বুদ্ধের মৈত্রী
মায়ের ভালোবাসা
ভান্তে
গুণরত্ন,
ভাবনা
সোসাইটি, ওয়েষ্ট ভার্জিনিয়া, আমেরিকা।
==============================
ত্রিলোকপূজ্য
তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ আমাদের সবাইকে বলেছেন চারি আর্যগুণ অনুশীলন করতে যাকে পালিতে
বলা হয় ‘ব্রহ্মবিহার।‘ ব্রহ্মের অর্থ হলো “আর্য” বা “স্বর্গীয়।” এটা সেইজনকে বোঝায়
যিনি দেবলোকের সুউচ্চ জায়গায় বসবাস করেন। বিহার হলো “আবাস” বা “শরণ।“ ব্রহ্ম বিহার
হলো মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, এবং উপেক্ষা- যা আমাদের জীবনকে উন্নত অবস্থায় নিয়ে
যেতে পছন্দ করে। চারিটি ব্রহ্মগুণ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কীত; আমরা একটিকে ছাড়া
অন্যটিকে উন্নত করতে পারবো না। এটিকে বুঝতে এক সহজ উপমা হলো পিতা মাতার সন্তান
লাভের বিভিন্ন অবস্থার মতো। একজন মায়ের মধ্যে থাকে চারি আর্যগুণের সবগুলো।
যখন
একজন নারী গর্ভধারণ করেন, তিনি অপ্রমেয় ভালোবাসা অনুভব করেন গর্ভের অনাগত সন্তানের
প্রতি। তিনি সবকিছুই করেন, গর্ভের সন্তানের মঙ্গল সুনিশ্চয়তার জন্য। তিনি ছড়াতে
থাকেন হৃদয়ের অনুপম ভালোবাসা, সন্তানটি গর্ভে সযত্নে বেড়ে সুন্দরভাবে প্রসব করবেন
সে আশায় থাকেন। অপ্রমেয় মৈত্রীর মতো, সন্তান প্রত্যাশী মায়ের মনে প্রাণে ভরে থাকে
সন্তানের জন্য অসীম মৈত্রী ও সব দুঃখ-কষ্টকে গ্রহণ করার মানসিকতা, সেই মানসিকতা
কখনোই পরিবর্তন করেন না যে অবস্থারই সম্মূখীন হোন না কেন।
একদিন
সন্তানটি সুন্দর পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হন। বড় হতে হতে পৃথিবীকে জানতে শুরু করেন,
বাবা-মায়েরও বাড়তে থাকে করুণাগুণ সন্তানের প্রতি। সন্তানটি হাঁটুতে ব্যথা পেলে,
পড়ে গেলে বা মাথায় আঘাত পেলে, বাবা-মাও অনুভব করেন সমান ব্যথা। অনেক মা-বাবা বলে
যে যখন তাদের সন্তান ব্যথা অনুভব করে, তারাও সমান ব্যথা অনুভব করেন সঙ্গে সঙ্গেই।
এই নিখাদ করুণাগুণে না থাকে দয়া কৃপা প্রদর্শন। দয়া-কৃপা পার্থক্য এনে দেয় তুমি
এবং অপরের মধ্যে। সন্তানের প্রতি করুণা ব্রহ্মগুণ সংযোগের এক জায়গা থেকে কার্যকর
ভূমিকার নেতৃত্ব দিতে থাকে, এবং সেই সঠিক কার্যক্রম হয় নির্মল, হৃদয় নিংড়ানো
আশা-আকাঙ্খা সেই ব্যথা-বেদনাকে দূর করে দেয় এবং শিশুটি নির্ভয় ভালোলাগা অনুভব করতে
থাকে।
একসময়
সন্তান বড় হয়, বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। বাবা-মারা চায় সন্তানটি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব
করুক এবং লেখাপড়ায় ভালো করুক, খেলাধুলা ও অন্যান্য কার্যক্রমে উন্নতি করুক। হয়তো
সন্তানটি ভালো করে ভাষার দক্ষতা পরীক্ষায়, বেসবল খেলায়ও ভালো করে, বা ক্লাসের
মধ্যে প্রধান/সভাপতি নির্বাচিত হয়। মা-বাবারা স্বাভাবিকভাবেই ঈর্ষান্বিত হয় না
সন্তানের উন্নতিতে, বরং সন্তানের এ সফলতায় ভরে ওঠে হৃদয় ও মন সুখময়তায়। এটিই হলো
ব্রহ্মগুণ মুদিতা। একটু ভাবুন তো, কেমন অনুভবের অনুভূতিতে ভরে যায় আপনার জীবন
নিজের সন্তানের জন্য। ঠিক সেই ভাবেই আপনিও চিন্তা করতে পারেন অপরের জন্য। এমন কি
আপনি অন্যদের নিয়ে চিন্তা করেন আনন্দময়তা নিয়ে, যারা আপনার চেয়েও বেশি সফলতা পেয়ে
গেছেন, আপনি মুদিতা ব্রহ্মগুণ চর্চা করতে পারেন তাঁদের অর্জনে এবং তারা যেভাবে
সুখ-উল্লাস করেন, আপনিও সেভাবে করতে পারেন, ঠিক যেমন একজন মা স্বাভাবিকভাবেই করে
থাকেন তাঁর সন্তানের জন্য।
অপরের
সফলতা দেখেই, আমরা তাদের সেই সফলতার জন্য সুখী হতে পারি, কোন ঈর্ষা ছাড়াই। আপনার
একজন ভালো বন্ধুর কথাই ভাবুন যিনি সম্প্রতি সফল হয়েছেন। তার আনন্দময় হাসিটি মনের
চক্ষুতে আনুন আর সেই মানুষটির সফলতার সুখময় প্রচণ্ড আনন্দ অনুভূতির প্রাণোচ্ছ্বল
হাসিটি আনুন আপনার হৃদয়জুড়ে। যদি আপনার বন্ধু সফল না হন এখন, তারপরও আপনি সুখী হতে
পারেন তার জন্য এই ভেবে যে এবার ব্যর্থ হয়েছে তাতে কী, আগে তো অনেক বার সফল
হয়েছেন। যদি তিনি অতীতে সফলও না হন, হয়তো ভবিষ্যতে সফল হবেন যখন সামর্থ্য ও দক্ষতা
বাড়তে থাকবে, সে কথাই ভাবুন। ভবিষ্যতে সফল হবার জন্য বন্ধুর কঠোর পরিশ্রম দেখে
আপনি সুখী হতে পারেন বন্ধুর সেই শুভচেতনার জন্য।
এখন
আপনি একজন মানুষকে মনের চক্ষুতে নিয়ে আসেন, যিনি নানা জায়গায় সফল হয়েছেন। উনার
দারুণ সফলতাগুলো দেখুন ভালোভাবে বা শুনুন মনোযোগ দিয়ে, যদিও আপনি ওনাকে চেনেন না,
জানেন না। সৎ সফল মানুষটির ছবিটি আপনার মনে নিয়ে আসুন, নিয়ে আসুন উজ্জ্বল সফলতার
দৃশ্যাবলীগুলো!
এবার,
এমন একজনকে নিয়ে আসুন আপনার মনের চোখে যাকে আপনার মোটেও ভালো লাগে না। শুরু করুন
তাকে নিয়ে মুদিতা অনুশীলন। আপনি খুব খুশী হতে পারেন যদি দেখেন যে যদি তিনি ভুল মন
মানসিকতাকে দূর করে ভালো মন মানসিকতাসম্পন হন এখন, বা যদি তিনি সফল হয়েছেন, বা
ভবিষ্যতে সফল হবেন।
পরিশেষে,
আপনার নিজের সফলতাকে প্রশংসা করুন। অগুনতি বড়-ছোট অতীত ও বর্তমানের সফলতাগুলো
নিয়ে, আর অনাগতের সফলতাগুলো নিয়ে ভেবে প্রশংসিত হোন নিজে নিজে।
মৈত্রী
ভাবনা শুরু করেন আপনি তাদেরকে নিয়ে যারা আপনার অত্যন্ত কাছের, এরপর নিরপেক্ষজনদের
নিয়ে, এরপর যাকে আপনার ভালো লাগে না, এবং শেষে নিজেকে নিয়েই করেন যা
প্রত্যক্ষভাবেই মৈত্রী অনুশীলন।
ফিরে
যাই আবারো মাতা-পিতা ও সন্তানদের কাছে।
অনেক
বছর পর ছেলেমেয়েরাও অনেক বড় হয়ে যায়। তারা বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে এবং নিজেদের
দাঁড় করাতে চাকুরী ও নানা কাজে নিযুক্ত হয়। হয়তো তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং
একটা পরিবার শুরু করে। আর তখনই শুরু হয় উপেক্ষা চর্চার। পরিস্কারভাবে দেখায় যে
পিতা মাতারা সন্তানের জন্য যা অনুভব করেন তা কিন্তু নিরপেক্ষতা দেখায় না। এটা
অত্যন্ত আনন্দের, প্রশংসাময় অবস্থা হয় যে সন্তানের জন্য তাদের দ্বারা যা সম্ভব করা
যায় সর্বোচ্চভাবে তা তারা করেছেন। তারা উপলব্ধি করতে পারেন তাদের সীমাবদ্ধতা।
সন্তানরা যত বড়ই হোক, পিতামাতার মনের মধ্যে সবসময় থাকে চিন্তা তাদের দেখভাল করার ও
সম্মান দেখানোর। কিন্তু তারা খুব সচেতন হয়েই করেন যেনো সন্তানরা মনে না করে তাদের
নিয়ন্ত্রণ করছে। এটাই হলো উপেক্ষা অনুশীলন।
ঠিক
যেমন প্রথম ব্রহ্মগুণ মৈত্রী ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সবার মধ্যে, ঠিক উপেক্ষা
অনুশীলনেও গুণটি ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে। উপেক্ষা অনুশীলন করতে হয় একজন নিরপেক্ষ
মানুষকে নিয়ে, এরপর প্রিয়জনকে নিয়ে, এরপর যাকে আপনার পছন্দ হয় না তাকে নিয়ে, এবং
শেষে নিজেকে নিয়ে।
উপেক্ষা
হলো শান্তিময় ও মনের এক অনুপম অবস্থা। একবার আপনি যখন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে প্রকৃত
উপেক্ষায় সুদক্ষ হয়ে যাবেন, আপনি যখনই চাইবেন, এটি মনের মধ্যে নিয়ে আসতে
পারবেন। মজ্ঝিম নিকায়ের ‘দেবদহ সুত্র’-এ তথাগত বুদ্ধ ভাবনাকারিদের ধর্মদেশনা
দিয়েছেন উপেক্ষা অনুশীলন করে চিত্তকে উন্নত করতে, সুব্যাখ্যাও দিয়েছেন এই বলে যে
আমরা প্রচণ্ড মানসিক দুঃখে ভুগি এ কারণে যে আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে কিভাবে
ধারণায় ধারণ করেছি তার কারণেও। কিন্তু সেই বিদ্যমান পরিবেশের পরিবেশ পরিস্থিতির
কারণে নয়। উপেক্ষা অনুশীলন করে মনের উৎকর্ষতা আনতে পারেন যেভাবে আপনি মৈত্রী ভাবনা
অনুশীলন করেছেন এবং ছড়িয়ে দেন অসীমভাবে, ছড়িয়ে দেন ছয়দিকে।
তথাগত
সর্বজ্ঞ বুদ্ধ বলেছেন, “উপেক্ষার বৈচিত্রতায়” অর্থাৎ উপেক্ষা উন্নত করতে হবে
দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ ও ধর্ম/চিন্তার ওপর। কল্পনা করুন তো, আপনি
চেষ্ঠা করছেন যে একটা বিষয়ে ইচ্ছাকে পূর্ণতা দিতে, যখন আপনি উপলব্ধি করবেন যে
আপনার মনের মধ্যে অনুভবের গভীরতা, সেটা কিন্তু বিষয়বস্তুটা নয়। এটা উপলব্ধিতে
আসলে, তখন আপনি যে বিষয়ে আক্রান্ত হয়ে আছেন, তা অনেকটাই দূর হয়ে যাবে এবং আপনি আর
নিজে মোহগ্রস্থতায় জড়াবেন না কোন নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুতে। ঐটিই হলো উপেক্ষা
ব্রহ্মগুণের বৈচিত্রতা।
অন্যদিকে,
উপেক্ষা একটি বিষয় (আলম্বন) নিয়ে ভাবনায় মনোযোগের মাধ্যমে উন্নতি করলে একে বলা হয়
“একাগ্র উপেক্ষা।“ উপেক্ষা ভাবনা অনুশীলন করতে থাকলে তা আকাশাঞ্চয়তন নেব-সংজ্ঞা-না
সংজ্ঞা আয়তন পর্যন্ত পৌঁছে যায়, এসব অবস্থাও “একাগ্র উপেক্ষা।“
ভাবনা
অনুশীলনের সময়, আমরা হয়তো জানবো যে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সবকিছুই অনিত্য, কোন
কিছুই নিত্য বা পরম নয়, এগুলো সারাটা জীবন ধরে আমাদের সুখী করবেও না। এবং
সুনির্দিষ্ট আবশ্যক এক বিষয়বস্তু জীবনে লেগেও থাকবে না। একে বলা হয় “উপেক্ষার
নৈষ্ক্রম্যতা।“
আমরা
মনকে উন্নতি করি চারটি ব্রহ্মগুণ ভাবনা অনুশীলন করে-মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও
উপেক্ষা। আমাদের জীবনে মুখোমুখি হতে হয় নানা বাধা বিঘ্নতার। মৈত্রী ভাবনার চারটি
ব্রহ্মগুণ অনুশীলনে জীবনে নিয়ে আসে প্রচুর উপকারিতা। জীবনের সামনে যখন নানা সমস্যা
উপনীত হয়, তখন এদেরকে প্রয়োগ করে শান্তিময় সমাধান নিয়ে আসতে পারি। আমাদেরকে চারটি
মৈত্রীগুণকে একসঙ্গে প্রয়োগ করার প্রয়োজন নেই বা কেউ একজনের জন্য। আমাদের মধ্যে
স্মৃতি অনুশীলনের সমৃদ্ধতা চলে আসলে, আমরা বুঝতে পারবো কখন ও কোথায় এদেরকে প্রয়োগ
করবো। তথাগত বুদ্ধ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে যদি আমরা মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও
উপেক্ষা অনুশীলন করি, সম্প্রযুক্ত হয়ে শৈশবকাল থেকে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত, আর তখনই
আমাদের চিত্ত লোভ, দ্বেষ ও মোহ থেকে মুক্তি লাভ করবে।
মৈত্রী
চারি আর্য অবস্থায় উপস্থিত থাকে। যখন আমরা মৈত্রী অনুশীলন করি, এরপর ধীরে ধীরে চলে
আসে করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা আর বাড়তে থাকে আমাদের মনের মধ্যে। আপনি
স্বাভাবিকভাবেই করুণাপ্রাণ হয়ে উঠবেন যখন মৈত্রীর গুণ আপনার চিত্তে ভরে যাবে। আপনি
আর অপরের সফলতায় ঈর্ষান্বিত হবেন না; অভিধ্যা (ভীষণ লোভ পরায়নতা) হবেন না- অন্য
কারো সম্পত্তির প্রতি আপনার লোভ জাগবে না কারণ আপনি মৈত্রীচিত্তের অধিকারী হয়ে
গেছেন। বরং আপনি প্রতিমুহূর্তে ভাবতে থাকবেন সারা পৃথিবীর সমৃদ্ধি আর শান্তিময়তায়
ভরে যাক।
১৯৭৬
সালের শেষের দিকে। আমার ছোট বোনের পাঠানো চিঠি পাই। শ্রীলংকা থেকে। চিঠি খুলে পড়ি।
লিখেছে মায়ের স্বাস্থ্য খুব ভালো নয়, এবং খুউব কম খাবারই খেতে পারছেন। সঙ্গে মায়ের
নিজের হাতে লেখা কয়েকটি বাক্যের একটি চিঠিও দিলো। ছোট বোনটি লিখলো কয়েকটি বাক্যের
চিঠিটা লিখতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় নিয়েছে। মা এতোই দুর্বল ছিলেন লেখার সময় একসঙ্গে
এক বা দুটি বর্ণের বেশি লিখতে পারছিলেন না। এমন কি হাতের মধ্যে কলমটা পর্যন্ত ধরতে
পারছিলেন নাহ তেমনই অবস্থা। মা হয়তো ভেবেই নিয়েছিলেন এটাই শেষ চিঠি লেখা আমাকে। মা
লিখলেন আমাকে, “আমি আশায় আছি, তোমাকে আমি দেখতে পাবো।“
“আপনার
বাড়ীতে আসা উচিত” আমার ছোটবোনটি লিখলো চিঠিতে। আরো লিখলো, “মা হয়তো আর বেশিদিন
বাঁচবেন নাহ।“
ওয়াশিংটন
বৌদ্ধ বিহার। আমেরিকায় শ্রীলংকান প্রথম বিহার যেখানে আমার থাকা ও ধর্মপ্রচারের
স্থান। দ্রুত বিহার পরিচালনা পর্ষদের অনুমতি নিয়ে নিলাম দেশে যেতে আর দ্রুত টিকেট
কেটে বিমান প্যান এম ৭৪৭ উঠে পড়লাম এবং রওনা দিলাম জন্ম শেকড় শ্রীলংকার উদ্দেশ্যে।
পথে
মালেয়েশিয়ায় কুয়ালালামপুরে থামলাম। কয়েকজন বন্ধু আমাকে একটা প্রজেক্টর দান করলো।
আমার কাছে পাঁচশ-র অধিক স্লাইড আছে তখন, পৃথিবীর নানা জায়গা ভ্রমণের স্মৃতি যেখানে
আছে নান্দনিক বিহার, সুউচ্চ বিল্ডিং, প্রাকৃতিক দৃশ্য, প্রাণী ও আনন্দময় উৎসবের
আয়োজনগুলো। আমি আমার প্রিয় মাকে এসব দেখাতে খুবি আগ্রহী ছিলাম, যেনো দেখে খুশী হয়
এতোটা বছর আমি কী করেছি, গৃহত্যাগী হয়ে সন্ন্যাসব্রত, ভিক্ষুব্রত গ্রহণ করার পর।
আমি
শ্রীলংকায় পৌঁছলাম, আর যত দ্রুত সম্ভব আয়োজন করলাম স্লাইড শো দেখাতে মাকে ছোটবোনের
ঘরে। বিদ্যুৎ সংযোগ ছিলো না বোনের ঘরে, প্রতিবেশির ঘর থেকে লম্বা তার দিয়ে বিদ্যুৎ
আনতে হয়েছে। আমার মা বসেছেন শান্ত হয়ে, দেখে খুবি বিমুগ্ধও হয়েছেন। স্লাইডগুলোর
দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে আছেন আর শুনছিলেন আমার দেয়া বর্ণনাগুলো। প্রিয় মায়ের
চোখগুলো জ্বলজ্বল করছিলো।
আমরা
রাত ১০টায় দেখাতে শুরু করলাম স্লাইডগুলো, এবং রাত দুটা অবধি চললো, এবং আমার জননীকে
দেখলাম একটুও ক্লান্ত অনুভব না করতে। যখন শেষ হলো, জিগ্যেস করলো, আরো স্লাইড আছে
কিনা দেখার জন্য। এটাই ছিলো আমার মায়ের সঙ্গে কাটানো শেষ স্মৃতিময় সময়। একদিন পর
ক্যন্ডিতে হাসপাতালে নেয়ার পথেই পরলোকে পাড়ি দেন মা। মা হাসপাতালে শুয়ে যাবার
পরিবর্তে পেছনে বসে যাবার জন্য বলছিলেন। আর মা ছিলেন একেবারেই চুপচাপ, হাসপাতালের
পথে গাড়িতে যখন। পেছনের সিটেই মারা যান সোজা বসা অবস্থাতেই। যদি কোন এম্বুলেন্সের
ব্যবস্থা থাকতো হাসপাতালে নিয়ে যেতে, মা হয়তো আরো কয়েক মাস বেশী বেঁচে থাকতেন।
আমি
শুধু বারবার ভাবছিলাম, মা আমাকে অগুনতিবার সেবা যত্ন করেছেন, যখন আমি শৈশবে বারবার
আঘাত-ব্যথা পেয়েছি। মা ভালোভাবেই জানতেন কী করতে হবে আমার তুলতুলে হৃদয়ের অনুভবটাকে
ভালো রাখতে। আমার খুব মনে পড়ে তাঁর বাহুগুলো কেমন করতো আমাকে যত্ন করতে, ব্যথার
চারিদিকে নানা কিছু দিয়ে বেঁধে দিতে। আমার চিন্তায় বারবার আসছে, যে শেষ চিঠিটা মা
লিখেছিলেন মা আমায় কী যে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন, শুধুমাত্র কয়েকটি বাক্য! চারটি
বাক্যই! আমার মনের আয়নায় ভাসছে সেই চারটি বাক্য বারবার। আমি খুউব দুঃখবোধে
আক্রান্ত হলাম এই ভেবে যে মা মারা গেছেন খুব ব্যথা পেয়ে এবং অসম্ভব অনুশোচনা অনুভব
করছিলাম, আমি মায়ের সঙ্গে থাকতে পারিনি। আমার মা ছিলেন মৈত্রীচিত্তধারীর উদাহরণ,
যার সঙ্গেই দেখা হতো খুব হাসিমুখে কথা বলতেন ও সরলভাষায় কথাবার্তা বলতেন। আমার
মায়ের কতো যে গুণ, আমি আমার মাকে নিয়ে খুব ভাবতে ভালো পাই একজন পবিত্রমনা মা
হিসেবে।
তথাগত
বুদ্ধ বলেছেন, “প্রিয়জন বিয়োগ দুঃখ।“ ভিক্ষু জীবনে কতোটা বছর ধর্মদেশনা দিয়ে গেছি
বুদ্ধের এই অমোঘ সত্যটি শোক-পরিদেব দূর করতে মানুষের, অন্তোষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন
করেছি কতো আর সমবেদনা জানিয়েছি যারা হারিয়েছেন নিকটজন, জ্ঞাতি-স্বজন। আসলে ততোদিন
পর্যন্ত আমার উপলব্ধিতে আসেনি, যতক্ষণ জীবন অভিজ্ঞতায় আসেনি আমার মা জননী চিরবিদায়
নেয়ার অব্যাখ্যাত ব্যথার বিদীর্ণতা! যখন মা মারা যায়, আমার শোকটা এতোই বিশাল হয়ে
যায় যে আমার পুরো হৃদয়টা ভরে যায় বেদনায়, মনে হচ্ছিল কিছু একটা বিদীর্ণ করছে
ক্রমাগত, আর ব্যথা-বেদনায় জর্জড়িত হচ্ছিলাম।
আমি
গভীরভাবে উপলব্ধি করলাম, বিহারবাসী ভিক্ষুজীবনযাপনের ঘোর কর্মব্যস্তময় দিনগুলোতে,
মা যতোদিনই বেঁচে ছিলেন সবসময় চাইতাম মাকে খুশী রাখতে। আমি চাইতাম আমার মা যেনো
সুখী হন, সেটা যেনো হয় পৃথিবীর সেরা সুখটা। আমার মা এতোই খুশী ছিলেন এ জন্য যে
আমি ভিক্ষু জীবনযাপন করছি এবং বিভিন্ন দেশে বুদ্ধের অমৃতময় ধর্মদেশনা করছি।
তাই প্রতিবার নতুন কিছু অর্জন হলে বা করলে প্রিয় মাকে একটা চিঠি লিখে জানাতাম,
আসলে এটা আত্ম-গর্ব কিংবা আত্ম-প্রশংসার জন্য করতাম নাহ। আমি জানতাম এটা জেনে
মায়ের মনে যে কী বিশাল আনন্দে ভরে যাবে। দুঃখাক্রান্ত হয়ে ভাবছি, এখন মা তো
চিরদিনের জন্য ছেড়ে চলে গেছেন আমাকে-এখন আমি কাকে খুশী করবো?
মাকে
এতো বেশী ভালোবাসতাম যে এটা আমার জন্য এক অচ্ছেদ্য শক্ত বন্ধনই বটে। যখন আমি মাকে
হারালাম, সাময়িকভাবে ভুলে গেলাম তথাগত বুদ্ধের সমস্ত শিক্ষাগুলো, যেগুলো দেশনা
করেছেন মৃত্যু ও অনিত্য নিয়ে। খুব স্বাভাবিকভাবেই দুঃখের নদে ডুবে গেলাম এই আমি।
এমন কি আজও আমি অনুভব করছি গভীরভাবে আমার মায়ের রেখে যাওয়া অমলিন স্মৃতিগুলোকে।
১৯৭৯
বা ১৯৮০ সালে, আমি বক্তব্য দিচ্ছিলাম ডালাসে আন্তঃধর্মীয় সম্মেলনে। এটা ছিল থ্যংকস
গিভিংস সময়ের কাছাকাছি। সবাই বক্তব্য দিচ্ছিল কৃতজ্ঞতা নিয়ে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম
মায়ের কথাই বলবো আজ। কিন্তু যখন আমি দাঁড়ালাম মঞ্চে বক্তব্য দিতে এবং চেষ্ঠা করছি
আমার বক্তব্যের প্রথম শব্দটি বের করতে, কিন্তু পারছিলাম নাহ কোনভাবেই, একসময়
কেঁদেই দিলাম। সবার কাছে এটা ছিল অনাকাঙ্খিত, আমি এমনভাবে বেদনায় আক্রান্ত হয়ে
গেলাম, পারছিলাম নাহ কোনভাবেই আর বক্তব্য দিতে। উপস্থিত শ্রোতারা বসে আছেন চুপচাপ,
আর দেখছিলেন আমার কান্না। অনেকক্ষণ সময় নিল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে আমাকে।
আমি
যা বলতে চাইলাম আমার বক্তব্যে তাঁদেরকে, এটা ছিল, আমি আমার মাকে কখনোই ভুলে যেতে
পারবো না, এবং এ জন্য যে আমার মায়ের অপরিসীম স্নেহ-মমতাময় ভালোবাসার জন্য; আমি
সারাটা জীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। মিলয়াতনে পরিপূর্ণ মানুষের সামনে কান্না করার পরিবর্তে
আমি বুঝে উঠতে পারলাম এটা বলা ভালোই হবে বুদ্ধের অমৃত দেশনা মৃত্যু ও শোক নিয়ে।
বললাম, তথাগত বুদ্ধ বলেছেন যে মায়ের মৃত্যুর পর আমরা যে পরিমাণ শোক করেছি চোখের জল
ফেলে অতীতের অসংখ্য জন্মে-সেই চোখের জলের পরিমাণ সমস্ত মহাসাগরের চেয়েও বেশী।
একজন
মায়ের ভালোবাসা তাঁর সন্তানের জন্য অপ্রমেয়। তিনি সবকিছু করতে প্রস্তুত থাকেন
সন্তানের কল্যাণের জন্য। এমন কি তিনি নিজের জীবনকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকেন
সন্তানকে বাঁচাতে। যখন বিপজ্জনক অবস্থায় থাকে সন্তানের জীবন, অনেক মা নির্ঘুম
সর্বক্ষণ জেগে থাকেন সন্তানের মঙ্গলের জন্য। বিবেচনায় আনুন তো কেমন হতে পারে সেই
মায়ের মৈত্রী, ঠিক সেইভাবেই সর্বপ্রাণীর প্রতি মৈত্রী দেখাতে হবে আমাদেরকে।
মৈত্রী
গুণধর্ম চর্চার জন্য সবাইকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। আমরা জানি শ্যামাবতী ও উত্তরার
গল্পটি। মৈত্রী চর্চার অনুশীলন কখনোই তাঁরা থামাননি। শ্যামাবতী যখন মৃত্যুশয্যায়,
মৈত্রীচর্চা করে যাচ্ছিলেন এবং অনুরোধ করছিল সঙ্গী সাথীদেরও সেটা চর্চা করতে
একসঙ্গে, এমন কি অনেকেই তখন মৃত্যুর পথযাত্রী। উত্তরা খুবি শান্ত হয়ে
মৈত্রীভাবাপন্ন ছিলেন যখন শ্রীমা গরম ঘি তাঁর শরীরে ঢেলে দিচ্ছিল। এরপরও যখন তাঁকে
মেরে ফেলার জন্য গৃহকর্মি আক্রমন করেন নিজে তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। শিখিয়েছিলেন
বুদ্ধের শান্তিময় শিক্ষা। তারা কখনোই মৈত্রীচিত্ত হারাননি খুব কঠিন অবস্থায়ও।
আমাদের মৈত্রীচিত্তকে যত্ন করতে পারি, ঠিক যেমন আমরা সততা, সম্মান ও মর্যাদার
নীতিকে ধরে থাকি সযত্নে। এটা অনুশীলনের জন্য বুদ্ধের নির্দেশনা যা বাস্তব সম্মত পথ
হলো আমাদের নিজেদের মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা চিন্তাকে সবসময় রক্ষা করা। বিশুদ্ধিমার্গে
উল্লেখ করা হয়েছে,
“ঠিক
যেমন মুরগী তার ডিমগুলোকে,
বা
ঠিক যেমন গরু তার লেজকে,
বা
ঠিক যেমন প্রিয়পুত্রকে,
বা
ঠিক যেমন এক চোখধারী চোখকে রক্ষা করে,
সেভাবেই
যারা কাজ কর্মে নিয়োজিত নিজেদের ধর্মকে রক্ষা করবেন,
সবসময়
সযত্নবান হোন,
এবং
হোন নীতিাবান সারাটা জীবন।“
যখন
আমরা মনপ্রাণ দিয়ে সকল প্রাণীর মঙ্গল কামনা করবো এই বলে:
সকল
প্রাণী ভালো থাকুক,
সকল
প্রাণী সুখী হোক,
সকল
প্রাণী শান্তিময় জীবনে থাকুক,
আর
তখনোই আমরা ভালো থাকবো, সুখী এবং শান্তিময় জীবন লাভ করবো।
তথাগত
বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছেন যে আমরা অপ্রমেয় মৈত্রী অনুশীলন করতে পারি। আমাদের মৈত্রী
চর্চার সীমায়িত হতে পারে না সময় বা স্থানের কারণে; এটা প্রসারিত হতে হবে অসীম ও
শ্বাশ্বতভাবে। এটার অর্থ এই নয় যে আমাদের সশরীরে সারা পৃথিবীতে ঘুরতে হবে সব
প্রাণীকে রক্ষা করতে, ঐটা কখনোই সম্ভব নয়। এর অর্থ হলো আমাদের মৈত্রীকেই আমাদের
রক্ষা করতে হবে, ঠিক যেমন মা রক্ষা করেন নিজের একমাত্র সন্তানকে।
তথাগত
বুদ্ধ বলেছেন করণীয় মৈত্রী সুত্তে তাই:
“মাতা যথা নিযং পুত্তং আযুসা এক
এবম্পি সব্বভূতেসু মানসং ভাবযে
মেত্তঞ্চ সব্ব লোকস্মিং মানসং
উদ্ধং অধো চ তিরিযঞ্চ অসম্বাধং
“মাতা যেমন স্বীয় গর্ভজাত একমা
জগতের উর্দ্ধে, নিম্নে ও চারিদি
আপনার
মৈত্রী হলো আপনার সন্তান। একে রক্ষা করুন ঠিক যেন মৈত্রীপরায়ন মা রক্ষা করেন তার
একমাত্র সন্তানকে।
জীবনের
সামনে যত কঠিন সময়ই আসুক, চারিগুণযুক্ত মৈত্রীকে পরিত্যাগ করবেন না।
আপনার
সুহৃদয়কে রাখুন সবসময় উন্মুক্ত, বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবপ্রাণীকে মৈত্রীচেতনা ছড়িয়ে
দিতে….!
==============================
ভান্তে
গুণরত্ন: বৃটিশ শ্রীলংকার প্রকৃতি ঘেঁষা ছোট একটি গ্রাম হেনোপোলায়
ডিসেম্বর ৭, ১৯২৭ জন্ম পরম শ্রদ্ধেয় ভান্তে গুণরত্নের। ১১ বছর বয়সে শ্রামণ্যধর্মে
দীক্ষিত হন ও তিনমাস পর হাতে ব্যথা পাওয়ায় ঘরে ফিরে যান, এবং আবার ১২বছর বয়সে ১৯৩৯
সালে কুরুনাগালা জেলার সংঘনায়ক শীল, বিনয়ী ভদন্ত এ. সুমনতিষ্য মহাথেরোর নিকট
প্রবজ্যিত হন। ১৯৪৭ সালে উপসম্পদা লাভ করেন ক্যন্ডিতে। ধর্মীয় শিক্ষা নেন গামপাহা
বিদ্যাশেখারা পিরিবেন জুনিয়ার কলেজ, ক্যলেনিয়া বিদ্যালংকার কলেজ ও কলম্বো
বুড্ডিস্ট মিশনারী কলেজে। মহাবোধি সোসাইটির অধীনে ধর্মদূত করতে যান ভারতের সাঁচি,
দিল্লী ও বোম্বাই। পরে সেখান থেকে পণ্ডিত কে শ্রী ধর্মানন্দ ভান্তের সঙ্গে শাসনের
কাজ করতে মালেয়েশিয়া কুয়ালালামপুরে বুড্ডিস্ট মহাবিহারে আসেন। ১৯৬৮ সালে আমেরিকায়
শ্রীলংকার প্রথম বিহার “ওয়াশিংটন বুড্ডিস্ট বিহার” শুরুতে ওয়াশিংটন ডি.সি তে
সাধারণ সম্পাদক হয়ে আসেন এবং ১২বছর পর সভাপতি হন। এর মধ্যেই স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও
পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। পড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়েও, আমরিকা ও ইউরোপে। ১৯৭৫ সালে
আমেরিকায় আসা ভিয়েতনামী শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করেন, মানবিক সহায়তা দেন। সামাজিক
ভিক্ষুজীবন ছেড়ে দিয়ে ১৯৭৮ সালে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় বনজঙ্গল ঘেরা ৯৭ একর জুড়ে
‘ভাবনা সোসাইটি” প্রতিষ্ঠা শুরু করেন যা এখন আমেরিকায় সুপরিচিত থেরবাদ ধারার ভাবনা
অনুশীলনের শান্তিময় স্থান। অনেক বই লিখেছেন এই গুণী বুদ্ধপুত্র, ভাবনা শিক্ষক
শ্রদ্ধেয় ভান্তে: The Jhana in Theravada Meditations ( Ph.D অভিসন্দর্ভ),
Mindfulness in Plain English, Eight Mindful Steps to Happiness, Journey to
Mindfulness। পরম শ্রদ্ধেয় গুণরত্ন ভান্তে ২০২৩ সালে ৯৫বয়সেও ভাবনা কোর্স পরিচালনা
ও ধর্মদেশনা দিয়ে যাচ্ছেন “ভাবনা সোসাইটি”তে।
ভাষান্তর:
রতন জ্যোতি ভিক্ষু,
শ্রী
পঞ্ঞাসিহে ভাবনা কেন্দ্র,
পামডেল,
ক্যলিফোর্ণিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।
জুন
২৩, ২০২৩।
============
==============================
0 Comments