্ভ হইতে বিনিষ্ক্রান্ত হইতেছেন জানিয়া তিনি স্থির করিলেন, ‘এই বুদ্ধাঙ্কুরকে দেবলোকে ও নরলোকে প্রকটিত করিতে হইবে।’ মহাসত্ত্ব যখন ভূমিষ্ঠ হইতেছিলেন, তখন শক্র অদৃশ্যমান শরীরে উপস্থিত হইয়া তাঁহার হস্তে একখণ্ড ওষধি স্থাপনপূর্ব্বক স্বস্থানে প্রতিগমন করিলেন। মহাসত্ত্ব ঐ ঔষধিখণ্ড মুষ্টিবদ্ধ করিয়া রাখিলেন। তিনি যখন ভূমিষ্ঠ হইলেন, তখন তাঁহার গর্ভধারিণী কিছুমাত্র যন্ত্রণা ভোগ করিলেন না। ধর্ম্মঘট (কমণ্ডলু) হইতে জল যেমন সহজে নির্গত হয়, তিনিও সেইরূপ সহজে মাতৃগর্ভ হইতে বিনা ক্লেশে বহির্গত হইলেন। জননী তাঁহার হস্তে ঔষধি-খণ্ড দেখিয়া জিজ্ঞাসিলেন, ‘বাবা, তুমি এ কি পাইয়াছ?’ মহাসত্ত্ব বলিলেন, ‘মা, ইহা ঔষধ।’ অনন্তর তিনি সেই দিব্য ঔষধ মাতার হস্তে দিয়া বলিলেন, ‘মা, এই ঔষধ লও; যাহার যে কোন পীড়া হউক না কেন, তাহাকেই এই ঔষধ দিও।’ সুমনা দেবী তুষ্ট ও প্রহৃষ্ট হইয়া শ্রীবর্দ্ধন শ্রেষ্ঠীকে এই বৃত্তান্ত জানাইলেন। শ্রীবর্দ্ধন সাত বৎসর শিরঃপীড়ায় কষ্ট পাইতেছিলেন; তিনি সুমনার কথায় অতি আহ্লাদিত হইয়া ভাবিলেন, ‘এই কুমার মাতৃগর্ভ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইবার সময়ে ঔষধ লইয়া আগমন করিয়াছে; জন্মমুহূর্ত্তেই মাতার সঙ্গে কথা বলিয়াছে। এরূপ পুণ্যশীলসত্ত্বপ্রদত্ত ঔষধ নিশ্চয় মহাফলপ্রদ হইবে। তিনি ঐ ঔষধ শিলে ঘষিয়া অল্পমাত্র ললাটে মাখিলেন; অমনি তাঁহার সপ্তবর্ষের শিরোযন্ত্রণা দূর হইল, নিমিষের মধ্যে পদ্মপত্র হইতে যেন জল সরিয়া গেল। তিনি হর্ষভরে বলিতে লাগিলেন, ‘অহো! এই ঔষধের কি অদ্ভুত ক্ষমতা।’
মহাসত্ত্ব যে ঔষধ লইয়া ভূমিষ্ঠ হইয়াছেন, একথা সর্ব্বত্র প্রকাশিত হইল; যত ব্যাধিগ্রস্ত লোক, সকলে শ্রেষ্ঠীর গৃহে গিয়া ঔষধ চাহিতে লাগিল; দিব্যেষধ শিলে ঘষিয়া ও জলে গুলিয়া শ্রেষ্ঠীর লোকজন সকলকেই একটু একটু দিত; তাহা শরীরে মাখিবামাত্র সকলেরই পীড়োপশম হইত; ব্যাধিমুক্ত লোকেরা মহানন্দে বলিয়া বেড়াইত, ‘শ্রীবর্দ্ধন শ্রেষ্ঠীর গৃহে যে ঔষধ আছে, তাহার অতি অদ্ভুত ক্ষমতা।’ মহাসত্ত্বের নামকরণ দিবসে শ্রীবর্দ্ধন ভাবিলেন, ‘পূর্ব্ব পুরুষদিগের নামানুসারে আমার পুত্রের নাম রাখিবার প্রয়োজন নাই; বৎস আমার ঔষধনামা হউক।’ ইহা স্থির করিয়া তিনি পুত্রের ‘ঔষধকুমার’ এই নাম রাখিলেন। তাহার পর তিনি আবার ভাবিলেন, ‘আমার পুত্র মহাপুণ্যবান; সে একাকী জন্মগ্রহণ করে নাই; তাহার সঙ্গে একই সময়ে আরও অনেক বালক জন্মিয়াছে।’ তিনি অনুসন্ধান লইয়া জানিতে পারিলেন, সেদিন আরও এক সহস্র কুমার ভূমিষ্ঠ হইয়াছে। তিনি এই সকল বালকের জন্য বস্ত্র ও ধাত্রী প্রেরণ করিলেন, এবং তাহারা ঔষধকুমারের সহচর হইবে, এই অভিপ্রায়ে আপন পুত্রের ন্যায় তাহাদেরও মাঙ্গলিক কার্য্য সম্পাদন করাইলেন। তাহারা প্রতিদিন অলঙ্কৃত হইয়া বোধিসত্ত্বের সহিত ক্রীড়া করিবার জন্য আনীত হইতে লাগিল। বোধিসত্ত্ব তাহাদের সঙ্গে খেলাধূলা করিয়া দিন দিন বড় হইতে লাগিলেন। সপ্তমবর্ষকালে তাঁহার দেহ সুবর্ণপ্রতিমার ন্যায় মনোহর হইল।
ঔষধকুমার যখন এই সকল সহচরের সহিত গ্রামমধ্যে ক্রীড়া করিতেন, তখন কখনও কখনও হস্তি প্রভৃতি প্রাণী তাঁহাদের ক্রীড়া-ভূমির ভিতর দিয়া চলিয়া যাইত; বাতাতপের সময়েও বালকেরা ক্লান্ত হইত। একদিন অকালে মেঘ উঠিল; তাহা দেখিয়া নাগবল ঔষধকুমার ছুটিয়া এক গৃহে প্রবেশ করিলেন; অনা্যন্য বালক তাঁহার পশ্চাতে ছুটিতে ছুটিতে পরস্পরের পদাঘাতে আছাড় পড়িল, তাহাতে তাহাদের জানুতে ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আঘাত লাগিল। ইহাতে মহাসত্ত্ব ভাবিলেন, ‘আমরা আর এভাবে ক্রীড়া করিব না; এখানে এক ক্রীড়াশালা নির্ম্মাণ করিতে হইবে।’ তিনি সহচরদিগকে বলিলেন, ‘এস, আমরা এখানে এমন একটা ক্রীড়াশালা প্রস্তুত করি, যাহার মধ্যে ঝড়ে, জলে, রৌদ্রে সকল সময়েই আমরা ইচ্ছামত দাঁড়াইতে, বসিতে বা শুইতে পারিব। তোমরা এজন্য সকলেই এক এক কাহণ আনিও।’ এই কথায় সহস্র বালক সহস্র কার্ষাপণ আনয়ন করিল। ঔষধকুমার প্রধান সূত্রধরকে ডাকাইয়া বলিলেন ‘এই স্থানে ক্রীড়াশালা প্রস্তুত করিতে হইবে। তুমি (খরচের জন্য) এই হাজার কাহণ লও।’
সূত্রধার ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া কার্ষাপণগুলি লইল, ভূমি সমান করিল, খুঁটা কাটিয়া সূতালি করিল, কিন্তু তাহা মহাসত্ত্বের ভাল লাগিল না; তিনি সূত্রধরকে কিরূপে সূতালি করিতে হইবে, তাহা বুঝাইয়া বলিলেন, ‘এইরূপে সূতালি করিলে ঠিক হইবে।’ ‘প্রভু, আমার নিজের যেমন বিদ্যা, সেইরূপই সূতালি করিয়াছি; তাহা ছাড়া অন্য কোনরূপ জানি না। যদি তাহা না জান, তবে আমাদের অর্থ লইয়া কিরূপে ক্রীড়াশালা প্রস্তুত করিবে? আচ্ছা, তুমি সূতা লও; আমি তোমাকে সূতালি করিয়া দেখাইতেছি।’ ইহা বলিয়া তিনি সেই সূত্রধারের দ্বারা সূতা ধরাইলেন এবং নিজে এমন সূতালি করিলেন যে, বোধ হইতে লাগিল, স্বয়ং বিশ্বকর্ম্মা আসিয়া সব ঠিকঠাক করিয়া দিয়াছেন। তাহার পর তিনি সূত্রধারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এখন ত তুমি এইপ্রকার সূতালি করিতে পারিবে?’ ‘না মহাশয়; আমি পারিব না।’ ‘আমি দেখাইয়া দিলে পারিবে ত?’ ‘পারিব।’ তখন মহাসত্ত্ব ঐ ক্রীড়াশালার নির্ম্মাণসম্বন্ধে এমন ব্যবস্থা করিলেন যে, তাহার এক অংশ অভ্যাগতদিগের বাসার্থ, এক অংশ অনাথদিগের বাসার্থ, এক অংশ অনাথা নারীদিগের প্রসবার্থ, এক অংশ আগন্তুক বণিকদিগের পণ্যভাণ্ডরক্ষার্থ ব্যবহৃত হইতে পারে এবং প্রত্যেক প্রকোষ্ঠেরই দ্বার বহির্দ্দিকে খোলা যায়। তিনি উহার মধ্যেই ক্রীড়া-ভূমি, বিচারগৃহ ও ধর্ম্মসভার পৃথক পৃথক প্রকোষ্ঠ রাখিয়া দিলেন। এইরূপে শালাটীর নির্ম্মাণ শেষ হইলে তিনি চিত্রকর ডাকাইলেন এবং নিজেই তাহাদের পরীক্ষা করিয়া তাহাদের দ্বারা উহা চিত্রিত করাইলেন। চিত্র শেষ হইলে, ঐ ক্রীড়াশালা শক্রের সুধর্ম্মাসভার ন্যায় দেখাইতে লাগিল। কিন্তু ইহাতেও শালাটী সর্ব্বাঙ্গসুন্দর হইল না বিবেচনা করিয়া তিনি একটী পুষ্করিণী খনন করাইবার অভিপ্রায় করিলেন। পুষ্করিণী খনন করা হইলে তিনি রাজমিস্ত্রী ডাকাইলেন, কোথায় কি করিতে হইবে, নিজেই তাহা নির্দ্দেশ করিয়া তাহাকে অর্থ দিলেন এবং সহস্রবঙ্ক ও শততীর্থযুক্ত পুষ্করিণী নির্ম্মাণ করাইলেন। পঞ্চবিধ পদ্ম-বিভূষিত হইয়া এই পুষ্করিণী নন্দন সরোবরের শোভা ধারণ করিল। মহাসত্ত্ব তাহার তীরে বহুবিধ ফুল ও ফলের গাছ রোপণ করাইলেন; অচিরে এই উদ্যানও নন্দন কাননের ন্যায় রমণীয় হইল। মহাসত্ত্ব এই ক্রীড়াশালার নিকটে দানব্রতে রত হইলেন; ধার্ম্মিক শ্রমণব্রাহ্মণগণ, দূরদেশাগত অতিথিগণ ও গ্রামবাসিগণ সেখানে দান পাইতে লাগিল। তাঁহার এই অদ্ভুত ক্রিয়া সর্ব্বত্র প্রকটিত হইল; তাঁহার ক্রীড়াশালায় বহুলোক যাইতে লাগিল। মহাসত্ত্ব সেখানে বসিয়া উপস্থিত লোকদিগের অভাব ও অভিযোগের যুক্তাযুক্ততা বিচার করিতেন। ফলতঃ তাঁহার ব্যবহারে বোধ হইতে লাগিল যেন বুদ্ধাবির্ভাবকাল উপস্থিত হইয়াছে।
এদিকে সপ্তবর্ষ অতীত হইলে বিদেহরাজের স্মরণ হইল যে, তাঁহার পণ্ডিত চারিজন বলিয়াছিলেন, এমন একজন পণ্ডিত আবির্ভূত হইবেন, যিনি তাঁহাদিগকেও অতিক্রম করিবেন। সেই পঞ্চম পণ্ডিত এখন কোথায়, এই চিন্তা করিয়া তিনি তাঁহার বাসস্থান জানিবার জন্য নগরের চারিদ্বার দিয়া চারিজন অমাত্য প্রেরণ করিলেন। যাঁহারা অন্য দ্বারগুলি দিয়া বাহির হইলেন, তাঁহারা মহাসত্ত্বের দেখা পাইলেন না; কিন্তু যিনি পূর্ব্বদ্বার দিয়া নিষ্ক্রান্ত হইলেন, তিনি পূর্ব্ববর্ণিত ক্রীড়াশালাদি দেখিয়া ভাবিলেন, ‘এই বিচিত্র ভবন নিশ্চয় কোন সুপণ্ডিত ব্যক্তি হয় নিজে নির্ম্মাণ করিয়াছেন, নয় অন্য কাহারও দ্বারা নির্ম্মাণ করাইয়াছেন।’ তিনি সেখানকার লোকজনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কোন্‌ সূত্রধার এই ভবন নির্ম্মাণ করিয়াছেন, বল ত?’ তাহারা উত্তর দিল, ‘কোন্‌ সূত্রধারই নিজের বুদ্ধিবলে এই ভবন নির্ম্মাণ করে নাই; শ্রীবর্দ্ধন শ্রেষ্ঠীর পুত্র মহৌষধ পণ্ডিতের উপদেশবলে ইহা প্রস্তুত হইয়াছে।’ ‘মহৌষধ পণ্ডিতের বয়স কত?’ ‘এই সাত বৎসর পূর্ণ হইল।’ অমাত্য গণনা করিয়া দেখিলেন, রাজা যে দিন স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন, সেই সময় হইতেও ঠিক সাত বৎসর অতীত হইয়াছে; অতএব মহৌষধ কুমার হয় ত সেই পণ্ডিত। এই অনুমানে তিনি রাজার নিকট দূত পাঠাইয়া সংবাদ দিলেন, ‘মহারাজ, পূর্ব্বযবমধ্যক গ্রামের শ্রীবর্দ্ধনশ্রেষ্ঠীর মহৌষধ পণ্ডিত নামে এক পুত্র আছেন। তাঁহার বয়স এখন সাত বৎসর মাত্র। তিনি কিন্তু (এই অল্প বয়সেই) অতি অদ্ভুত ক্রীড়াশালা, পুষ্করিণী ও উদ্যান নির্ম্মাণ করিয়াছেন। তাঁহাকে আপনার নিকট লইয়া যাইব কি?’ রাজা এই সংবাদে তুষ্ট হইয়া সেনক পণ্ডিতকে ডাকাইলেন এবং তাঁহাকে অমাত্যের সংবাদ জানাইয়া মহৌষধ পণ্ডিতকে আনয়ন করিবেন কি না, জিজ্ঞাসা করিলেন। কিন্তু সেনক ঈর্ষাবশে বলিলেন, ‘মহারাজ, ক্রীড়াশালাদি নির্ম্মাণ করাইলেই কেহ পণ্ডিত হয় না; যে সে লোকেই এরূপ কাজ করাইতে পারে; এ সব তুচ্ছ কাজ।’ ইহা শুনিয়া রাজা ভাবিলেন, ‘সেনকের এরূপ বলিবার হয় ত কোন কারণ আছে।’ কিন্তু তিনি কিছু না বলিয়া দূতমুখে সেই অমাত্যকে বলিয়া পাঠাইলেন, ‘আপনি ঐখানেই অবস্থিতি করিয়া আরও কিছুদিন সেই পণ্ডিতকে পরীক্ষা করুন।’ এই আদেশ পাইয়া উক্ত অমাত্য সেখানে থাকিয়া মহৌষধের পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। যে যে বিষয় লইয়া পরীক্ষা হইয়াছিল, সেগুলির তালিকা এই :
মাংস, গরু, গ্রন্থি, সূত্র পুত্র, গোল, রথ, দণ্ড, শীর্ষ, সর্প, কুক্কুট হীরক,
বৃষগর্ভে বৎসজন্ম, অতণ্ডুলভক্ত পাক, বালুকানির্ম্মিত রজ্জু এক
গ্রাম হতে নগরেতে তড়াগ, উদ্যান, এই উভয়ের অদ্ভুত প্রয়াণ,
পুত্রাপেক্ষা হীন থর, কাকের কূলায়ে মণি, ঊনিশটী প্রজ্ঞার প্রমাণ।
(১) মাংস
একদিন বোধিসত্ত্ব ক্রীড়াভূমিতে যাইতেছিলেন, এমন সময়ে একটা শ্যেন মাংসবিপণির ফলক হইতে একখণ্ড মাংস লইয়া উড়িয়া গেল। ইহা দেখিয়া কয়েকটী বালক, যাহাতে শ্যেন ভয় পাইয়া মাংসখণ্ড ফেলিয়া দেয়, এই উদ্দেশ্যে তাহাকে তাড়া করিল। শ্যেন এদিকে ওদিকে উড়িতে লাগিল; ছেলেরা উপরের দিকে তাকাইতে তাকাইতে তাহার সঙ্গে সঙ্গে ছুটিল, কিন্তু মাটির দিকে দৃষ্টি না রাখায় পাষাণাদিতে হোঁচোঁ খাইয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িল। ইহা দেখিয়া বোধিসত্ত্ব বলিলেন, ‘আমি উহার মুখ হইতে মাংসখানা ফেলাইব কি?’ ছেলেরা বলিল, ‘ফেলান ত, প্রভু।’ ‘তবে দেখ।’ তখন তিনি উপরের দিকে না তাকাইয়া, যেখানে শ্যেনের ছায়া পড়িয়াছিল, বাতবেগে সেইখানে ছুটিয়া গেলেন এবং করতালি দিতে দিতে এমন চীৎকার করিলেন, যে সেই শব্দ যেন পাখীটার উদর বেধ করিয়া গেল। ইহাতে সে ভয় পাইয়া মাংস ত্যাগ করিল। বোধিসত্ত্ব ছায়া দেখিয়াই বুঝিলেন, শ্যেন মাংস ত্যাগ করিয়াছে; তিনি উহা মাটিতে পড়িতে না দিয়া আকাশেই ধরিয়া ফেলিলেন। এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখিয়া সমবেত সমস্ত লোকে করতালি দিতে দিতে উচ্চৈস্বরে ‘সাবাস্‌, সাবাস্‌’ বলিতে লাগিল। রাজার অমাত্য এই বৃত্তান্ত অবগত হইয়া রাজার নিকট সংবাদ পাঠাইলেন : ‘মহারাজের অবগতির জন্য জানাইতেছি, ঔষধপণ্ডিত না কি এই উপায়ে শ্যেনপক্ষীকে মাংসত্যাগ করিতে বাধ্য করিয়াছেন।’ রাজা সেনক পণ্ডিতকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ঔষধ পণ্ডিতকে এখানে আনাইব কি?’ সেনক ভাবিলেন, ‘ঔষধপণ্ডিত আসিলে আমার গৌরব নষ্ট হইবে, এমন কি, আমি যে আছি, রাজা সে খবরও লইবেন না। অতএব তাঁহাকে এখানে আনাইতে দেওয়া হইবে না।’ তিনি ঈর্ষ্যাপরবশ হইয়া উত্তর দিলেন, ‘মহারাজ, কেবল এই কাজটুকু করিয়া কেহ পণ্ডিত হয় না। এ অতি সামান্য কাজ।’ রাজা মধ্যস্থভাব অবলম্বনপূর্ব্বক অমাত্যকে বলিয়া পাঠাইলেন, ‘আপনি ওখানেই থাকিয়া আরও কিছুদিন পরীক্ষা করুন।’
(ক্রমশ)
(সংগ্রহে:)

Post a Comment

0 Comments

Ad Code

Responsive Advertisement