ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু
প্রত্যেক মানুষের সর্বদা মরণানুস্মৃতি করা প্রয়োজন। সকলের জন্য মরণানুস্মৃতির অনুশীলন হল অতীব কল্যাণকারী।
মরণানুস্মৃতি কিভাবে করা যায়?
————————————-
সঠিক মরণানুস্মৃতি অনুশীলনের জন্য বুঝতে হবে যে, ভুল মরণানুস্মৃতি কি এবং এর থেকে কিভাবে বাঁচা যাবে।
যেরকম মা তাঁর একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর স্মৃতিতে ব্যথিত-ব্যাকুল হয়ে থাকেন সেরকম যদি আমরাও আমাদের মরণানুস্মৃতি কোনো প্রিয়জনের মৃত্যুর ভিত্তিতে করে সারাক্ষণ মরণানুস্মৃতি দ্বারা ব্যথিত-ব্যাকুল হয়ে পড়ি তাহলে তা সঠিক মরণানুস্মৃতি হয়না। তা ভুল পদ্ধতি হয়ে থাকে।
মানুষ যেরকম তাদের কেনো ভীষণ শত্রুর মৃত্যুতে খুব আনন্দিত ও প্রমোদিত হয়ে থাকে, সেরকম যদি আমাদের মরণাস্মৃতি কোনো অপ্রিয়জনের মৃত্যু আধারিত হয়ে আমরা তাতে আনন্দিত ও প্রমোদিত হয়ে থাকি, তাহলেও আমাদের সে মরণানুস্মৃতি সঠিক হবেনা।
যদি আমাদের মরণানুস্মৃতি এরকম ব্যক্তির মৃত্যুর উপর আধারিত হয়, যিনি আমাদের প্রিয়ও নন, আবার অপ্রিয়ও নন এবং আমাদের মন ধম্ম-সংবেগ বিহীন অন্য মনস্কতায় ভর্তি হয়ে শ্মশান ভূমিতে লাশ পোড়ানোর ডোম কিংবা কবর খননকারী শ্রমিকের মত এরকম চিন্তা করে যে, প্রতিদিন সংসারে কত লোক জন্ম নিয়ে থাকে এবং কত লোকের মৃত্যু হয়ে থাকে, এতে আমার কি আসে যায়? এরকম যদি কেহ উদাসীন অন্য মনস্ক চিন্তায় রত থাকে, তাহলেও সে মরণানুস্মৃতি সঠিক হবেনা। ভুল হবে।
কেহ নিজের উপর ধারালো খড়্গ উঠিয়ে হত্যার জন্য উদ্যত হলে যেমন আমরা অতীব ভয়-ভীত হয়ে পড়ি, সেরকম যদি কেহ নিজের উপর ঘটিত হওয়া আংশিক মৃত্যুর ভিত্তিতে মরণানুস্মৃতি করতে থাকে, তাহলেও সে মরণানুস্মৃতি সঠিক হবেনা।
সঠিক মরণানুস্মৃতির অনুশীলন করতে গিয়ে মনে কোনো রাগ বা আসক্তি থাকতে পারবেনা, দ্বেষ থাকতে পারবেনা, মোহাচ্ছন্ন বা বেহুঁশী হতে পারবেনা এবং ভয়ও থাকতে পারেনা। মৃত্যুর স্মৃতি যখন নির্ভয়তা দ্বারা ভরে যায়, যখন হর্ষ এবং রোদন বিহীন হয়, যখন অনিত্যবোধ জনিত প্রজ্ঞা দ্বারা ভর্তি হয়, তখন সেরকম মরণানুস্মৃতিই সঠিক হয়।
‘আমার মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবী’ মরণাস্মৃতির জন্য এ সত্যকে কখনও ভুলতে নেই। মৃত্যুর কারণ, সময় ও স্থান যদিও আমরা সঠিক জ্ঞাত নই, কিন্তু যে কোনো সময়, যে কোনো স্থানে, যে কোনো কারণেই আমার মৃত্যু হতে পারে। আমি আমার মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত রয়েছি। ক্রন্দন করতে করতে যদিও জন্ম হয়েছে, কিন্তু মৃত্যুটা হাঁসিমাখা হয়ে থাকুক। এরজন্য নিজেকে কুশলতা পূর্বক কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে পরিপক্ক করে নিতে হবে এবং পুষ্ট করে নিতে হবে। ইহাই হল সঠিক মরণানুস্মৃতি।
যদি কেহ ধনবান ও ক্ষমতাবান হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে সর্বদা ইহা মনে রাখতে হবে যে, আমার চেয়েও আরও অনেক ধনী ও ক্ষমতাবান লোক ছিল, যাঁরা সকলেই মৃত্যুবরণ করেছেন। আমিও মৃত্যুর হাত হতে বাঁচতে পারবনা। রাজা হোক বা প্রজা, বিদ্বান হোক বা বিদ্যাহীন, নারী হোক বা পুরুষ, শিশু হোক বা বৃদ্ধ, মনুষ্য হোক বা ইতর প্রাণী, ইহ লোকের হোক বা পরলোকের মৃত্যু কারো উপর কোনো রকমের দয়া করবেনা। প্রত্যেক প্রাণী সময়ানুসারে মৃত্যুবরণ করবেই। জীবিত ইন্দ্রিয়ের উপচ্ছেদ হয়েই থাকে। প্রত্যেক জন্ম গ্রহণকারী সত্ত্ব মৃত্যুর বিধান সাথে নিয়েই এসে থাকে। প্রত্যেক ফুল মলিন হওয়ার জন্যই ফুটে থাকে, প্রত্যেক প্রভাত সন্ধ্যা হওয়ার জন্যই উদয় হয়ে থাকে, প্রত্যেক বসন্ত পাতা ঝড়ার জন্যই পত্র-পল্লবে পুষ্ফিত হয়ে থাকে, প্রত্যেক পাত্র ভঙ্গের জন্যই তৈরী হয়ে থাকে। সেরকম জীবের মৃত্যুও হল জীবনের অনিবার্য পরিণতি। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। মৃত্যু কাউকে যোগ্য বা অযোগ্য বিচার করেনা, সময়মত প্রত্যেক প্রাণীর উপর মৃত্যু হাজির হয়ে থাকে। জীবনের প্রত্যেকটা শ্বাস আমাদেরকে মৃত্যুর দিকেই ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
আরোগ্যতা হল রোগ আসা পর্যন্তই, যৌবন হল বৃদ্ধত্ব আসা পর্যন্তই। অনুরূপভাবে জীবনও হল মৃত্যু আসা পর্যন্তই। প্রত্যেকে আরোগ্য-সম্পত্তি রোগ-বিপত্তিতে পরিবর্তন হয়ে যায়। প্রত্যেক যৌবন-সম্পত্তি জরা-বিপত্তিতে পরিবর্তন হয়ে যায়। অনুরূপভাবে প্রত্যেক জীবন-সম্পত্তি মরণ-বিপত্তিতে পরিবর্তন হয়ে যায়। যে কোনো জন্ম নেওয়া সত্ত্বের মৃত্যু কারো অস্ত্রের প্রহার দ্বারা, ভোজনের অপাচ্যতার দ্বারা, পিত্ত-বায়ু-কফের কুপিত হওয়ার দ্বারা, শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাওয়া দ্বারা, শীত-গরমের আধিক্যতার দ্বারা, আহার অভাবে দ্বারা ইত্যাদি আরও অনেক অনেক কারণ মৃত্যুর প্রত্যয় তৈরী হয়ে থাকে।
মৃত্যুর এরূপ সত্যকে জানতে থাকার মানে ইহা নয় যে, আমরা এ সমস্ত বিষয়ের কারণে সর্বদা চিন্তিত থাকব, আশঙ্খিত থাকব, ব্যাকুল থাকব, ভয়ভীত থাকব। বরং ইহার অর্থ ইহাই যে, আমাদেরকে প্রজ্ঞা পূর্বক এরূপ সত্যকে বুঝতে হবে যে, আমাদের দুর্লভ মনুষ্য জীবনের আয়ু হল খুবই সীমিত। আমাদেরকে এ জীবন ও বিষয় আসয়ের প্রতি গভীরভাবে আসক্ত হতে নেই। মৃত্যু হতে আমরা কদাপি মুক্ত হতে পারবনা। সুতরাং, আমাদের নিকট যা যতটুকু আছে, তাকে খুবই সচেতনভাবে ব্যবহার করতে হবে, যেরকম ঘরে আগুন লাগা ব্যক্তি সে আগুন নিভানোর জন্য তৎপর হয়ে থাকেন।
সমগ্র সংসার হল মরণ ধর্মী। আমিও মৃত্যুর অধীন। এ সত্যকে জানতে থাকা তো ভাল, কিন্তু ইহাকে উপরে উপরে কেবল বুদ্ধির স্তরে পর্যন্ত ইহার চিন্তন করতে থাকলে তখন তা নিছক বুদ্ধিবিলাস হয়ে থাকার বিপদ রয়েছে। যদি এরকম হয়ে থাকে তাহলে আমরা শ্মশান জ্ঞানের মত তীর্থক বা শ্মশানচারী প্রমাণিত হবো। সুতরাং সত্যকে গভীরে পর্যন্ত উপলব্দি করে ইহাকে প্রত্যক্ষ অনুভব করাই হল কল্যাণকারী। এজন্যই বিদর্শন ভাবনা করা হয়। বিদর্শন ভাবনা দ্বারা মনকে অন্তর্মুখী করে এ সত্যকে স্বয়ং অনুভব করতে হবে যে, আমাদের এ শরীর-প্রপঞ্চ এবং চিত্ত প্রপঞ্চ কতই না নশ্বর, কতই না মরণধর্মা, কতই না বিনাশধর্ম, ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনশীল এবং যা নশ্বর, তার মধ্যে এরকম মোহ-মূঢ়তা রয়েছে যে, ‘ইহা আমি (এতং মম), ইহা আমার’, (এসোহমস্মি), ইহা হল আমার আত্মা’ (এসো মে অত্তা) ইত্যাদি ধারণা বিদর্শন ভাবনা দ্বারা ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যায়। সাধক-সাধিকা আত্মভাব এবং অস্মিতাভাবের আসক্তি হতে দূর হয়ে যান। অন্তর্মুখী হয়ে এরূপ ইন্দ্রিয় জগতের নিরীক্ষণ করতে গিয়ে সেগুলির সুক্ষ্মতম পরিধি পর্যন্ত পৌঁছে থাকেন এবং তার চেয়েও অধিক পর্যন্ত গিয়ে নৈর্বাণিক স্থিতির মুক্ত অবস্থার সাক্ষাত করে থাকেন, যা হল ইন্দ্রিয়াতীত, ভবাতীত, লোকাতীত এবং যা বিনাশধর্মা এবং মরণধর্মা না হয়ে নিত্য, শাশ্বত, ধ্রুব, অমৃতধর্মা হয়ে থাকে। বিদর্শন ভাবনার এরূপ অনুশীলনের কারণে আমরা নিজেদের এরূপ পূর্ব সঞ্চিত সংস্কার সমূহ হতে মুক্তি লাভ করে থাকি, যা আমাদের অন্তর্মনের পাথরের রেখাঙ্কিত ঘেরার মত রয়েছে এবং যা প্রত্যেক মৃত্যুর ক্ষণে জাগ্রত হয়ে পুনর্ভবের কারণ হয়ে থাকে। এরূপ সংস্কার সমূহের উন্মুলনই মৃত্যুর পরে নতুন জীবন প্রদানকারী নৈসর্গিক প্রক্রিয়ার নিরোধ করে থাকে এবং এর থেকেই অমৃত পদ নির্বাণ লাভ হয়ে থাকে।
এরূপ অমৃত স্তর পর্যন্ত পৌঁছার জন্য সম্পূর্ণ মৃত্যুর ক্ষেত্রের আন্তরিকভাবে স্মৃতি সাধনা করা হয়। ইহাই হল মরণানুস্মৃতি ভাবনা, অনিত্য লক্ষণের বিদর্শন, যা মরণানুস্মৃতি দ্বারা আরম্ভ হয়ে থাকে। এজন্য মরণানুস্মৃতিকে মহান কল্যাণকারী ভাবনারূপে গণ্য করা হয়।
ভগবান তথাগত বলেছেন-
তস্মা হবে অপ্পমাদং, সুমেধসো সুমেধসো,
এবং মহানুভাবায, মরণস্সতিযা সদাতি।’
অর্থাৎ বিজ্ঞ ব্যক্তির উচিত যে, অপ্রমাদের সাথে মরণানুস্মৃতিকে অনুশীলন করা। যা হল অতীব মহানুভবশালী এবং মহামঙ্গলময়ী।
0 Comments