অভিধর্ম পিটকের মনস্তাত্ত্বিক টিকা সমূহ
============================
লিখেছেন: উৎস বড়ুয়া জয়।
১. মোহঃ যদ্বারা সত্ত্বগণ মূহ্যমান থাকে, তাই মোহ বা অজ্ঞানতা। সূত্রপিটকে এটা অবিদ্যা আখ্যা প্রাপ্ত হয়েছে। অন্ধকার যেমন বস্তুনিচয়কে ঢেকে রাখে অনুরূপ মোহও চিত্তের কল্যাণ ও সত্যদৃষ্টিকে ব্যর্থ করে দেয়। আলম্বনের যথার্থ স্বভাবকে আচ্ছাদন করাই মোহের স্বভাব। কুশল কর্মের দিক দিয়ে মোহ অজ্ঞানতা বটে, কিন্তু পাপকর্ম সম্পাদনে নানা উপায় নির্দ্ধারণে ক্ষমতাসম্পন্ন বলে মোহ মিথ্যাজ্ঞান বা ‘কু-প্রজ্ঞা’। মোহ সর্ব অকুশলের মূল, সুতরাং “সর্ব অকুশল-চিত্ত-সাধারণ”। লোভ-দ্বেষের মূলও এই মোহ। প্রজ্ঞার প্রতিপক্ষ। অন্ধকার যেমন আলোকের অভাবাত্মক, মোহও তেমন প্রজ্ঞার অভাবাত্মক। আলোকের বৃদ্ধিতে যেমন অন্ধকার আপনা-আপনি হ্রাস পেতে থাকে, তেমনি প্রজ্ঞার বৃদ্ধিতে মোহ আপনা-আপনি হ্রাস পেতে থাকে। চিত্তের অন্ধতা উৎপত্তি মোহের লক্ষণ। আলম্বনের যথার্থ স্বভাব আচ্ছাদন এর কৃত্য। হেতুজ্ঞান বিরহিত আলম্বন গ্রহণ এর উৎপত্তির কারণ। এরূপে মোহ চারি আর্যসত্য ও প্রতীত্য সমুৎপাদ ধর্মকে জানতে দেয়না, বুঝতে দেয়না। মোহ শক্তিশালী হলেও ধ্বংসশীল। শ্রদ্ধাময় চিত্তের দান-শীল-ভাবনা দ্বারা প্রজ্ঞার ক্রমিক বৃদ্ধির সাথে সাথে মোহ বিলুপ্ত হতে থাকে।
২. বিতর্কঃ বিতর্ক অর্থ চিন্তা। আলম্বনে চিত্তকে আরোহণ করানো বিতর্কের কাজ। বিতর্ক তার সহজাত চৈতসিককে আলম্বনে যেন বহন করে নিয়ে যায়। ‘চেতনা’ আলম্বননির্বাচন করে যেন শকটারোহী। ‘মনস্কার’ সেই আলম্বনে লক্ষ্য রাখে যেন সারথি। কিন্তু ‘বিতর্ক’ সহজাত চৈতসিককে সেই আলম্বনে টেনে নিয়ে যায় যেন অশ্ব। মনস্কার কর্তৃক পরিচালিত হয়ে বিতর্ক বা চিন্তা যখন চিত্তকে চেতনা দ্বারা নির্বাচিত নির্বাণ আলম্বনে পরিচালনা করে, তখন এই বিতর্ক “লোকোত্তর সম্যক সংকল্প” আখ্যা প্রাপ্ত হয়। চিত্ত বিতর্ক দ্বারা আলম্বন গ্রহণ করলে অন্যান্য সম্প্রযুক্ত চৈতসিক আলম্বনে স্ব স্ব কার্য সম্পাদন করে। বিতর্ক “স্ত্যান-মিদ্ধের” প্রতিপক্ষ; এজন্য বিতর্ক ধ্যানাঙ্গ। অর্থাৎ ধ্যান চিত্ত গঠনের অন্যতম উপকরণভূত চৈতসিক।
৩. চিত্তঃ যা চিন্তা করে তাই চিত্ত। কি চিন্তা করে? বিষয় বা আলম্বন চিন্তা করে। এখানে ‘চিন্তা করে’ অর্থ আলম্বন গ্রহণ করে, আলম্বন জানে, আলম্বন অবগত হয়। আলম্বন কী! আলম্বন হল জড় বা অজড় যাকে অবলম্বন করে চিত্ত উৎপন্ন হয় তাই আলম্বন, অবলম্বন, আরম্মণ বা বিষয় হিসেবে পরিচিত। চিত্ত, মন, বিজ্ঞান এরা একার্থবোধক। এদের যেকোন একটি অন্য দুটির প্রতিশব্দ রূপে ব্যবহৃত হয়। তাদের লক্ষণ যথাক্রমে চিন্তন, মনন ও বিজানন; এরাও একার্থবোধক। আলম্বন বিজানন চিত্তের স্বভাব। চিত্ত প্রধানত চার প্রকার। যথা- কামাবচর চিত্ত, রূপাবচর চিত্ত, অরূপাবচর চিত্ত এবং লোকোত্তর চিত্ত।
১. কামাবচর চিত্তঃ যেসব চিত্ত রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ ও স্পর্শ আলম্বন বা অবলম্বন করে কাম তৃষ্ণার সম্পর্কিত হয়ে উৎপন্ন হয় তাই কামাবচর চিত্ত। কামাবচর চিত্ত চার প্রকার। যথা- কুশল, অকুশল, বিপাক ও ক্রিয়া চিত্ত।
২. রূপাবচর চিত্তঃ কাম তৃষ্ণা বর্জিত হয়ে ধ্যানের মাধ্যমে লব্ধ রূপাবচর ধ্যানচিত্তই রূপাবচর চিত্ত। রূপাবচর চিত্ত ত্রিবিধ। যথা- কুশল, বিপাক ও ক্রিয়া চিত্ত।
৩. অরূপাবচর চিত্তঃ চার অরূপ ব্রহ্মলোককে অবলম্বন করে অরূপাবচরের যে পঞ্চম ধ্যানিক চিত্ত উৎপন্ন হয় তাই অরূপাবচর চিত্ত। এটা কুশল, বিপাক ও ক্রিয়া ভেদে ত্রিবিধ চিত্ত।
৪. লোকোত্তর চিত্তঃ সংস্কার ও বর্হিজগতের প্রভাবিত আলম্বন পরিত্যাগ করে যেই চিত্ত নির্বাণকে অবলম্বন করে উৎপন্ন হয় তাহাই লোকোত্তর চিত্ত। এটা দ্বিবিধ। যথা- মার্গ চিত্ত ও ফল চিত্ত।
৪. বিচারঃ বিতর্ক দ্বারা চিত্ত যেই আলম্বন গ্রহণ করে বিচার সেই আলম্বনের সক্ষাব জানবার জন্য তম্মধ্যে পুনঃ পুনঃ নিমর্জন পূর্বক সেই আলম্বনে প্রবর্তিত (উৎপাদিত) হতে থাকে। অনুমর্জন এর লক্ষণ। কোন মলিন পাত্র পরিস্কার করবার জন্য এক হাত দ্বারা পাত্র গ্রহণ ও ধারণ করে রাখা বিতর্কের কাজের সাথে তুলনীঢ এবং অন্য হাত দ্বারা পুনঃ পুনঃ ঘর্ষণ বিচারের কাজের ন্যায়। বিচার বিচিকিৎসার প্রতিপক্ষ, তাই এটা ধ্যানাঙ্গ।
৫. ঔদ্ধত্যঃ আলম্বন হতে চিত্তের উৎক্ষেপনই ঔদ্ধত্য। চিত্তের অশান্তি এর লক্ষণ, অস্থিরতা সম্পাদন এর কৃত্য, অব্যবস্থিততা এর পরিণাম ফল এবং অনুচিত মনস্কার এর মুখ্য কারণ। ভষ্ম স্তুপে দণ্ডাঘাত করলে ভষ্মরাশি যেমন উৎক্ষেপিত হতে থাকে এই চৈতসিকও চিত্তকে আলম্বন হতে পুনঃ পুনঃ উৎক্ষেপন করতে থাকে।
৬. মনস্কারঃ মনযোগ, মনোক্রিয়া ও মনসিকার অর্থে মনস্কার। মনস্কার মনকে পূর্বাবস্থা হতে ভিন্নাবস্থাপন্ন করে। এটা ত্রিবিধ অবস্থায় সম্পাদিত হয়। যথা-
১. আলম্বন প্রতিপাদক (পরিচালক) মনস্কারঃ মনস্কার প্রতিসন্ধি চিত্ত হতে প্রবহমান চিত্ত সন্ততি পুনঃ পুনঃ আলম্বন যুক্ত হয়ে নিরুদ্ধ হলেও পুনঃ পুনঃ ভবাঙ্গ আলম্বনে যুক্ত হয়। সারথি যেমন অশ্বকে লক্ষ্যস্থলে পরিচালনা ও উপস্থাপনা করে এই মনস্কারও চিত্তকে আলম্বনে পরিচালন ও সংযোগ করে।
২. বীথি প্রতিপাদক মনস্কারঃ ভবাঙ্গ আলম্বন পরিত্যাগ করে যখন চিত্ত পঞ্চদ্বারে আবর্তিত হয়, তখন মনস্কার চিত্ত সন্ততিকে আলম্বন অভিমুখী করে রাখে। এটা বীথি প্রতিপাদক মনস্কার।
৩. জবন প্রতিপাদক মনস্কারঃ মনোদ্বারাবর্তন মনসিকার আলম্বনকে জবন অভিমুখী করে রাখে। এটা জবন প্রতিপাদক মনস্কার।
চৈসিককে আলম্বনে পরিচালনায় মনস্কার সারথি সদৃশ। ‘চেতনা’ আলম্বন নির্দেশ করে, কিন্তু মনস্কার সেই আলম্বনে লক্ষ্য রাখে। মনস্কারের এরূপ ক্রিয়া বাইরের আলম্বনের উত্তেজনায়ও হতে পারে অথবা স্বতঃই অভ্যন্তর হতে উৎপন্ন হতে পারে। এই মনস্কারেই চিত্তের প্রথম ক্রিয়া আরম্ভ হয়। পঞ্চ দ্বারাবর্তন চিত্তে মনস্কারের প্রাধান্যই বিদ্যমান। চিত্ত যে আলম্বন গ্রহণ করে এ বিষয়ে তার নিত্য সহায় ‘মনস্কার’। মনস্কার চিত্তকে আলম্বন শূন্য হতে দেয়না।
৭. পঞ্চ নীবরণঃ পঞ্চ নীবরণ হলো চিত্তের পাঁচ প্রকার বন্ধন বা বাধা, যাদের কারণে অনুৎপন্ন কুশল উৎপন্ন হতে পারেনা এবং উৎপন্ন কুশল বৃদ্ধি পেতে পারেনা। তাদের সাধারণ নাম আবরণ। এগুলো পাঁচ প্রকার। যথা-
১. কামচ্ছন্দঃ পঞ্চ কামগুণের প্রতি আসক্তিকে কামচ্ছন্দ বলা হয়। রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ ও স্পর্শাদি আলম্বনে চিত্তকে আকর্ষণ করে রাখাই এর কাজ। বর্জনীয় বিষয় অপরিত্যাগই কামচ্ছন্দের লক্ষণ।
২. ব্যাপাদঃ অপরের অমঙ্গল চিন্তা, সঙ্কীর্ণতা, ক্রোধ, হিংসা ও ঈর্ষা বশে ক্ষতি সাধনের ইচ্ছা এবং ক্ষতি সাধন করাই ব্যাপাদ। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করাও ব্যাপাদ। সৎকাজে অনিচ্ছা প্রকাশ করা ব্যাপাদের লক্ষণ।
৩. স্ত্যান-মিদ্ধঃ চিত্তের অলসতা, অকর্মণ্যতা, অনুৎসাহ, অবসাদ প্রভৃতি অবস্থাকে বুঝায়। স্ত্যান-মিদ্ধ চিত্ত কুশল চিত্ত গ্রহণে কেবল শক্তিহীন নয়, অনিচ্ছুকও বটে। চিত্তের পরাক্রম বিনাশ করাই স্ত্যান-মিদ্ধের কাজ।
৪. ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্যঃ অহংকার, ক্ষেদ, অনুশোচনা, অনুতাপ এবং এদের থেকে সৃষ্ট উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগই ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য। চিত্তের অশান্তি সৃষ্টি এর লক্ষণ এবং অস্থিরতা সম্পাদন এর কৃত্য। কুশল কর্ম করা হলনা, অকুশল কর্ম করা হল বলে চিত্ত ক্ষোভই কৌকৃত্য।
৫. বিচিকিৎসাঃ সংশয়, সন্দেহ, দ্বিমত, এটা না ওটা এরূপে দোদুল্যমান চিত্তের অবস্থাকে বিচিকিৎসা বলা হয়। চিত্তের অস্থিরতা এর কারণ। কোন বিষয়ে মীমাংসার অক্ষমতা বিচিকিৎসার কারণ।
৮. কর্ম্মপথঃ যা দ্বারা কর্ম বা সংস্কার উৎপত্তি হয় তাই কর্মপথ। কর্মপথ প্রধানত দুই প্রকার। যথা- কুশল কর্মপথ ও অকুশল কর্মপথ।
১. কুশল কর্মপথঃ দান, শীল, ভাবনা, অপচায়ন বা সম্মান, সেবা, পুণ্যদান, পুণ্যানুমোদন, ধর্মশ্রবণ, ধর্মোপদেশ ও দৃষ্টি ঋজুতা বা সত্যজ্ঞান সঞ্চয় এই দশ প্রকার কর্ম কুশল কর্শপথ। এই কুশল কর্ম সম্পাদনে সময় চিত্ত অষ্ট মহাকুশল চিত্তের যেকোন একটি অবস্থাকে নিয়ে সম্পাদিত হয়। দশ কুশল কর্মপথের সাথে আট মহাকুশল চিত্তের এর সম্পর্ক।
২. অকুশল কর্মপথঃ অকুশল কর্মপথ দ্বিবিধ। যথা- লোভমূলক ও দ্বেষমূলক। চুরি, কামাচার, মিথ্যাবাক্য, পিশুনবাক্য, সম্প্রলাপ, অভিধ্যা ও মিথ্যাদৃষ্টি এই সাতটি লোভমূলক কর্ম। এই সপ্তবিধ লোভমূলক অকুশল কর্মের প্রত্যেকটি আট প্রকার লোভমূলক চিত্তের মধ্যে যেকোন এক প্রকার চিত্তাবস্থা নিয়ে সম্পাদিত হয়ে থাকে। সুতরাং চিত্তোৎপত্তির আকারে লোভ চিত্ত অষ্টবিধ হলেও সপ্তবিধ কর্মপথ প্রাপ্তিতে এটা ছাপ্পান্ন প্রকার হয়। দ্বেষমূলক কর্মপথ হলো প্রাণীহত্যা, চুরি, মিথ্যাবাক্য, পিশুনবাক্য, পরুষবাক্য, সম্প্রলাপবাক্য ও ব্যাপাদ। এগুলোর যেকোন একটা কার্য সম্পাদন কালে চিত্ত দ্বিবিধ দ্বেষমূলক চিত্তের মধ্যে যেকোন একটির অবস্থা প্রাপ্ত হয়। প্রাণীবধ অনেক সময় লোভ হেতুজ বলে মনে হয়। বাস্তবিক পক্ষে প্রাণীবধের সাথে লোভের হেতু সম্বন্ধ নহে; “উপনিশ্রয়” সম্বন্ধ।
জীবিতেন্দ্রিয় ছেদন মুহূর্তে ঘাতকের চিত্তে প্রতিঘই ক্রিয়াশীল থাকে, লোভ অনুৎপন্ন থাকে। মাংসের জন্য লোভ বটে, কিন্তু বধ ক্রিয়াটি সম্পূর্ণ দ্বেষমূলক।
৯. প্রতিসন্ধিঃ মরণাসন্ন বীথিতে জবনচিত্ত দুর্বলভাবে উৎপন্ন হয় এবং পাঁচ চিত্তক্ষণ মাত্র আশা করা যেতে পারে। সেজন্য মরণের সময় চিত্ত বীথিতে যখন আলম্বন প্রকৃত প্রস্তাবে উপস্থিত হয়, তখন প্রতিসন্ধি চিত্তের এবং ভবাঙ্গের কয়েকক্ষণ ঐ উপস্থিত আলম্বন গ্রহণের যোগ্য অবস্থা প্রাপ্ত হয়। এই কারণে কামলোকে প্রতিসন্ধি গ্রহণের সময় ছয় দ্বারের যেকোন এক দ্বারের সাহায্যে বর্তমান বা অতীত আলম্বন আকারে “কর্মনিমিত্ত” বা “গতিনিমিত্ত” উপলব্ধ হয়। কিন্তু কর্ম শুধু অতীত আলম্বনাকারে একমাত্র মনোদ্বারেই গৃহীত হয়। এগুলো সমস্তই কামাবচরের আলম্বন।
রূপাবচরের প্রতিসন্ধির সময় প্রজ্ঞপ্তির আকারে “কর্মনিমিত্ত” আলম্বন হয়। যেরূপ অরূপাবচরের প্রতিসন্ধির সময় মহদ্গতের আকারে বা প্রজ্ঞপ্তির আকারে “কর্মনিমিত্ত” যথাযোগ্য (প্রতিসন্ধি চিত্তানুরূপ) আলম্বন গ্রহণ করে।
শুধু জীবিতেন্দ্রিয় এবং অবিনিভাজ্য রূপের “শুদ্ধাষ্টক” প্রতিসন্ধির আকারে অসংজ্ঞ সত্ত্বগণের মধ্যে আবির্ভূত হয়। সেজন্য তাদেরকে রূপ-সন্ধিক বলা হয়।
অরূপলোকে যাদের প্রতিসন্ধি হয় তারা অরূপ প্রতিসন্ধিক। অবশিষ্টের রূপারূপ প্রতিসন্ধিক।
১০. দৃষ্টিঃ এখানে দৃষ্টি হলো মিথ্যাদৃষ্টি। বাষট্টি প্রকার মিথ্যাদৃষ্টির বিস্তারিত বর্ণনা দীর্ঘ নিকায়ের “ব্রহ্মজাল সূত্রে” পাওয়া যায়। লোভনীয় আলম্বনকে শুভ, সুখ, নিত্য ও আত্মা বলে গ্রহণই দৃষ্টির লক্ষণ বা স্বভাব। অসদ্ধর্ম শ্রবণ, পাপমিত্রের সংসর্গ, আর্যগণের অদর্শনেচ্ছা ও অহেতু মূলক চিন্তাই মিথ্যাদৃষ্টি উৎপত্তির কারণ। মিথ্যাদৃষ্টি মহাপাপ। এর পরিণাম বদ্ধমূল মিথ্যাধারণা। হেতুমূলক চিন্তাই এটা অপনোদনের উপায়। তীর্থস্থানে পাপ ধবংস, পুত্র মুখ দর্শন দ্বারা পুন্নাম নরক হতে পরিত্রাণের জন্য ভার্য্যা গ্রহণ ইত্যাদি কার্য যদি এরূপ অভিপ্রায়ে করা হয়, তবে চিত্ত মিথ্যাদৃষ্টি সহজাত হয়। কিন্তু যদি ঐরূপ কার্যাদি লাভজনক ও হিতকর নয় জেনেও শুধু আত্ম মর্যাদা রক্ষার্থে সম্পাদিত হয়, তবে সেটা ‘মান’ সম্প্রযুক্ত। মিথ্যাদৃষ্টিকেরা মনে করে তার অভিমতই সত্য; অন্য সব মিথ্যা। এরূপ মিথ্যায় অভিনিবেশ দৃষ্টির লক্ষণ। জ্ঞান আলম্বনকে এর যথার্থ স্বভাব পরিত্যাগ করে; অযথার্থ স্বভাব গ্রহণ করে। মোহ আলম্বনের যথার্থ স্বভাব ঢেকে রাখে, অযথার্থ স্বভাব প্রদর্শন করে। ‘লোভ’ সেই অযথার্থ স্বভাবের দিকে চিত্তকে আকর্ষণ করে; দৃষ্টি তা গ্রহণ করে। এরূপে লোভই প্রত্যক্ষভাবে দৃষ্টিকোণকে চালিত করে মিথ্যাদৃষ্টিতে পরিণত করে। এজন্য লোভের সাথে দৃষ্টির অব্যবহিত সম্বন্ধ। মিথ্যাদৃষ্টিকেরা পরকাল, কুশল-অকুশল ও কর্মফলকে বুঝতে পারেনা।
১১. সংস্কারঃ সংস্কার শব্দের সাধারণ নামই পুঞ্জ বা স্তুপ। সংস্কারকে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা- কর্ম সংস্কার ও চিত্তোৎপত্তি সংস্কার। কর্ম সংস্কার হলো কায়-বাক্য ও মনের দ্বারা কৃত সঞ্চিত কর্মরাশি। অর্থাৎ বেদনা ও সংজ্ঞার স্মৃতি বা রেশ চিত্ত গর্ভে প্রচ্ছন্ন শক্তির আকারে সঞ্চিত হলে সংস্কার নামে অভিহিত হয়। সংস্কার পুনর্জন্ম দাতা কুশল বা অকুশল কর্ম বা চেতনা। মূলতঃ লোভ, দ্বেষ, মোহ প্রভৃতি ৫০ প্রকার সৎ ও অসৎ মনোবৃত্তিকে সংস্কার, অকুশল সংস্কার ও আনেঞ্জাবি সংস্কার।
চিত্তোৎপত্তি সংস্কারে বলা হয়েছে যে, যেই চিত্ত আলম্বনের প্রভাব ব্যতীত কোনরূপ উৎসাহ ব্যতীত, ভিতর-বাহির কোথাও থেকে কোনরূপ উত্তেজনা ব্যতিরেকে শুধু স্বীয় স্বভাব হেতু, তীক্ষèভাবে উৎপন্ন হয় সেই চিত্ত অসংস্কারিক চিত্ত। সসংস্কারিক চিত্ত ধীর ভাবে, আলম্বন সমাগমে বা নিজের বা পরের উৎসাহ উত্তেজনা সাপেক্ষ হয়ে উৎপন্ন হয়। তাই সংস্কার ভেদেও চিত্ত অসংস্কারিক ও সসংস্কারিক দ্বিবিধ হয়েছে। সসংস্কারিক চিত্তের সঙ্গে “স্ত্যান-মিদ্ধ” চৈতসিক সংযুক্ত থাকে। এজন্য অসংস্কারিক চিত্ত সসংস্কারিক চিত্ত অপেক্ষা প্রবল।
১২. দ্বেষ চিত্তঃ দ্বেষ চিত্ত দুই প্রকার। যথা- ১. দৌর্মনস্য সহগত প্রতিঘ সম্প্রযুক্ত অসংস্কারিক চিত্ত এবং ২. দৌর্মনস্য সহগত প্রতিঘ সম্প্রযুক্ত সসংস্কারিক চিত্ত। দূষণ স্বভাব বিশিষ্ট চিত্তই দ্বেষচিত্ত। এটা দৌর্মনস্য সহকারে আলম্বনকে প্রতিঘ বা হনন করবার অভিপ্রায়ে উৎপন্ন হয়। ক্রোধ বা চন্ডতা দ্বেষ চিত্তের লক্ষণ। কেহ আমার অনিষ্ট করল কিংবা আমার প্রিয় বস্তুর বা প্রিয় জনের অনিষ্ট করলে অথবা অপ্রিয় জনের উপকার করলে দ্বেষ উৎপন্ন হয়। যখন চিত্ত আলম্বনের প্রভাব ব্যতীত কোনরূপ উত্তেজনা ব্যতিরেকে শুধু স্বীয় স্বভাব হেতু তীক্ষèভাবে দৌর্মনস্য সহকারে প্রতিঘ বা হত্যার জন্য উৎপন্ন হয় তাই হল দৌর্মনস্য সহগত প্রতিঘ সম্প্রযুক্ত অসংস্কারিক চিত্ত।
আর যেই চিত্ত ধীরভাবে, আলম্বন সমাগমে বা নিজের বা পরের উৎসাহ উত্তেজনা সাপেক্ষ হয়ে দৌর্মনস্য সহকারে আলম্বনকে হত্যার অভিপ্রায়ে উৎপন্ন হয়, তাই হলো দৌর্মনস্য সহগত প্রতিঘ সম্প্রযুক্ত সসংস্কারিক চিত্ত।
প্রাণীহত্যা, চুরি, মিথ্যাবাক্য, পিশুনবাক্য, সম্প্রলাপ ও ব্যাপাদ এই সপ্তবিধ অকুশল কর্ম দ্বেষ মূলক। এগুলোর যেকোন একটি কার্য সম্পাদন কালে দ্বিবিধ দ্বেষ চিত্তের মধ্যে যেকোন একটির অবস্থা প্রাপ্ত হয়।
১৩. দুঃখ সমুদয়ঃ দুঃখ সমুদয় অর্থ হলো দুঃখ উৎপত্তির কারণ। দুঃখ উৎপত্তির কারণ হলো তৃষ্ণা। কারণ তৃষ্ণা পুনজন্মের হেতু। এই তৃষ্ণা কামনাকে আশ্রয় করেই উৎপন্ হয়। তৃষ্ণা ত্রিবিধ। যথা- কাম তৃষ্ণা, ভব তৃষ্ণা ও বিভব তৃষ্ণা।
কাম তৃষ্ণা বলতে বুঝায় কামভূমির ভোগ বিলাসের জন্য রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ এই পঞ্চ কামগুণে রমিত হয়ে মনুষ্য ও ছয় প্রকার দেবলোক সহ সপ্তবিধ কামভূমিতে পুনঃ পুনঃ জন্ম গ্রহণের প্রবল ইচ্ছা।
ভব তৃষ্ণা বলতে বুঝায় শাশ্বত দৃষ্টির সাতাশটি ভব অর্থাৎ এক প্রকার মনুষ্যলোক, ছয় প্রকার দেবভূমি এবং বিশ প্রকার রূপ ও অরূপ ব্রহ্মভূমি- এই সাতাশটি ভূমিসমূহ নিয়ত স্থির, ধ্র“ব, অবিধবংসী কেবল আমিই অস্থির,অধ্র“ব, বিধবংসী মনে করে ভব হতে ভবান্তরে পুনঃ পুনঃ জন্ম গ্রহণের বা উৎপত্তির প্রবল ইচ্ছা।
বিভব তৃষ্ণা বলতে বুঝায় উচ্ছেদ দৃষ্টি অর্থাৎ এই পৃথিবী অনিত্য, পরিবর্তনশীল, অস্থির বিধবংসী। তদ্রুপ আমিও পরিবর্তনশীল, অস্থির ও বিধবংসী। স্থির ও অবিধবংসী বলে কোথাও কিছু নেই। সুতরাং সুখ-দুঃখ বলতে যা কিছু আছে সব এখানেই, এর পরে আর কিছুই নেই। সব শূন্যময় মনে করে কেবল লৌকীয় ভোগ বিলাসে সর্ব প্রকারে প্রমত্ত থাকবার প্রবল আকাঙ্খায় বিভব তৃষ্ণা।
এই ত্রিবিধ তৃষ্ণার আবর্তে পরে সত্ত্বগণ পুনঃ পুনঃ জন্ম গ্রহণ করতঃ জন্ম, জরা, ব্যাধি, মুত্যু দুঃখ ভোগ করে বিধায় তৃষ্ণা সমূহ দুঃখের সমুদয় বা উৎপত্তির কারণ।
0 Comments