অধিষ্ঠানের মাহাত্য
ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু
আমাদের ভিতর ধর্ম যেভাবে জাগ্রত হয়, তা ক্রমশঃ পুষ্টি, শক্তিশালী ও বলবান হতে হবে। সে লক্ষ্যে আমাদেরকে অবিরাম প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে।
কিন্তু ধর্ম কিভাবে পুষ্ট হবে? এবং প্রজ্ঞাও কিভাবে পুষ্ট হবে? কেবল অধিষ্ঠান করলে বা চাইলেই তো পুষ্ট হবেনা। সবাই সবসময় তো সবকিছু চায়। প্রত্যেক সুবিবেচক লোক, প্রত্যেক সাধক-সাধিকা চান যে, আমার ধর্ম পুষ্ট হোক, আমার প্রজ্ঞা পুষ্ট হোক এবং আমি প্রজ্ঞায় স্থিত থাকি অর্থাৎ স্থিতপ্রজ্ঞ হয়ে যাই। কিন্তু আমরা দেখি যে, কাজ না করে কেবল কামনা করলে বা চাইলে দু’বেলা খাবারও কারো জোটেনা। দু’বেলা ভোজনের জন্যও সকলকে পরিশ্রম করতে হয়, কঠোর পরিশ্রম বা পুরুষার্থ করতে হয়। অনুরূপভাবে কেহ যদি কেবল কামনা বা অধিষ্ঠান করে যে, আমি ধর্মে পরিপক্ক হই এবং আমি প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ হই। এভাবে যতই অধিষ্ঠান বা কামনা করা হোকনা কেন, কেবল অধিষ্ঠান বা কামনা করলেই ধর্মে কখনও পুষ্ট হওয়া কিংবা প্রজ্ঞায় পরিপক্ক হওয়া যায়না। তাতে শুধু ধোঁকাই হবে। তজ্জন্য পরিশ্রম তো অবশ্যই করতে হবে, অহোরাত্র অনেক পরিশ্রম করতে হবে।
সাধারণতঃ দেখা যায় যে, কোন কোন সাধক-সাধিকা বিদর্শন ভাবনা শিবিরে যোগদান করে দশদিন অনুশীলন করে বড়ই প্রসন্নতা প্রকট করে থাকেন। ধর্মরসের সামান্য এক বিন্দু পরিমাণ রসাস্বাদনেই তাঁদের প্রসন্নতা এসে যায়। সামান্য পরিমাণ হলেও তো ধর্মরস বা ধর্মামৃত পান করেছেন। দশদিনের ধ্যান শিবিরে তো কোন দর্শন শিখতে বা বুদ্ধি বিলাসের জন্য তো আসেন নাই, বাক্য বিলাসের জন্যও তো আসেন নাই, অবসর বা ছুটি কাটানোর জন্যও তো আসেন নাই এবং পিকনিক উদযাপন করতেও তো আসেন নাই। সেখানে আগ্রহ সহকারে ধ্যান-সাধনা বা তপস্যা করার জন্যই তো এসেছেন। তাই যাঁরাই ধ্যান শিবিরে ধ্যান-সাধনা করতে আসেন, তাঁদের প্রত্যেকেই কম-বেশী পুরুষার্থ বা পরিশ্রম করে থাকেন এবং পরিশ্রম করলে তখন ধর্মের রস আস্বাদন করবেনই। যতটুকুই ধর্মের রস আস্বাদন করবেন, তাতে অতীব প্রসন্নতা উপভোগ করবেন। তাঁদের মনে তখন বড়ই আনন্দ উৎপন্ন হবে।
কিন্তু দশদিন কোন শিবিরে এসে অনুশীলন করার পর ঘরে গিয়ে ইহার অনুশীলন ত্যাগ করেছেন, ঘরে এসে সকাল-সন্ধ্যা রোজ যেভাবে অনুশীলন করার কথা, তা করা বন্ধ করে দিয়েছেন, তাহলে ধর্ম কিভাবে পুষ্ট হবে? প্রজ্ঞা কিভাবে পুষ্ট হবে? অনেক সময় কোন কোন সাধক-সাধিকার সাথে হঠাৎ কোথাও দেখা হয়ে যায়। সাক্ষাতে তাঁদের সাথে একটি মাত্র প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করা হয়-উপাসক বা উপাসিকা অথবা সাধক বা সাধিকা! আপনারা ভাবনা কি রকম করছেন? ঠিকভাবে ধ্যান-সাধনা চলছে তো? তখন তাঁরা জবাব দিয়ে থাকেন যে, আসার পর কিছু দিন ভালই চলছিল। কিন্তু এখন অনুশীলন ছুটে গিয়েছে বা ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। এভাবে বলতে গিয়েও তাঁদের দ্বারা মিথ্যা কথাই বলা হচ্ছে। সত্যি তো ইহাই যে, ধ্যান ছুটে বা ছিন্ন হয়ে যায়নি, আসলে ছিন্ন করে ফেলেছে। অনুশীলন ছেড়ে দিয়েছে। কিছুদিন অনুশীলন করার পর আবার ছেড়ে দিয়েছে। তাই ছিন্ন হয়নি, ছিন্ন করে দিয়েছে। ধ্যান নিজে থেকেই ছিন্ন হয়না, নিজেরাই ছেড়ে দিয়েছে।
যখন বিদর্শন ভাবনার শিবিরে সাধক-সাধিকা এসে থাকেন, তখন তাঁরা অধিষ্ঠান করে এক ঘন্টা এক ঘন্টা করে দিনে ছয় ঘন্টা বসে স্মৃতি সাধনা করে থাকেন। তখন বুঝা যায়, এ সময়গুলো পার করা কত কঠিন কাজ! প্রথম দু’য়েকদিন অধিষ্ঠান করে অনুশীলন করা কত যে কঠিন পীড়া দায়ক তা ভুক্তভোগী মাত্রই বুঝতে পারেন। এক ঘন্টা বসে সাধনা করতে করতেই পায়ের অসহ্য ব্যথায় অতীষ্ট হয়ে উঠেন। যেন পা ভেঙ্গে যাবে। ইহা সকল সাধক-সাধিকাই অনুভব করে থাকেন। তারপরেও মনকে শক্ত করে অধিষ্ঠানের কথা স্মরণ করে এক ঘন্টা করে বসে স্মৃতি সাধনা করে থাকেন।
যাঁরা নড়াচড়া না করে যদি বসতে সক্ষম না হন, তাঁরা পা একবার টেনে পরিবর্তন করে বসে থাকেন, এভাবে দু’বার বা তিনবারও পরিবর্তন করতে থাকেন। আবার অধিষ্ঠান করেন যে, পরের বসায় পরিবর্তন না করে স্মৃতি করব। আবার প্রয়াস করে থাকেন। এবারও কঠিন ব্যথা যন্ত্রণা আসতে থাকল। এভাবে করতে করতে ক্রমে পরিবর্তন কমাতে কমাতে সাত-আটদিন পার করে দিয়ে শেষে গিয়ে অপরিবর্তিত অবস্থায় একঘন্টা পর্যন্ত স্মৃতি অনুশীলন করতে সক্ষমতা তো অর্জন করেই থাকেন। প্রথম দিনেই যদি বলতে থাকেন যে, এক ঘন্টা করে বসা অত্যন্ত কঠিন কাজ। আমার দ্বারা ইহা হবেনা। আমি ধ্যান করবনা। এরকম ব্যক্তি তখন কখনও ঘন্টার জন্য অধিষ্ঠান করে বসতেই পারবেনা। তাঁর দ্বারা জীবনভরেও তা সম্ভব হবেনা।
যখন শিবিরে এসে থাকেন, তখন দশম দিনে যদি বলা হয়, আপনাকে এক বছর অনুশীলন করার জন্য অধিষ্ঠান করে বসতে হবে। আপনার মনে হবে তা অনেক কঠিন কাজ। তারপরেও কেহ যদি বছরের জন্য অধিষ্ঠান করে স্মৃতি সাধনা করে থাকেন এবং মনে মনে ভাবেন যে, আমার অধিষ্ঠান হল এক বছরের জন্য, এ এক বছর সময়ে যা কিছু হোকনা কেন, বাহ্যিক ক্ষেত্রে যত লোকসান হোক না কেন, আমি কখনও অধিষ্ঠান ভঙ্গ করবনা। আসলে অনুশীলনে সে রকম কিছু লোকসানই হয়না। কেবল মনের দৃঢ়তাই রাখতে হয়। যেমন নতুন নতুন সাধক-সাধিকা যখন বিদর্শন ভাবনায় বসে পাশ পরিবর্তন করতে থাকেন এবং বলতে থাকেন যে, পা ছিড়ে যাচ্ছে, তাই পরিবর্তন করছি। সেখানে কোন পরিস্থিতিতেই পাশ পরিবর্তন না করার অধিষ্ঠান করে বসে দেখুন, ব্যথা-বেদনায় গভীর মনোযোগী হয়ে স্মৃতি করুন, দেখবেন, পা তো ছিড়ে যায়নি। এখনও পর্যন্ত ধ্যানে বসে কারো পা ভেঙ্গে তো যায়নি। এরকম ভাঙ্গলে তো ধ্যানে বসানোর প্রশ্নই আসতনা।
কারও পা ভাঙ্গার জন্য তো বিদর্শন ভাবনা শিক্ষা দেওয়া হয়না। জেনে রাখুন যে, বিদর্শন ভাবনায় পা ভেঙ্গে যায়না। এজন্য বছর ভর বসার জন্য অধিষ্ঠান করুন এবং মনে দৃঢ় সঙ্কল্প করুন যে, আমার যতই হানি হোক না কেন, বাহ্যিক ক্ষেত্রে যতই লোকসান হোক না কেন, আমি অধিষ্ঠান ভঙ্গ করবনা। ধ্যান চালিয়ে যাবই। দেখবেন, পা ভাঙ্গছে বলে মনে হলেও আসলে পা কখনও ভাঙ্গছেনা। দরকার কেবল মনের দৃঢ়তা। অনুরূপভাবে বাহ্যিকরূপেও কোন লোকসান হবেনা।
যখন আমরা ধর্ম ধারণ করে থাকি, তা কেবল পরলোকে কিছু পাওয়ার জন্য করা হয়না। যে ধর্ম কেবল ইহাই প্রতিশ্রুতি দেয় যে, মৃত্যুর পর তোমার এরূপ ফল পাওয়া যাবে, তুমি ইহা লাভ করবে, এ জীবনে তো কিছুই পাচ্ছনা, কিন্তু সুনিশ্চিত যে, মৃত্যুর পর সব পেয়ে যাবে, তাহলে বুঝতে হবে যে, সেখানে কোন ধর্ম নাই। রয়েছে সেখানে কেবল ধোঁকাই ধোঁকা। সত্যিকার ধর্ম হলে তো প্রথমে ইহলোক সংশোধন হবে অর্থাৎ ইহলোকে সুফল পাবে এবং এরপর পরলোক সংশোধন হবে। প্রথমে ইহ লোকে সুফল পেতে হবে। এরপর পরলোকের কথা।
লোকদেরকে সংশোধনের জন্যই তো ধর্ম। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সংশোধন বা পরিবর্তন হচ্ছে কি হচ্ছেনা, এ জীবনে আমি সুখ-শান্তি পাচ্ছি কি পাচ্ছিনা, তা দেখতে হবে। আমাদের লৌকিক ক্ষেত্রে ভাল হচ্ছে কি হচ্ছেনা, তা দেখতে হবে। এরকম মাপদণ্ডে ধর্মকে মাপতে হবে। ধর্ম অনুসরণে যার ইহলোক সংশোধন হয়ে যাচ্ছে, তার পরলোকও সংশোধন হবে। ধর্মও পালন করছেন এবং আপনার মধ্যে সংশোধন কিংবা পরিবর্তন আসার পরিবর্তে আপনি আরও লোভী, ক্রোধী, হিংসুক, মিথ্যাবাদী ও অসংযত হয়ে যাচ্ছেন, তাতে ধর্ম পালন কোথায় হচ্ছে? ধর্ম পালনে তো এরকম হওয়ার কথা নয়।
তাহলে কেবল মনকে দৃঢ় করুন যে, যত কিছুই হোক না কেন, আমি বছর ভরের জন্য অধিষ্ঠান করছি, আমাকে বছর ভর সকাল-সন্ধ্যায় ধ্যান-সাধনা করতেই হবে এবং এ সম্বন্ধে অনেকের উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। যে সকল ব্যক্তি এভাবে দীর্ঘকালীন অধিষ্ঠান করে ঘরে বসে অনুশীলন চালু রেখেছেন, তাঁরা বলেননি যে, আমাদের পা ভেঙ্গে গিয়েছে এবং ইহাও বলেননি যে, ধ্যান ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। কেননা তাঁরা ধ্যান ছেড়ে দেননি। তাঁরা ধ্যান ছাড়বেনও না, কখনও ছাড়তেও পারবেননা। যাঁরা ছেড়ে দেন, তাঁরা বার মাসের মধ্যেই ছেড়ে দেন।
দশ দিনে ছেড়ে দেন, বিশ দিনে ছেড়ে দেন, মাসের পর ছেড়ে দেন, দু’ মাস…. পরে ত্যাগ দেন। অধিষ্ঠান তো নিয়েছেন বছর ভরের জন্য। এরকম অধিষ্ঠান নিয়ে স্বয়ং অনুভব তো করছেন তাই নয় কি? অন্য কেহ তো অনুভব করছেনা। এ অনুভব অন্য কেহ আপনার জন্য করবেনা, কোন মার্গ দর্শকও করবেনা, কোন দেব-দেবী বা ঈশ্বরও করবেনা। অধিষ্ঠান পুরা করতে পারলে নিজেই নিজে সব অনুভব করতে পারবেন। এ অনুভবই আপনাকে সত্য জানিয়ে দেবে। নিজের ভাল নিজেই বুঝতে পারবেন।
এরকম অনুভবী সাধক-সাধিকাদেরকে বুঝতে হবে যে, যখন আমি ধর্ম ধারণ করছি, তাতে আমার ইহলোকের মঙ্গল তো হবেই, আমার মঙ্গল তো হতেই চলেছে, সুফল আমি এ জীবনেই আমি পেতে চলেছি, তাতে পরলোকের কল্যাণ যা হওয়ার তা তো হবেই, কিন্তু ইহ জীবনে আমার কল্যাণ তো হতেই চলেছে। এ জীবনেই অর্থাৎ তৎকালেই আমি ফল পাচ্ছি। আত্মমঙ্গল যেখানে রয়েছে, সর্বমঙ্গলও রয়েছে সেখানে। আত্মোদয় হতে থাকলে সর্বোদয়ও হবে। সেজন্য আত্ম কল্যাণের জন্য অপরের উপর ভরসায় বসে থাকবেননা। অধিষ্ঠান করে মনের দৃঢ়তা সহকারে নিজেকেই কাজ করতে হবে। নিজের মঙ্গলের জন্য, নিজের কল্যাণের জন্য মনের অধিষ্ঠান ও দৃঢ়তা থাকা অতীব আবশ্যক।
0 Comments