Hot Posts

6/recent/ticker-posts

Ad Code

শুভ জৈষ্ঠ্য পূর্ণিমা’




 

‘শুভ জৈষ্ঠ্য পূর্ণিমা’
—————————
বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের কাছে প্রতিটি দিনই শুভ।
তবে মহা পুরুষের জীবনের পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত ঘটনাবলীর সাথে যে দিন বা কালের সম্পর্ক সে দিন বা কাল শুভ পবিত্র বলে বিশ্বাস করে।আজও তেমনি একটি পুণ্যময় পর্ব বা তিথি ‘শুভ জৈষ্ঠ্য পূর্ণিমা’।
১ঃ- মহাকারুণিক বুদ্ধ কর্তৃক শ্রাবস্তীতে প্রথম ধর্মদেশনা প্রদান এবং সম্রাট অশোক (ধর্মাশোক) পুত্র অর্হৎ মহেন্দ্র স্থবির কর্তৃক শ্রীলংকায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য এই পূর্ণিমা তিথি তাৎপর্যপূর্ণ।
২ঃ-অর্হৎ মহেন্দ্র স্থবির কর্তৃক শ্রীলংকায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারঃ
মহাকারুণিক বুদ্ধের পরিনির্বাণের প্রায় ২২৫ বৎসর পর সম্রাট অশোক ‘মোগ্গলিপুত্ত তিস্স’ স্থবিরের নিকট বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তৃতীয় সঙ্গীতি সমাপ্ত করে ‘মোগ্গলিপুত্ত তিস্স’ স্থবির সম্রাট অশোকের সহায়তায় বিভিন্ন দেশে ধর্মপ্রচারক প্রেরণ করেন। ভারতীয় ধর্ম সংগঠিত রূপে ভারতের বাইরে এই প্রথম প্রচারিত হতে থাকে। এই প্রচারকদল পশ্চিমে যবন রাজাদের রাজ্য গ্রীস, মিশর ও সিরিয়া আদি দেশে, উত্তরে মধ্য-এশিয়া, দক্ষিণে তাম্রবর্ণী (লঙ্কা) ও সুবর্ণভূমি (বfর্মা) ও গিয়েছিলেন। লঙ্কায় মোগ্গলিপুত্ত তিস্সের শিষ্য অশোক পুত্র ‘অর্হৎ স্থবির মহেন্দ্র’ সাথে আরো চারজন ভিক্ষু, একজন শ্রামণ এবং একজন উপাসক নিয়ে গমণ করেছিলেন। ‘অর্হৎ মহেন্দ্র স্থবিরের ধর্মোপদেশ শ্রবণ করে তৎকালীন লঙ্কার রাজা ‘দেবানাম পিয়তিস্স’ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। পরবর্তীতে বুদ্ধাঙ্কুর সিদ্ধার্থ গৌতম যে বোধিবৃক্ষের ছায়া তলে সাধনা করে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন, সে বোধিবৃক্ষের দক্ষিণ শাখা সম্রাট অশোকের কন্যা থেরী সংঘমিত্রা লঙ্কাদ্বীপে নিয়ে আসেন। রাজা দেবানাম পিয়তিস্স বোধিবৃক্ষের শাখাটি অনুরাধাপুর নামক প্রদেশে রোপণ করেন। এভাবে শ্রীলংকায় বৌদ্ধধর্ম প্রচার লাভ এবং কিছুদিনের মধ্যে লঙ্কাবাসী সকলে বৌদ্ধধর্মে প্রশান্তি খুঁজে নেন। শ্রীলংকায় উড়তে শুরু করে বৌদ্ধ পতাকা। বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘের জয় ধ্বনিতে মুখরিত হয় লঙ্কাদ্বীপ।
৩ঃ-সিংহলী রাজা দেবানাম প্রিয়তিস্সের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করা হলো :-
মনোরম আবহাওয়া, সুন্দর পরিবেশ, চারিদিকে সুশোভিত সবকিছু মিলে দিনটি ছিল অতীব চমৎকার। রাজা দেবানাম প্রিয়তিস্স রাজ উদ্যানে সেদিন শিকার উৎসবে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছিলেন। হঠাৎ একটি বড় হরিণ তাঁর পাশ দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল। রাজা সেই বড় হরিণকে শিকার করার জন্য তীর তাক করলেন। এমন সময় যে পর্বতের পাদদেশে দাঁড়িয়ে রাজা শিকার তাক করেছিলেন, সে পর্বত পৃষ্ঠ হতে এক আলোক রশ্মি দেখতে পেলেন এবং তিনি মধুর স্বরে তার নাম ধরে ডাক শুনতে পেলেন। চিন্তা করলেন, কার এত বড় স্পর্ধা যে আমায় নাম ধরে ডাকে! রাজা সেদিকে মনোযোগ দেওয়াতে শিকার লক্ষ্য ভ্রষ্ট হল। কিন্তু স্বরটা এতই মধুর ছিল যে রাজার মনে একটুও বিরক্তি জমল না।এবার রাজা সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। দেখলেন পর্বত পৃষ্ঠে আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে গেরুয়া বসন পরিহিত শান্ত-সৌম্য, উজ্জ্বল-জ্যোতিষ্ময় এক সন্ন্যাসী। চোখ যেন আর ফিরে না! তিনি বিষ্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলেন স্থবির পাণে। পরক্ষণে স্থবিরের পেছনে তিনি আরো পাঁচজন সন্ন্যাসী এবং একজন উপাসককে দেখতে পেলেন। স্থবির মহেন্দ্র রাজার মনোভাব বুঝতে পারলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন রাজা তাঁর উপদেশ শুনতে প্রস্তুত।পরাক্রমশালী রাজা দেবানাম প্রিয়াতিস্সের হাত হতে শিকারের সেই তীর-ধনুক অজ্ঞাতেই পড়ে গেল ভূমিতে। তিনি প্রথমে কপালে স্থবিরের পা ঠুকিয়ে, এরপর নতজানু হয়ে বসে দু'হাত জোড় করে প্রণাম নিবেদন করলেন। অর্হৎ মহেন্দ্র স্থবির প্রথমে রাজার জ্ঞান এবং বুদ্ধিমত্তা নিরুপণ প্রয়াসে সাধারণভাবে ধর্মদানের সিদ্ধান্ত নিলেন। আর এভাবেই স্থবিরের ধর্মোপদেশ শ্রবণে রাজা বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ পূর্বক ত্রিশরণাগমনে বৌদ্ধধর্মে প্রবেশ করলেন।
আজ হতে প্রায় ২০০০ বৎসরেরও পূর্বে সেদিনের সেই ধর্মবিজয় হতেই আজো শ্রীলংকায় বৌদ্ধধর্ম পূর্ণালোকের ন্যায় দেদীপ্যমান। বুদ্ধ প্রতিরূপ সে দেশ বৌদ্ধদের এক মহান পূণ্য তীর্থভূমি। সেদেশের অনুরাধাপুরে রয়েছে বুদ্ধগয়ার মূল মহাবোধি বৃক্ষের শাখা বৃক্ষ; কেন্ডিতে রয়েছে গৌতম বুদ্ধের পবিত্র দন্তধাতু, এছাড়াও শ্রী-পাদ পর্বতে রয়েছে গৌতম বুদ্ধের পবিত্র পদচিহ্ন।
এই পূর্ণিমা তিথি শ্রীলংকান বৌদ্ধরা ‘‘পোসন পয়া’’ (Poson Poya) নামে অভিহিত করেন। Poson বলতে ‘ধর্মবিজয়’ এবং Poya বলতে ‘পূর্ণিমা’ বুঝানো হয়; অর্থাৎ এই পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীলংকায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয় বলে পূর্ণিমাটি ‘‘ধর্মবিজয় পূর্ণিমা’’ নামে আখ্যায়িত। শ্রীলংকান বৌদ্ধদের নিকট এটি দ্বিতীয় প্রধান পূর্ণিমা বা ধর্মীয় তিথি। অর্থাৎ, বুদ্ধ পূর্ণিমার পরই এই পোসন পয়া বা জৈষ্ঠ্য পূর্ণিমার স্থান। মহাসারম্ভে সমগ্র শ্রীলংকা জুড়ে দিনটি প্রতিপালিত হয়। বিহারে আলোকসজ্জা, তোরণ নির্মাণ, নানান রকমের আলোক প্রদীপ তৈরী, পেরেহেরা (প্যারেড/র্যালী), অন্ন-পানীয় দানশালার অয়োজন তো রয়েছেই। সেই সাথে ভোরে উপাসক-উপাসিকাদের বিহারে আগমন, উপোসথ শীল গ্রহণ, ভাবনা অনুশীলন, পুরো দিবস জুড়ে ধর্মদেশনা শ্রবণ এবং সন্ধ্যায় বোধি পূজা ইত্যাদি ধর্মানুশীলনের মধ্যদিয়ে পূণ্যময় দিনটি উদ্যাপিত হয়ে থাকে। তবে, শ্রীলংকার মিহিনতল নামক স্থানটি যেখানে তৎকালীন সিংহলী রাজা দেবানাম প্রিয়তিস্স মহেন্দ্র স্থবিরের নিকট বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন এবং শ্রীলংকার প্রাচীন রাজধানী অনুরাধাপুর নামক প্রদেশে বিভিন্ন অঞ্চল হতে পূণ্যার্থীদের তীর্থযাত্রা এবং নানা ধর্মময় আয়োজনে পুরো সপ্তাহকাল উৎসবমুখর থাকে।
পরিশেষে, অনন্ত গুণসম্পন্ন বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘের প্রতি বন্দনা-পূজা, শ্রদ্ধা, ভক্তি অর্পণ পূর্বক দূরের-কাছের সকল জ্ঞাতী, বন্ধু, শত্রু-মিত্র, কল্যাণকামী-অকল্যাণকামী সর্বোপরি সকলের প্রতি ২৫৬০ বুদ্ধাব্দের শুভ জৈষ্ঠ্য পূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা জানাই।
জয়তু বুদ্ধ সাসনম্।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।

Post a Comment

0 Comments

Ad Code

Responsive Advertisement