বৌদ্ধ
দর্শনে
মার
(একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা)
ত্রিপিটক সহ
বৌদ্ধ সাহিত্যগুলোতে মার
বিষয়ে নানা আলোচনা
পরিলক্ষিত হয়।
বুদ্ধের বুদ্ধত্ব লাভের প্রারম্ভিক থেকে
মহাপরিনির্বাণ পর্যন্ত মারের অশুভকর প্রতিবন্ধকতার উপস্থিতি বর্ণিত
হয়েছে।
বৌদ্ধ সাহিত্যে পাঁচ প্রকারের মারের কথা উল্লেখ আছে-
১. ক্লেশমার,
২. অভিসংস্কার মার,
৩.দেবপুত্র মার,(বশবর্তী স্বর্গবাসী দেবগণ)
৪, স্কন্ধ মার,
৫. মৃত্যূমার
কবি জ্যোতিপাল ভিক্ষু
প্রনীত উদান গ্রন্থে- মার বলতে- কাম,
অরতি, তন্দ্রালস্য, তৃষ্ণা;
সন্দেহ, ক্ষুধা পিপাসা,
পরগুণ মর্দনাভিলাস ও
মিথ্যালব্ধ যশাদির
উল্লেখ্ আছে।
Light of Asia মতে- অরতি, তৃষ্ণা,
রাগ ভয় অজ্ঞতা
কাম আত্মবাদ বিচিকিৎসা, শীলব্রতপরমাস, রূপরাগ,
অরূপরাগ ও
উদ্ধচ্চ বুঝায়।
এছাড়াও ত্রিপিটক সাহিত্য উল্লেখ আছে, রতি,
আরতি ও তৃষ্ণাকে মারের তিনকে কন্যা
বলে সম্বোধন করা
হয়েছে। অন্যদিকে কাম,
ক্ষুধা, পিপাসা প্রভৃতিকে অগণিত সৈন্য সামন্ত
বলে ব্যাখ্যাত হয়েছে
। যা মানুষের কল্যাণ পথে অথবা
ধ্যান ও মুক্তি
মার্গ পথে অগ্রসরের মহা প্রতিবন্ধক।
বর্তমানেও বুদ্ধের জীবনী সম্মেলিত যেসকল
গ্রন্থ সাহিত্যকগন রচনা
করেছেন সেখানেও বুদ্ধ
ও মারের মধ্যে
নানা বাদ প্রতিবাদ কথোপকথন সহ
মহারণের বিবরণ
পাওয়া যায়। যা
নানা সাহিত্যিকগন সাহিত্যরসে অতিরঞ্জনে সাহিত্যমান পুষ্ট করেছে। চিত্রকলায়, ভাস্কর্যে সহ
পর্বতগাত্রে অঙ্কিত
লিপিগুলোতেও এর
প্রভাব কম নয়।
গৌতমের বুদ্ধত্ব লাভের
প্রাককালে মারই
নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি
করে, মারের সাথে
ভয়াবহ যুদ্ধ চলে
বুদ্ধত্ব লাভের
অন্তিম রাতে। যা
বোধিসত্ত্ব গৌতমকে
জন্মানতরের দান
শীল ভাবনাগুণপারমী ও
ন্যায় ধর্ম প্রজ্ঞা বোধি প্রভাবে অতিক্রম করতে হয়েছিল। গৌতমের
এমন কৃত্যের কাছে
মার সেদিন শতবাধা
প্রতিবন্ধতার পরও
পরাজিত হয়ে পালিয়ে
গিয়ে ছিল। যা
বুদ্ধের জীবনী
চরিত গ্রন্থগুলোতে এরূপ
বর্ণিত হয়।
মার বিষয়ে ইংরেজী
লেখকরাও নানা
ভাবেই উপস্থাপন করেছেন-
Lewis Richmond লিখিত
Mara Looks Just Like Buddha
প্রবন্ধে ঠিক
এভাবেই বর্ণনা করেন-
Mara is the master
illusionist of Buddhism. He/she appears before Siddhartha the Buddha-to-be, who
is sitting under the Bo tree on the verge of his final enlightenment, to co-opt
and destroy Siddhartha’s spiritual quest. Mara Looks Just Like Buddha. Mara
says, “How presumptuous of Siddhartha … to assume the cross-legged posture on
the seat of Wisdom! He is desirous of passing beyond my control but I will
never allow it.” (These and subsequent quotes are from “The Buddha: His life
Retold by Robert Allen Mitchell.
তাহলে এখানে জিজ্ঞাস্য যে- বোধিসত্ত্ব গৌতম
সেইদিন বোধিমূলে শুধু
কি
বশবর্তী দেবলোকবাসী দেবপুত্র মারকে
জয় করেছিলেন? যেহেতু
ক্লেশমার, অভিসংস্কার, স্কন্ধমার আর
মৃত্যুমারের সংজ্ঞা
ভিন্ন। (নিম্নে পঞ্চমারের বিষয়ে আলোচনা করা
হল)
এছাড়াও প্রশ্ন জাগে-
ভগবান বুদ্ধ বোধিমূলে মারের সাথে যে
যুদ্ধ হয়েছিল তা
কি বাস্তবিকই বর্হিজগতে চক্ষেয় সমক্ষে ঘটেছিল
নাকি ভগবান বুদ্ধের অর্ন্তলোকে ঘটেছিল?
বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ বিষয়ে মহাপরিনির্বাণসূত্রে উল্লেখ্ আছে-
বুদ্ধ বৈশালীর মহাবনে
কূটাগারশালায় অবস্থান কালে সেবক শিষ্য
স্থবির আনন্দকে বলেছিলেন- “হে আনন্দ!
তথাগত ইচ্ছা করলে
এক বা কল্প
হতে কম বা
বেশিকাল পৃথিবীতে জীবিত থাকতে পারেন”। দুরন্ত
মার আনন্দকে ভীষন
আকার প্রদর্শন করাতে
তার চিত্ত মার
অধিকার করেছিল। সেই
জন্যে আনন্দ ভগবানকে - “আপনি কল্পকাল লোক হিতার্থে অবস্থান করুন বলতে ভুলে
যান”।
অতপর আনন্দ ভগবানের নিকট হতে চলে
গেলে, মার এসে
ভগবানকে বললেন-
হে সুগত! আপনি
পরিনির্বাণ লাভ
করুন। আপনার শিষ্যগণ সর্বশাস্ত্রে সর্ববিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ
করেছেন। আপনি
বচন দিয়েছিলেন, শাসনে
চারিপরিষদ (ভিক্ষু-ভিক্ষুণী, উপাসক-উপাসিকা) প্রতিষ্ঠিত হলে পরিনির্বাপিত হবেন।
উত্তরে ভগবান বলেন-
হে পাপমতি মার!
তুমি এখন নিশ্চষ্ট হও। অচিরেই তথাগত
পরিনির্বাণ লাভ
করবেন। সেই দিন
হতে তিনমাস পরে
তথাগত পরিনির্বাণ লাভ
করেছিলেন। (মহাপরিনির্বাণ সূত্র) এস্থলে
উক্ত মারটিও কি
বশবর্তী স্বর্গের দেবপুত্র?
বুদ্ধঘোষ প্রমুখ
ত্রিপিটকে খ্যাতিযশা বৌদ্ধ গবেষকগণ পঞ্চমারকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন-আভিধানিক অর্থে মার হল
মনের অকুশল মনোবৃত্তি কিংবা রিপুসমূহের অপশক্তি। (The Evil One) কাম লালসায়
প্রলুব্ধকারী শয়তান।
১. ক্লেশমারঃ ক্লেশ
পালি কিলেস শব্দের
অর্থ দাঁড়ায় চিত্তের কালিমা। আমরা
জানি চিত্ত বা
মন স্বভাবতঃ স্বচ্ছ
আযনার মত নিরমল।
চিত্তে বা মনে
ক্লেশ উৎপন্ন হলে
মানুষ শুভাশুভ জ্ঞান
হারিয়ে ফেলে।
মানুষ ক্লেশের দ্বারা
আক্রান্ত হয়ে
সর্বদা বিভিন্ন প্রকার
পাপকর্মে লিপ্ত
হয়। বৌদ্ধিক ব্যাখ্যায় ক্লেশ দশপ্রকার- লোভ,
দ্বেষ, মোহ ,মান
(আমিত্ববোধই মান),
মিথ্যাদৃষ্টি(বিপরীত
ধরনা, অনিত্যকে নিত্য,দুক্খে
সুখ, অনাত্মকে আত্ম),
বিচিকিৎসা(সন্দেহ),
স্ত্যানমিদ্ধ (চিত্তের অলসতা, সংকোচতা, অকর্মণ্যতা, অনুৎসাহ), ঔদ্ধত্য (চিত্তে অস্থিরতা সম্পাদন ও একাগ্রতার অভাবই
ঔদ্ধত্য), অহ্রী
(কায় বাক্য মনে
অকুশল কর্ম করতে
লজ্জাহীনতা) ও
অনপত্রপা (পাপে
ভয়হীন, পাপীদের নিকট
নরকের ভয়নেই কারন
তারা স্বর্গনরক বিশ্বাস করে না)
২. অভিসংস্কার মারঃ
অভি অর্থ অতিরিক্ত। যাকে অতিসংস্কার বলে।
ইহ জন্মের সংস্কার ছাড়াও জন্মানতরের সংস্কারকে বুঝায়। প্রসঙ্গত বলা
যায় বুদ্ধের দেশনা
শ্রবন করতে এসে
একজন মাটিতে আঁচর
কাটত, একজন গাছের
ডাল দোলাত, একজন
আকাশের দিকে তাকিয়ে
থাকত। এদের প্রথমজন অতীতে কেচো, দ্বিতীয়জন বানর এবং তৃতীয়
জন নক্ষত্রবিদ ছিল।
অতীত জন্মের অতিসংস্কারের প্রভাবও মুক্তি
প্রতিবন্ধক মার
বিশেষ।
অভিসংস্কার মারকে
তিনভাগে ভাগ
করা হয়েছে।
ক) পুঞ্ঞাভিসঙ্খারা,
খ) অপুঞ্ঞাভিসঙ্খারা,
গ) আনঞ্ঞভিসঙ্খারা
৩. দেবপুত্র মারঃ
বৌদ্ধ দর্শনে ৩১
প্রকার লোকভূমি রয়েছে। এর মধ্যে চার
অপায় ভূমি যেমনঃ
তির্য্যক, প্রেত,
অসুর, নিরয়। এখানে
সত্ত্বগণ জন্ম
হয় লোভ, দ্বেষ,
মোহ কারণে। অপায়
ভূমির উর্দ্ধে হল
মনুষ্য ভূমি। মনুষ্য
জন্ম লাভ করা
অতীব দুলর্ভ। তবে
ধ্যান সমাধি করার
জন্য মনুষ্যলোকই উত্তম।
তাই সিদ্ধার্থ মনুষ্য
ভুমিতে আর্বিভূত হয়ে
বুদ্ধত্ব লাভ
করেন।
এই মনুষ্যভূমি উর্দ্ধে ছয়টি স্বর্গভূমি যথাঃ
চর্তুমহারাজিক, ত্রয়তিংশ, যাম, তুষিত, নিমার্ণরতি ও পরিনির্মিত বশবর্তী। এরপর ষোলটি রুপভূমি রয়েছে। ব্রহ্ম
পারিষদ, ব্রহ্মপুরোহিত, মহাব্রহ্মা, পরিত্তাভ, অপ্রমাণাভ, আভাস্বর, পরিত্তশুভ, অপ্রমাণশুভ, শুভাকীর্ণ, বৃহৎফল, অসঞ্জসত্ত্ব, অবহা,
অতপ্ত, সুদর্শন, সুদর্শী, আকনিষ্ঠ। অরুপ
ভূমি চারটি যথা
আকাশানন্তায়ন, বিজ্ঞানানন্তায়ন, আকিঞ্চনায়তন ও
নৈব সংজ্ঞানাসংজ্ঞায়তন। দেবলোকে অবস্থানরত দেবপুত্রগণের অনেক অলৌকিক ঋদ্ধিশক্তির কথা ত্রিপিটকে উল্লেখ
আছে। তারা মারের
আবেশে বিভিন্ন সময়ে
বিভিন্ন আকারের
রুপ ধারন করে।
পরনির্ম্মিত বশবর্তী দেবলোকের দেবপুত্রগণ মাররূপে আর্বিভূত হয়ে নানান অলৌকিক
শক্তির কার্য সম্পাদন করে। দেবপুত্র মারগণ
সাধকদের জন্য
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে
দাড়ায়। পরনির্ম্মিত বশবর্তী দেবপুত্র মার সম্রাট অশোকের
৩য় সংগীতিতে অকুশল
শক্তি প্রয়োগ করেছিল। সেজন্য দেবপুত্র মারকে
দমন করার জন্য
অহর্ৎ উপগুপ্তকে সংঘ
দায়িত্ব দিয়েছিল। উপগুপ্ত স্থবির
বিভিন্ন প্রকার
ঋদ্ধিশক্তির সাহায্যে মারের উপদ্রব বন্ধ
করেন।
যা বৌদ্ধ সাহিত্যে বিশদভাবে বর্নিত।
৪ স্কন্ধ মারঃ
পঞ্চস্কন্ধ সমন্বয়ে জীবের জীবন গঠিত।
পঞ্চস্কন্ধ হল
রুপ, বেদনা, সংজ্ঞা,
সংস্কার ও
বিজ্ঞান। পঞ্চস্কন্ধ প্রধানত নাম
ও রুপ নিয়ে
বিভক্ত। বেদনা,
সংজ্ঞা, সংস্কার ও
বিজ্ঞান হল
নাম।আর রুপ হল
৩২ প্রকার অশুচি
পদার্থ। লোম,
নখ, দন্ত, ত্বক
প্রভৃতি। এই
পঞ্চস্কন্ধ সমন্বিত দেহ অনিত্য দুঃখ
ও অনাত্ন। অনুপাদিসেস নিবার্ণ লাভের
মাধ্যমে মানুষের পঞ্চস্কন্ধ দেহমার
ধ্বংস হয়। সোপাদিসেস নিবার্ণ প্রাপ্তির মাধ্যমে সিদ্ধার্থ গৌতম তৃষ্ণা লোভ,
দ্বেষ, মোহরুপ মারকে
পরাস্ত করলেও স্কন্ধ
মার বিদ্যমান ছিল।
বুদ্ধত্বলাভের পর
আশি বছর বয়সে
তিনি অনুপাদিসেস নিবার্ণের মাধ্যমে ক্লেশমারকে ধ্বংস করেন।
৫. মৃত্যুমারঃ পঞ্চস্কন্ধ দেহধারী জীবমাত্রই মৃত্যুর অধীন।
অর্থাৎ সংস্কার মাত্রই
অনিত্য। মৃত্যু
কারো কাম্য নয়।
তবুও জীবের মৃত্যু
আসে। চ্যুতি চিত্তের বা মনের উদয়ে
পঞ্চস্কন্ধ বা
নাম-রুপ বা
দেহ-মনের বিচ্ছিন্নতাকে বৌদ্ধদর্শনে মৃত্যু
বলে। কালমৃত্যু ও
অকালমৃত্যু ভেদে
দুপ্রকার। দেহ
মনের পরিবর্তনশীলতাকে কালমৃত্যু। ভববন্ধনে আবদ্ধ
প্রাণির মৃত্যু
অকালমৃত্যু। আর
বন্ধনছিন্নকারীর মৃত্যু
হল সমুচ্ছেদ মৃত্যু। জাতি, ধর্ম, বর্ণ,
গোত্র, লিঙ্গ, রাজা-প্রজা,
ধনী-গরীব, মুর্খ-পন্ডিত
ভেদাভেদ রীতিনীতি মৃত্যুতে নেই।
সুতরাং, মার সর্বদা
সজাগ সজীব ও
তৎপর থাকে। অথার্ৎ
সত্য সুন্দর ও
পবিত্রতার পরিপস্থি এক অশুভ মায়াময় প্রভাবই মারের
অস্তিত্ব প্রকাশ
করে। একমাত্র ধ্যান,
সমাধি প্রজ্ঞা ও
স্মৃতি অনুশীলনের মাধ্যমেই এই মায়াচ্ছন্ন আবেশ
হতে কিংবা জগত
হতে মানুষ মুক্ত
হতে পারেন।
_________________________
ফইচ
বুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত
0 Comments