Hot Posts

6/recent/ticker-posts

Ad Code

বুদ্ধজ্ঞানে করুণা -লেখা:- কোলিত নায়কা মহাথেরো


বুদ্ধজ্ঞানে করুণা

কোলিত নায়কা মহাথেরো 

করুণা ইংরেজিতে বলা হয় ‘COMPASSION’ (কমপেশান) বুদ্ধের শিক্ষায়করুণা হলো এক মহৎ গুণ যা সবার অনুশীলন করা খুবি প্রয়োজন যার করুণাময় চিত্তে ভরপুর জীবনতিনি কখনো বিবেচনায় আনেন না জাতিধর্মশিক্ষাধন-সম্পত্তি আর কী চেহারা সেসব ধারণাগুলো সেই হিসাবেএকজন মানুষকে এই মহৎ গুণটি অনুশীলন করতে হয় সকল প্রাণীর প্রতিবন্ধু-শত্রুপরিচিত-অপরিচিত সবার প্রতি সেই অবস্থায় মনকে নিয়ে যাবার আগে সর্বপ্রথম আমাদের নিজের মনের মধ্যেই একে চর্চা করে করুণাময় চিত্তের অধিকারি হতে হয়
পরে দুক্খে সতি সাধুনম,
হদয় কম্পনাং করোতি তি করুনাং
পরের দুঃখে যে সাধুজন সর্বদা হৃদয়ে দুঃখ অনুভব করেনসেটি হলো করুণা
এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন বৌদ্ধ শাস্ত্রের জ্ঞানী টীকাকার
কেউ আবার ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে করুণা হলো অপরের দুঃখে হৃদয় গলে যাওয়া যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, “করুণা কি?” এর উত্তর হয়তো হবে, “এটি হলো মৈত্রীঠিক সেইভাবে যদি প্রশ্ন করা হয়, “মৈত্রী কি?” উত্তর হবে, ‘এটি হলো করুণাএই হলো দুই গুণধর্মের সম্পর্ক চারি ব্রহ্মবিহারের প্রথম হলো মৈত্রী একজন প্রকৃত বন্ধুর বৈশিষ্ঠ্য বর্ণিত হয়েছে যার মধ্যে মৈত্রীর গুণ বিদ্যমান মৈত্রী তিন দ্বারে প্রকাশ পায়:
 মনে মৈত্রীমেত্তা মনো কম্ম
 বাক্যে মৈত্রীমেত্তা বাচা কম্ম
 কায়ে মৈত্রী - মেত্তা মনো কম্ম

উপরে উল্লেখিত ‘মেত্তা মনো কম্ম’ হলো মৈত্রী ভাবনার মূল ভিত্তি ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’, ‘জগতের সকল প্রাণীর উপর মঙ্গল বর্ষিত হোক‘ মনের মধ্যে মৈত্রী ভাবনা বারবার করতে হবে এভাবেইসব প্রাণীর সুখ  সমৃদ্ধি কামনা করে তারা বন্ধু হোক বা শত্রু হোকসমানভাবে মৈত্রী ভাবনা করতে হবে আর এটাই হলো মৈত্রী
বৌদ্ধধর্মে সম্যক জীবনের জন্য চারি ব্রহ্মবিহার অনুশীলন করতে বলেছেন উপরে উল্লেখিত ‘মৈত্রী’ হলো প্রথম ব্রহ্মগুণ প্রথম ব্রহ্মগুণ ‘মৈত্রী’ অনুশীলন ক্রমাগত করার পর উন্নতি হলে তারপর আসে ‘করুণা’ অনুশীলন যা হলো ‘মৈত্রী প্রত্যক্ষ রূপ যা ধীরে ধীরে দেখা দেয় এরপর মনকে আরো বেশী ভাবনায় নিয়োজিত করতে হয় তৃতীয় ব্রহ্মগুণ ‘মুদিতা’ মনে প্রতিষ্ঠা করতে চতুর্থ ব্রহ্মগুণ হলো ‘উপেক্ষা‘ ‘মুদিতা’ হলো সেই সামর্থ্য গড়ে তোলা অপরের সুখে সুখী হওয়া এবং তাদের আরো বেশী সুখ সমৃদ্ধি কামনা করা মানুষের জীবন অষ্ট লোকধর্মে ঘেরালাভ-ক্ষতিনিন্দা-প্রশংসাযশ-অযশসুখ-দুঃখ এই আটটির জীবনে আসতে থাকে একের পর এক এসব  জীবনে আসলে ‘উপেক্ষা’ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে বিচলিত না হয়ে স্থির হয়ে এসবে মুখোমুখি হতে হবে এভাবে ধীরে ধীরে ‘উপেক্ষা’ ব্রহ্মগুণ মনে স্থাপিত হয়ে গিয়ে জীবনকে ঠিকভাবে চালাতে শেখায়
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুস্পষ্ঠভাবে বোঝা দ্বিতীয় ব্রহ্মগুণ ‘করুণা’ কে ‘করুণা সমার্থক আরো দুটি শব্দ আছে ‘দয়া’  ‘অনুকম্পা অন্যদিকে, ‘কৃত্রিম করুণা’ (Pseudo Virtues) প্রকাশ দেখা যায় মানুষের মধ্যে যা অত্যন্ত বিশ্রী দেখায় অনেকেই সহানুভূতির অভিনয় করে যখন মানুষেরা দুঃখ-কষ্টে পড়ে এসব মানুষরা  দুঃখভাব দেখায় দুঃখে পড়া মানুষদেরপ্রত্যক্ষ সাহায্য সহযোগিতা না করেদোষ দেয় প্রকৃতিকে বা বসুন্ধরা দেবীকে দেখিয়ে দেয় এসব সমস্যা সৃষ্টির জন্যএসব কিন্তু সত্যিকার করুণা নয় এগুলো হলো করুণার বিপরীত  ধরনের মিথ্যা করুণা চিন্তা কর্মের একসময় বিপজ্জনক কর্ম বিপাক বয়ে আনে কৃত্রিম অভিনয়ে করুণাকারীদের
করুণা’ আলোচনায় প্রায় সময় জিজ্ঞেস করে মানুষরাযখন সাপ ব্যাঙকে ধরেকারো কি উচিত ব্যাঙের জীবন বাঁচানো বা বিড়ালের মুখের দাঁতে চেপে ধরা কাঠ বিড়ালটিকে যাহোকদেখা যায় যে যে বিড়ালের মুখ থেকে কাঠ বিড়ালটিকে বাঁচাতে চাইছেতিনি আবার উদাসীন থাকেনযখন বিড়ালটি ইদুঁরকে ধরে
করুণা বিপরীত হলো হিংসা (দুঃখ-কষ্টের কারণ) চারি আর্যসত্যের দ্বিতীয় আর্যসত্য হলো সম্যক সংকল্প (Right Intention) সম্যক সংকল্প তিনটি .নৈষ্ক্রম্য সংকল্প .অব্যাপাদ সংকল্প অবিহিংসা সংকল্প অবিহিংসা চর্চা হলো যা হিংসার বিপরীত হিংসা সংকল্প হলো অন্য কাউকে আঘাত করার ইচ্ছা বা অন্যকে ক্ষতি করার কারণ হয়ে ওঠা যারা বোধিলাভের জন্য মার্গসাধনা করেনসম্যক সংকল্প সবসময় অনুশীলন করে যেতে হবে বৌদ্ধধর্মে কোন স্থান দেয়া হয়নি নাহ নিষ্ঠূর চেতনা নিয়ে কারো আঘাত বা ক্ষতি করানাহ কোন প্রাণীকে চেতনা নিয়ে হত্যা করা সে যে পরিস্থিতিতেই হোক
আরো সবসময় আলোচনায় আসে যে যখন একজন ব্যক্তিজীবনের শেষপর্যায়ে রোগাক্রান্ত অবস্থায় চিকিৎসারতবিশেষ করেচিকিৎসা যন্ত্র দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়অথচ উনি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেনসে অবস্থায় দয়া-পরবশ হয়ে যদি সে যন্ত্রটি নিয়ে ফেলা হয়সেটা অকুশল কর্ম হবে কিনাএটা মানুষ  প্রাণী উভয়ের ক্ষেত্রে ঘটে এটির উত্তরও আগেরটির মতো আমাদের কোন অধিকার নেইঅন্যপ্রাণীর জীবন হরণ করার ঠিক একইভাবে অন্য একটি প্রশ্ন সবসময় করা হয় যারা সিদ্ধান্ত নেন যে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার (Life support) যন্ত্রটি খুলে নেয়া হয় সেই যন্ত্রণাগ্রস্থ রোগীটি থেকেতারা কোন অকুশল কর্ম করে কিনা যেহেতু আগেই উল্লেখ করেছি যে এই প্রশ্নের উত্তর বৌদ্ধধর্মের নীতির আলোকে বিবেচনা করা উচিত অনেক কারণের একটি এটি হয়তো এজন্য বুদ্ধ বলেছেন যে জীবন নিজেই বিপজ্জনক (Life itself is in dangerous
আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো বৌদ্ধধর্মে করুণা যা দুই প্রধান ভাগে ভাগ করা যেতে পারে:
 জাগতিক করুণা (Worldly Compassion)
 লোকোত্তর করুণা (Supermundane Compassion)
উপরের দুটিকে আবার নিম্নরূপ ভাবে ভাগ করা যেতে পারে:
 করুণা মনো কম্ম (Compassionate Thought)
 করুণা বাচা কম্ম (Compassionate Word)
 করুণা কায় কম্ম (Compassionate Action)
পৃথিবীর মানুষের মধ্যে করুণা দেখতে পাওয়া সাধারণত একে অপরের সম্পর্কের মধ্যেবর্ণে বর্ণেজাতিতে জাতিতেগোত্রে গোত্রে অথবা বাহ্যিক সৌন্দর্যে এসব করুণা দেখা যায় কারণ ‘সে আমার আত্মীয়’ অথবা ‘সে আমার বন্ধু’, ‘সে আমার শ্রেণীরগোত্রেরবা জাতির’- আর সেজন্যই মনে দেখা দেয় এই ভাবনাআমাকে তাকে করুণা দেখাতেই হবে‘ আবার হয়তো তার আত্মীয় নয় কিন্তু সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে রাগ চেতনার কারণে করুণা প্রদর্শন করে এগুলো হলো জাগতিক মন কর্ম  জাগতিক কায় কর্ম
তথাগত বুদ্ধ পিতা-মাতাকে ব্রহ্মার সঙ্গে তুলনা করেছেন ব্রহ্মা মৈত্রীকরুণামুদিতা  উপেক্ষা সর্ব প্রাণীর প্রতি সমানভাবে বিতরণ করেন পিতা-মাতারাও সন্তানের প্রতি ব্রহ্মার মতো এই চার গুণ বিতরণ করেন সন্তান যখন ভীষণ কষ্ট বা বিপদে পড়েপিতা-মাতারাই এতো বেশী কষ্ট পায়যা বর্ণনাতীতঅন্য কেউ পায় না সেরকম তাদের দ্বারা সর্বোচ্চ সম্ভব আত্মত্যাগ করে তাদের সন্তানদের কল্যানের জন্য এটা সম্ভব হয় পিতা-মাতার অসীম করুণা চিত্তের কারণে এই গুণকে বলা হয় জাগতিক করুণা
জাগতিক করুণার অন্য আরেকটি অনন্য উদাহরণ হলো কালগত জ্ঞাতিদের উদ্দেশ্যে পুণ্যদান ত্রিপিটক শাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে কালগত জ্ঞাতীদের উদ্দেশ্যে দানাদি কুশলকর্মজনিত পুণ্যরাশি দান হলো মহাকরুণা কর্ম যারা ইহলোক ছেড়ে পরলোক চলে গেছেনতাদের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তিস্নেহভালোবাসার জন্যই এরকম পুণ্যদান সম্পাদন করা হয় আমাদের পরলোকগত জ্ঞাতী যে কতো আপনযা কালগত জ্ঞাতীর উদ্দেশ্যে পুণ্যদানেই বোঝা যায় কষ্টার্জিত অর্থে এরকম পুণ্যকর্ম অন্যসময় তারা করেন না সাধারণত এজন্য বলে রাখা দরকার যে দানাদি পুণ্যকর্মগুলো সম্পাদন করতে হবে আমাদের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে আর কালগত প্রিয় জ্ঞাতীকে দুঃখপূর্ণ স্থান থেকে রক্ষা করার জন্য হয়তো তারা সেখানে জন্মগ্রহণ করতে পারে-এরকম চেতনা রেখে এটি হলো করুণাপূর্ণ চেতনা যা কাউকে পুণ্যকর্ম সম্পাদন করতে শ্রদ্ধান্বিত করে যার ভিত্তি জাগতিক মনো করুণা
আরেক দিক হলোসকল প্রাণীর প্রতি করুণা  দয়া প্রদর্শন করেন তথাগত বুদ্ধঅরহত আর বোধিসত্ত্ব আর একেই বলা যেতে পারে লোকুত্তর করুণা তাদের শুদ্ধচেতনা হলো সকল প্রাণীকে রক্ষা করা এটা কোন স্বার্থপর চেতনা কিংবা ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয় কিংবা সুনাম বা সম্মানের জন্য ভগবান বুদ্ধ তাঁর ধর্মে একে অভিহিত করেছেন ‘লোকুত্তর করুণা’ বা ‘মহাকরুণা’ হিসেবে
সে অনেক অনেক কল্প আগে দীপঙ্কর বুদ্ধের সময়ে গৌতম বুদ্ধ সুমেধ তাপস নামে বসবাস করছিলেন একদিন দীপঙ্কর বুদ্ধের কাছে সদ্ধর্মশ্রবণ করার পর বুঝতে পারলেনঅরহত্বফল লাভ করে সংসার থেকে মুক্তি পেয়ে যাবার সুযোগ সমাগত কিন্তু আর্য সুমেধ তাপসের ইচ্ছে হলো সম্যক সম্বুদ্ধ হতে যাতে করে তিনি অসংখ্য ভবদুঃখ সংসারে নিমজ্জিত প্রাণীকে রক্ষা করতে পারেন আর সেজন্যই তিনি দীপঙ্কর বুদ্ধের পদতলে প্রার্থনা করলেন বোধিসত্ত্বরূপে জন্মগ্রহণের জন্যকেননা তাঁর বুকে জন্মেছিলো মহাকরুণা সেদিন সকল প্রাণীর প্রতি আর সম্যক সম্বুদ্ধ হতে বোধিসত্ত্ব হয়ে জন্মগ্রহণ করে সংসারের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্যদিয়ে জীবন অতিক্রম করেন
অন্তিম জন্মে বুদ্ধত্ব লাভের পর সাত সপ্তাহবুদ্ধের মনের মধ্যে অসীম করুণায় ভরে ওঠে আর প্রথমেই দিব্যচক্ষুতে খুঁজতে থাকেন দুই মহান ঋষিকে যাদের ছিল খুবি তীক্ষ্ণ ধর্মজ্ঞান  আরো ধর্মজ্ঞান গ্রহণের ইচ্ছাআলাঢ় কালাম  উদকারাম পুত্র কিন্তু দেখলেন দুজনেই এই ধরাধাম ছেড়ে গেছেন এবং পরলোকে জন্মগ্রহণ করেছেন এরপর পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদের দেখতে পেলেন যারা বুদ্ধের সত্যের সন্ধানের যাত্রায় সেবা  সহযোগিতা করেছেন বুদ্ধ পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদের অমৃতময় ধর্মদেশনা দিলেন এবং নির্বাণ লাভ করতে অনুশীলনের পথ দেখালেন কৃতজ্ঞতা  করুণা চিত্ত থেকে সেইদিন থেকে বুদ্ধ সর্বজ্ঞতা জ্ঞান ব্যবহার শুরু করলেনখুঁজতে লাগলেন রাত-দিন ধর্মপিপাসু উপাসক-উপাসিকাদের যারা বুদ্ধের ধর্মের দ্বারা উপকার লাভ করবেন এবং যারা প্রস্তুত নির্বাণ লাভ করার জন্য  সামর্থ্যবান বুদ্ধ হাজার মাইল পায়ে হেঁটে তাদের কাছে গিয়ে ধর্মপ্রচার করেছেন এবং পথ দেখিয়েছেন কিভাবে নির্বাণ লাভ করা যায়
মহাকারুণিক বুদ্ধ রক্ষা করেছেন অসংখ্য প্রাণীকে দুঃখ-দুর্দশা থেকে তন্মধ্যে ছোট ছেলে সোপাক যার মামা/কাকা রেখে এসেছিলো শ্মশানে সে ভয়ে প্রচণ্ডভাবে কম্পিত হয়ে পড়ে মৃতদেহগুলো আর কঙ্কাল দেখেহয়ে পড়েন মৃতপ্রায় বুদ্ধের মহাকরুণায় সে রক্ষা পায় দস্যু অঙ্গুলিমাল যার আসল নাম ছিল অহিংসক শিক্ষকের ভুল উপদেশে নিষ্পাপ অহিংসক হয়ে ওঠেন হিংসক একসহস্র বৃদ্ধাঙ্গুলী গুরু দক্ষিণার জন্য মানুষ হত্যা করে সংগ্রহ করছিল বৃদ্ধাঙ্গুল শেষজন ছিলো মাতৃদেবী বুদ্ধ দিব্যচক্ষুতে দেখলেন অঙ্গুলিমাল মাকে হত্যা করে পঞ্চনন্তরীয় কর্ম সম্পাদন করে অবীচি নরকে পতিত হয়ে অনন্ত দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করবেন বুদ্ধের করুণা চিত্তে দস্যু অঙ্গুলিমাল রক্ষা পেলেন পটাচারা রক্ষা পায় বুদ্ধের মহাকরুণায় তাঁর মাতা-পিতাভাই আর দুই সন্তান দৈব-দুর্বিপাকে মারা যায় আর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে একসময় রজ্জুমালা যিনি মালা নামে পরিচিত ছিলেন নির্দয় গৃহকত্রী তাঁর চুল কেটে দেন তাঁকে দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়যার গায়ে ছিল বেত্রাঘাতের চিহ্ন বুদ্ধ তাঁকে মহাকরুণা চিত্তে রক্ষা করেন সুনেথা যিনি ছিলেন অতি নিম্নবর্ণের শ্রমিক তাঁকেও রক্ষা করেন মৃষ্টকুণ্ডলী একধনী পিতার সন্তান অথচ পিতার কৃপণতার কারণে ঠিকমতো চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং মৃত্যুর পর সুগতি লাভ করেন কারণ মৃত্যুর আগমুহূর্তে বুদ্ধ জ্যোতি ছড়িয়ে দেয় তার চোখে আর মৃষ্টকুণ্ডলীর বুকে বুদ্ধের প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে উপরোল্লিখত উদাহরণ দেখায় ত্রিলোক পূজ্য তথাগত বুদ্ধের কতো গভীর ছিলো মহাকরুণাময় চিত্ত
একসময় ভারতের শাক্য  কোলিয় দুই গোত্র যখন একেবারে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত যার কারণ ছিলো রোহিনী নদীর জল ভাগাভাগি নিয়ে সেই ভয়ংকর সময়ে বুদ্ধ উপস্থিত হলেন সেখানে মহাকরুণা চিত্ত নিয়ে ধর্মদেশনায় যুদ্ধ থামিয়ে দিয়ে শান্তি স্থাপন করে দিলেন আরেকবারশ্রীলংকায় চুলধর  মহাধর দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেল হীরার আসন নিয়ে বুদ্ধের মহাকরুণা সমাপত্তিতে দেখলেন যে এক বড়বিপদ আসন্ন ঋদ্ধিবলে মহাকারুণিক বুদ্ধ উপস্থিত হলেন সেখানে এবং দেশনা দিয়ে মিলিয়ে দিলেনশান্তি স্থাপন করে দিলেন এবং রক্ষা করলেন অসংখ্য মূল্যবান প্রাণ
একসময় তিষ্য নামক এক ভিক্ষু পুঁজযুক্ত একজিমা রোগে ভুগছিলেন এবং কেউ তাকে সেবা শুশ্রুষা দিতে আগ্রহী ছিলেন না এবং অন্য এক ভিক্ষু প্রচুর পেটের ব্যথায় ভুগছিলেন বুদ্ধ নিজে গিয়ে করুণাচিত্তে তাদের সেবা দিয়ে রোগ মুক্ত করেন এবং সুস্থ করে তোলেন  উদাহরণ সুস্পষ্ট দেখায়রোগীদের সেবা করা কতো গুরুত্বপূর্ণ এবং পথ্যাদি (গিলানপচ্চয়দেয়া বুদ্ধ ভিক্ষুদের উপদেশ দিলেন এই বলে যে রোগীকে সেবা করবেসে বুদ্ধের সেবা করবে এভাবেই নিজে উদাহরণ রেখে যান আগামী প্রজন্মের জন্য
 

বুদ্ধের অপ্রমেয় করুণায় আলব নগরের এক রাজপুত্র রক্ষা পান যাকে জীবন দিয়ে দিতে হচ্ছিল আলবক যক্ষের কাছে পরে রাজপুত্র অনাগামী মার্গফল লাভ করেন আর আলবক যক্ষ লাভ করেন স্রোতাপন্ন মার্গফল

দুঃখ-দুর্দশায় পতিত মানুষই শুধু রক্ষা পায়নি বুদ্ধের মহাকরুণা থেকে অসংখ্য প্রাণীও রক্ষা পায় একবার বুদ্ধ পিণ্ডাচরণে রত ছিলেনসেসময় এক নারী হস্তী এসে বুদ্ধের পায়ে পড়লেন আর কাঁদতে লাগলেন বুদ্ধ বুঝতে পারলেন হস্তীটির দুঃখ-কষ্ট আর বুদ্ধের করুণাময় ধর্মবাক্যে শান্ত করলেন এবং পিণ্ডাচরণের জন্য রাজপ্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেলেন আর বুদ্ধ ধর্মদেশনা দিলেন ‘কৃতজ্ঞতা’ বিষয়ে ভগবান বুদ্ধ রাজাকে বুঝিয়ে দিলেন যে বৃদ্ধ ভদ্রবতিকা হস্তী একসময় রাজার বিশ্বস্ত হস্তী হিসেবে রাজহস্তী হয়ে কাজ সম্পাদন করেন যখন সে শক্তিশালী ছিলোএখন সে হস্তী পরিত্যক্ত কারণ সে বৃদ্ধতার জন্য কোন কিছু করতে পারছে না এবং নানা রোগে  বার্ধক্যে কষ্ট পাচ্ছে বুদ্ধ বললেন যে এটা উচিত নয় এরকম করা রাজার মধ্যে সম্যক উপলব্ধি এলো তাঁর ভুলের এবং নির্দেশনা দিলেন প্রাণীদের জন্য সমস্ত কিছু সংরক্ষণের যা তাদের প্রয়োজন
অন্য আরেকটি ঘটনা 
একদিন বুদ্ধ দেখতে পেলেন কিছু তরুণ ছেলেরা নিষ্পাপ এক সাপকে নিয়ে নির্দয় খেলা করছে বুদ্ধ তাদের কাছে গেলেন এবং জিগ্যেস করলেনতোমাদের কেমন লাগবে যদি সাপের জায়গায় সরিয়ে তোমাদের রাখা হয়আর অন্য একদল ছেলেরা তোমাদের একইভাবে আঘাত করেএভাবেই বুদ্ধ তাদের ভুলকর্মকে দেখিয়ে দিলেন বুদ্ধ শিশু-কিশোরদের শিক্ষা দিলেন যে আমরা নিজেরা যদি ব্যথা অনুভব করিদুঃখ-কষ্ট শিকারীদের যখন তারা অত্যাচারিত হয়তখনই অপরের নির্দয়তার কারণ নির্মূল করতে পারবো অত্যাচারের অস্ত্র উৎপাটন করেআমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে সকল প্রাণীর শারীরিক  মানসিক কল্যাণে এটাই হলো মহাকরুণা যা তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছেন
সেরূপ করুণাপূর্ণ সামর্থ্যবান জীবন পেতে একজন মানুষকে মনকে উন্নতি করতে হবে প্রথমেইআমাদের অনুশীলন করতে হবে মনো কম্ম বা করুণা স্মৃতি অনুশীলন এভাবে:
সকল প্রাণী দুঃখ  ভয় থেকে মুক্ত হোক
সকল প্রাণী স্বাস্থ্যবান  ভালো থাকুক
সকল প্রাণী দুঃখহীন হোক
নিচের গাথাটি আমাদের পূর্বপুরুষগণ দ্বারা বারবার পাঠ করা হতো:
দুক্খাপত্তা  নিদুক্খা => যারা দুঃখে নিপতিত হয়েছেনতারা দুঃখহীন হয়।।
ভয়প্পত্তা  নিবভয়=> যারা ভীত সন্ত্রস্ততারা ভয়হীন হোক
সোকপ্পত্তা  নিসসোক=> যারা শোক প্রাপ্ততারা শোকহীন হোক
হোন্তু সব্বেপি পানিনো => সকল প্রাণী দুঃখভয়  শোক মুক্ত হোক
উপরের প্রজ্ঞাময় অনুশীলন করা যেতে পারে মনোমুগ্ধকরউৎসাহভালোবাসাময় আর সহানুভূতিশীল বাক্যের ব্যবহার দ্বারা
চলুন আবার তাদের কথা স্মরণ করিযারা আছে দুঃখ-দুর্দশায় আর ভুগছেন ভীষণ কষ্টযেভাবে তথাগত বুদ্ধ দেখিয়েছেন আমাদের জীবদ্দশায়
চলুন আমরা দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করিবুদ্ধের এক অনুপম শিক্ষাএক মহৎ ব্রহ্মগুণ করুণা’ অনুশীলন চালিয়ে যাবো সারাটা জীবন
 
================================
 

ত্রিলোক পূজ্য তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধের পবিত্র দন্তধাতু, ও যে পবিত্র বোধিবৃক্ষের নীচে বুদ্ধত্ব লাভ করেন  তাঁর দক্ষিণ শাখা সম্রাট অশোক কন্যা ভিক্ষুণী সংঘামিত্রা কতৃক রোপিত পবিত্র বোধিবৃক্ষ আর থেরবাদী গুণোত্তম ভিক্ষু সংঘের সদ্ধর্মপ্রচারে প্রাণবন্তময় সমুদ্রঘেরা দেশ শ্রী লংকা। দ্বীপ দেশটির সর্বদক্ষিণে হাম্বানটোটা প্রদেশ আর এখানেই আছে প্রাকৃতিকভাবে নির্মিত অপূর্ব সুন্দর সমুদ্রবন্দর। হাম্বানটোটার আম্বালানটোটা গ্রামে সদ্ধর্মপ্রাণ উপাসক, সুনামধন্য ব্যবসায়ি স্বর্গীয় পিতা সুগতপাল পি. পি. গুরুগে ( Sugathapala P.P. Guruge) ও সদ্ধর্মপ্রাণা, পুণ্যবতী উপাসিকা স্বর্গীয় মাতা জি. এইচ. এম. আদলিননোনার (G.H. M Adlinnona) ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ের ধার্মিক পরিবারে জন্ম নেন শীল-বিনয়ী সাংঘিক ব্যক্তিত্ব, শাসন সদ্ধর্মে অতি আত্মত্যাগি, প্রচারবিমুখ, ভাবনাচার্য পরম পূজনীয় শ্রদ্ধেয় রাজকীয় পণ্ডিত কোলিত নায়কা মহাথেরো মহোদয়। শৈশবে গৃহত্যাগি হয়ে সন্ন্যাসধর্মে প্রব্রজ্যায় দীক্ষিত হন ২০ আগষ্ট ১৯৬৪ সালে  মহারাগামা শ্রী বজিরাঞানা ধর্মায়তনে, শ্রীলংকায় সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাংঘিক মহান ব্যক্তিত্ব ভিক্ষুসংঘের মহানায়ক অগ্রমহাপণ্ডিত শ্রী মাডিহে পঞ্ঞাসিহে মহাথেরোর নিকট। শ্রামণ্য গুরু শ্রদ্ধেয় সংঘনায়কের উপাধ্যায়িত্বে ও শ্রদ্ধেয় আমপিটিয়ে রাহূলা নায়কা মহাথেরো আচারিয়াত্বে  ঐতিহ্যবাহী পবিত্র ‘পালনে উদকুকচেপা সীমায়’ শুভ উপসম্পদা লাভ করেন ১৯৭১ সালের ৩০ জুন। খুব মেধাবি শ্রদ্ধেয় কোলিত মহাথেরো মহোদয় ‘রাজকীয় পণ্ডিত’ পরীক্ষায় সমগ্র শ্রীলংকায় প্রথম স্থান লাভ করেন এবং ‘বিনয়াচার্য’ ও ‘সদ্ধর্মচারিয়া’ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।

শ্রীলংকায় শাসন-সদ্ধর্ম প্রচুর অবদান রেখে নিরহংকারি, প্রচারবিমুখ, সদ্ধর্মদেশনায় সুপণ্ডিত শ্রদ্ধেয় ভান্তে ১৯৮৩ সালে সদ্ধর্ম প্রচারে আসেন আমেরিকায় ও প্রতিষ্ঠা করেন ক্যলিফোর্ণিয়া অঙ্গরাজ্যে নর্থ হলিউদে ‘শরৎচন্দ্র বুড্ডিস্ট সেন্টার’ ও পামডেলে ‘শ্রী পঞঞাসিহে ভাবনা কেন্দ্র’। শ্রদ্ধেয় এই গুণী ভান্তের শিষ্যত্ব লাভ করেছেন কয়েকজন আমেরিকান জন্মজাত সন্তান যারা সদ্ধর্ম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন।
********************************************************************
ভদন্ত কোলিত নায়কা মহাথেরো’  “Compassion in Buddhism” বইটির অনুবাদে রতন জ্যোতি ভিক্ষুশরৎচন্দ্র বুড্ডিস্ট সেন্টারনর্থ হলিউদক্যালিফোর্নিয়া
 




 

Post a Comment

0 Comments

Ad Code

Responsive Advertisement