বুদ্ধের অন্তিম আহার :"শূকরমদ্দব" নিয়ে আমাদের ভুল ধারণা----------
তথাগতের জীবনে দুইটি আহার অত্যন্ত উত্তম,উপাদেয়, উৎকৃষ্ট । যে আহার গ্রহণ করে বোধিসত্ত্ব বোধিজ্ঞান বা বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। সেই আহার বা পায়েস সুজাতা দান করেছিলেন। দ্বিতীয় আহার বা অন্তিম আহার হল চুন্দের আহার, যে আহার গ্রহণ করে বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন। সুজাতা দেবী যখন শুনলেন যে, তিনি যাকে পায়সান্না দান করেছেন তিনি বৃক্ষ দেবতা নন, স্বয়ং বোধিসত্ত্ব। তাঁর প্রদত্ত পায়সন্না গ্রহণ করে বোধিসত্ত্ব অনুত্তর সম্যক সম্বোধি লাভ করেছেন এবং সপ্ত সপ্তাহ ৭*৭ =৪৯ দিন সাতটি মহাস্থানে সেই পায়সন্না গ্রহণ করে তিনি অতিবাহিত করেছিলেন। এটা শুনে সুজাতা দেবি 'অহো,আমার পরম লাভ 'বলে মনে প্রীতি সৌমনস্য উৎপন্ন হয়েছিল। ৪৫ বছর পর বুদ্ধ সুজাতার সেই দান কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছিলেন। আর চুন্দের আহার গ্রহণ করেছিলেন মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন। এই দুই প্রকার আহারদান সমফলপ্রদায়ী,সমবিপাকান্ত এবং অপরাপর দান অপেক্ষা অধিকতর ফলপ্রদায়ী ও উপকারক।
বুদ্ধ ইতোমধ্য বৈশালীতে আয়ুসংস্কার বিসর্জন দিয়ে পাবায় নগরে চলে আসলেন। পাবায় বাস করতেন কর্মকার পুত্র চুন্দ। স্বর্ণকার বংশীয় জনৈক ধন কুবের (শ্রেষ্ঠি) ছিলেন। তিনি বুদ্ধকে প্রথমে দেখেই স্রোতাপন্ন লাভ করে স্বীয় আম্রকাননে বিহার নির্মাণ করে বুদ্ধকে দান করেছিলেন। ভগবান পাবায় আসলে আম্রকাননে অবস্থান করতেন। চুন্দ শুনেছিলেন যে আগামী বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ পরিনির্বাণ লাভ করবেন এবং তৎপূর্বে তাঁর রক্তামাশয় হবে। বুদ্ধের যেন রক্ত আমাশয় না হয় , হলেও যেন অধিক কষ্ট না হয় , রোগের উপশম হিসেবে কাজ করে তাই চুন্দ শূকরমদ্দব তৈরি করেছিলেন। সেই " শূকরমদ্দব" নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক ভুল বিভ্রান্তি রয়েছে।
প্রথমে জানব শূকরমদ্দব শব্দটির অর্থ - শূকরমদ্দব শব্দটির পালি শব্দ হল সূকরমদ্দব। মদ্দব শব্দটির আগে শূকর শব্দ হয়ে শূকরমদ্দব শব্দটি সাধিত হয়েছে। এখানে শূকর শব্দের অর্থ বরাহ। মর্দবের আগে শূকর শব্দটি যুক্ত হওয়ায় তাই অনেকে মনে করেন চুন্দ শূকরমদ্দব দান করেছিলেন তা শুকরের মাংস দ্বারা তৈরি করা খাবার আর ভগবান শুকরের মাংস খেয়ে রক্তামাশয় হয়েছিল যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা ও মিথ্যা। এটা শূকরমর্দব বা বরাহমর্দব ছিল না। বুদ্ধ চুন্দের শূকরমদ্দব গ্রহণ করে রক্তামাশয় হয় নি। চুন্দের আহারে বুদ্ধের রক্তামাশয় হয় নি তা কিন্তু বুদ্ধ আনন্দকে এক প্রকারেও বলে দিয়েছেন। আনন্দকে সম্বোধন করে বললেন " হে আনন্দ, কেউ কেউ চুন্দকে এরূপ বলে তাঁর হৃদয়ে অনুশোচনা আনয়ন করতে পারে 'চুন্দ, তথাগত যে তোমার নিকট শেষ আহার গ্রহণ করে দেহত্যাগ করেছে, তা তোমার জন্য অমঙ্গ, হানিকর'। হে আনন্দ তুমি এরূপ বলে তাঁর অনুশোচন অপনোদন করবে '' হে চুন্দ, তথাগত তোমার প্রদত্ত শেষ আহার গ্রহণ করে দেহত্যাগ করে, তা তোমার জন্য অত্যন্ত মঙ্গলদায়ক, সুখকর, তথাগত স্বয়ং আমাকে এই কথা বলেছে' এর দ্বারা বুঝা যায় চুন্দের আহার বুদ্ধের রোগ উৎপর কারণ নয়। ' এটা ছিল বুদ্ধের দ্বাদশ কর্মবিপাকের অন্যতম বিপাক, এটা নিয়ে নিচে আলোচনা করা হবে।
শূকরমদ্দব হল রসায়ন বিশেষ। রসায়ন শাস্ত্রে এটার উল্লেখ আছে। আচার্য বুদ্ধঘোষের মতে মুদুওদনস্স পঞ্চগোরসযূসপাচনৰিধানস্স নামেতং, যথা গৰপানং নাম পাকনাম” মৃদু ওদনের পঞ্চ যুক্ত যুস পাঁচনের বিধানের এই নাম। যেমন গবপানং নামে পাক নাম দৃষ্ট হয়। কারো মতে নাতি তরুণ,নাতি জীর্ণ বন্য বরাহের মৃদু স্নিগ্ধ,কাটামাংস,ঔষধি যোগে পক্ব বলে এটাকে শূকরমদ্দব বলা হয়েছে। শ্রদ্ধেয় শান্তরক্ষিত মহাস্থবির লিখিত পালি বাংলা অভিধানে ২য় খন্ডে ১৭২৯ পৃষ্ঠায় এটার অর্থ হল শূকরমর্দব, বেঙের ছাতা। Mr.Rhys David এর অনুবাদ করেছেন "মাটির নীচে জন্মায় এরুপ ছত্রাক বা ছাতার পরিমাণ বা মাত্র। Dr Bela Bhattacharya said that " "Opinion differs on the nature of the food surakamaddva. It may not have been pig's flesh. It may have been some sort of a mushroom. It may be assumed that the small mushroom also become graceful associated with Buddha's Last Meal. Thus Buddha's Last Meal is associated with Cryptogamous plant."( source : buddhayana, p - 217)
সাধারণ লোক প্রাণীহত্যা করে বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে খাদ্যভোজ্য প্রস্তুত করে দান করতে পারে, কিন্তু একজন স্রোতাপন্ন মার্গলাভীর কাছে তা অসম্ভব। আর্যশ্রাবকগণ জীবনান্তেও প্রাণীহত্যা করবে না অথবা হত্যা করতে আদেশও করবে না । শূকর হত্যা করে মাংস রান্না করবেন না। পূর্বে উক্ত হয়েছে চুন্দ স্রোতাপন্ন ছিলেন। তিনি ভগবানের প্রতি অত্যাধিক স্নেহবশত ভগবানের নিকট রক্তামাশয় না হবার উদ্দেশ্যে বা হইলেও যেন অতি যন্ত্রণাদায়ক না হয় সেই উদ্দেশ্যেে শুকরমদ্দব প্রস্তুত করেছিলেন। দেবগণ জানেন যে ভগবানের অদ্যকার আহারই শেষ আহার। তিনি আর আহার গ্রহণ করবে না। সেই হেতু দ্বিসহস্র দ্বীপ পরিবৃত চতুরমহাদ্বীপের দেবগণ সূকরমদ্দবে দিব্য ওজ প্রক্ষেপ করেন।দিব্য ওজ প্রক্ষিপ্ত হওয়ায় তা অতি গুরুভোজনে পরিণত হয়েছিল। ওজ মিশ্রিত করে দেবতারাও দানের অংশ নিয়েছিল। দেবগণ ব্যতীত সাধারণ মানুষ বা ভিক্ষুসংঘ জীর্ণ করতে পারবে না। সম্যক সম্বুদ্ধ ব্যতীত তা হজম করা অসম্ভব। তদ্ধেতু অপরকে পরিবেষণ করতে নিষেধ করেছিলেন এবং যা অবশিষ্ট ছিল তা মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে চুন্দকে নির্দেশ দিলেন। ভগবান শুকরমদ্দব ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করেন নাই। প্রজাবৃন্দ সহ সদেব, মার ও ব্রহ্মলোক এমন কাকেও দেখতেছি না তথাগত ব্যতীত অপর কেউ এই শূকরমদ্দব গ্রহণ করে জীর্ণ করতে পারবে। শূকরমদ্দব বিষাক্ত ছিল না বরং এটা ছিল পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। রক্ত আমাশয় ভোজনের পর মুহূর্তেই উৎপন্ন হয়েছিল বটেই কিন্তু ভোজনের ফলে রোগ উৎপন্ন হয় নাই। ভোজনের পূর্বে রোগ হলে বা শূকরমদ্দব পরিভুক্ত না হলে ব্যাধি অতি যন্ত্রণাদায়ক হইত, সুতরাং কুশিনারা পদব্রজে যাওয়া সম্ভবপর হত না। এর দ্বারা বুঝা যায়
চুন্দের প্রদত্ত শূকরমদ্দব ভগবানের রক্ত আমাশয়ের জন্য দায়ি নয়। এটা ছিল বুদ্ধের অতীতজন্মের কর্মের ফল। এটা বুদ্ধের দ্বাদশ কর্মবিপাক নামে আখ্যায়িত করা হয়। সেই ঘটনা এখানে অবতারণা করছি। অতীত জন্মে বোধিসত্ত্ব অবস্থায় একজন চিকিৎসক ছিলেন। সেই সময় এক শ্রেষ্ঠীপুত্রের আমাশয় রোগ হয়েছিল। চিকিৎসক বোধিসত্ত্ব ঔষধ প্রয়োগ করে শ্রেষ্ঠীপুত্রের রোগ ভাল করেছিলেন। কিন্তু শ্রেষ্ঠিপুত্র বোধিসত্ত্ব এর প্রাপ্য টাকা না দেওয়ার জন্য বলল তার রোগ ভাল হয় নি। বোধিসত্ত্ব ভাবল আমার ঔষধের মূল্য না দিলে সমস্যা নেই, কিন্তু এই শ্রেষ্ঠিপুত্র আমার ঔষধের অগুণ ভাষণ করেছে তাই এর প্রতিশোধ নিতে হবে সংকল্পবদ্ধ হলেন। অতঃপর শ্রেষ্ঠিপুত্রকে এমনভাবে ঔষধ প্রয়োগ করালেন তার রক্ত বমি ও রক্ত বিকার শুরু হয়। পুনঃ পুনঃ রক্ত আমাশয়ে তার মৃত্যুবরণ করে। এই অকুশর কর্মের ফলে বোধিসত্ত্ব দীর্ঘকাল নরক যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন। বোধিসত্ত্ব পরবর্তীকালে অনেকবার মনুষ্য কুলে জন্ম লাভ করলেও উক্ত কর্ম বিপাকের কারণে মহামারী হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। শেষ জন্মেও এই বিপাক তাকে রেহাই দেয় নি। সুতরাং এখন আমরা বলতে পারি যে চুন্দের শূকরমদ্দব খেয়ে তার আমাশয় হয় নি এটা ভগবানের অতীত বিপাকের অংশ ছিল। এই রক্তামাশয় ভগবানকে এতই দুর্বল যে চুন্দের আমবাগান থেকে কুশীনগর যেতে স্থানে স্থানে বারংবার বিশ্রাম নিতে হয়েছে। ভগবানের শরীরে ১০ ছদন্ত হাতির বল ছিল (১ টি ছদন্ত হাতি মানে ১০০০ হাজার মানুষের বলের সমান)। বুদ্ধ নিজে এই বিপাক এর কথা আনন্দকে বলেছেন -
তিকিচ্ছকো অহং আসিং সেটঠি পুত্তং বিরেচয়িং
তেন কম্ম বিপাকেন হোতি পাক্খন্দিকা মম।
এবং জিনো বিয়াকাসি ভিক্খু সংঘস্স অগ্গতো,
সব্বভিঞা বলপ্পত্তো আনোতত্তে মহাসরে।
সংসারবর্ত বিপাক বিনির্মুক্ত ভিক্খুগণ! পূর্ব জন্মে আমি চিকিৎসক হয়ে জনৈক শ্রেষ্ঠিপুত্রকে চিকিৎসা করেছিলাম সে আরোগ্য হয়ে মিথ্যা বলে প্রতারণা করায় আমি তাকে বিরেচন ঔষধ প্রয়োগে হত্যা করেছিলাম সেই অকুশল বিপাকজনিত এই অন্তিম জন্মে বুদ্ধত্ব লাভ করেও কর্ম বিপাক হতে নিষ্কৃতি না পেয়ে আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয়ে যন্ত্রণাদায়ক দুঃখ ভোগ করেছি।
বুদ্ধের এই কর্মফল থেকে আমাদেরও শিক্ষা নেওয়া উচিত। পাঁচটি অচিন্তনীয় বিষয়ের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অচিন্তনীয় বিষয় হল কর্ম ও কর্মফল। কোন কর্ম কখন ফল প্রদান করবে তা কেউ বলতে পারে না। এইজন্য বৌদ্ধধর্ম অকালিকো ধর্ম। যেখানে স্বয়ং বুদ্ধ পর্যন্ত কর্মফল থেকে রেহাই পায় নি,আর আমরা কি রেহাই পাব। তাই কর্ম করতে সাবধানি হতে হবে। সাবধানোর নেই। আমাদেরকে কায় সংযত,বাক্য সংযত এবং মন সংযত করতে হবে। এই ত্রিবিধ দ্বার সংযত করা সুখকর।
তথ্যসূত্রঃ
১) মহাপরিনির্বাণ সুত্তং – রাজগুরু শ্রীধর্মরত্ন মহাস্থবির সংকলিত ও অনূদিত।
২) বুদ্ধের অতীত কর্ম বিপাক-উপসংঘরাজ সুবোধিরত্ন মহাথের
৩) Buddhayana by Dr bela Bhattacharya.
৪) দীর্ঘনিকায় বাই ভিক্ষু শীলভদ্র।
৫) পালি বাংলা অভিধান - শান্তরক্ষিত মহাস্থবির।
লেখক : প্রিয়বংশ ভিক্ষু, এম . ফিল গবেষক,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আবাসিক : অতীশ দীপংকর মেমোরিয়াল কমপ্লেক্স।
0 Comments