অকুশল চৈতসিক মানুষের জীবনকে কলুষিত করে
=============================
©Utsha Barua Joy, M.Phil
=============================
©Utsha Barua Joy, M.Phil
অকুশল চৈতসিক : লোভ, দ্বেষ ও মোহকেই বলা হয় অকুশল। আর চৈতসিক হলো মনোবৃত্তি। সহজ কথায় অকুশল চৈতসিক বলতে বুঝায় পাপ মনোবৃত্তি। অকুশল মূলক লোভচিত্ত, দ্বেষচিত্ত ও মোহচিত্ত উৎপত্তিতে অকুশল চৈতসিকগুলোই প্রাধান্য বিস্তার করে। সুতরাং যে মনোবৃত্তি বা চৈতসিক সমূহ জীবন দুঃখের এবং সেই দুঃখের হেতু তৃষ্ণার জনক, পরিপোষক ও পরিবর্ধক সেগুলোই অকুশল চৈতসিক। অকুশল চৈতসিক চৌদ্ধ প্রকার। যথা- ১. মোহ, ২. অহ্রী, ৩. অনপত্রপা, ৪. উদ্ধত্য, ৫. লোভ, ৬. দৃষ্টি, ৭. মান, ৮. দ্বেষ, ৯. ঈর্ষা, ১০. মাৎসর্য, ১১. কৌকৃত্য, ১২. স্ত্যান, ১৩. মিদ্ধ এবং ১৪. বিচিকিৎসা। নিম্নে এগুলো বর্ণিত হলোঃ
১. মোহঃ যদ্বারা সত্ত্বগণ মুহ্যমান হয়ে থাকে, তাই মোহ বা অজ্ঞানতা। অন্ধকার যেমন বস্তুসমূহ ঢেকে রাখে এবং চোখের দৃষ্টিশক্তিকে ব্যর্থ করে দেয়, তেমনি মোহ আলম্বনের যথার্থ স্বভাবকে ঢেকে রাখে এবং চিত্তের কল্যাণ ও সত্য দৃষ্টিকে ব্যর্থ করে দেয়। কুশল কর্মে মোহ অজ্ঞানতা বটে কিন্তু অকুশল কর্মে কু-প্রজ্ঞা নামে খ্যাত। চিত্তের অজ্ঞানতা উৎপত্তি মোহের লক্ষণ এবং আলম্বনের যথার্থ স্বভাব আচ্ছাদন করা এর কাজ।
২. অহ্রীঃ কায়, বাক্য ও মনো দুঃচরিত্রতায় লজ্জাহীনতাই অহ্রী। শুকর যেমন মানুষের পরিত্যক্ত মল ভক্ষণে কোনরূপ ঘৃণাবোধ করেনা, লজ্জাবোধ করেনা, তেমনি অহ্রীক ব্যক্তিও সজ্জনের পরিত্যক্ত পাপকর্মে ঘৃণা বা লজ্জা করেনা। আত্মমর্যাদার জ্ঞানহীনতাই এর উৎপত্তির কারণ।
৩. অনপত্রপাঃ কায় দুঃচরিত্রের কর্মফলের প্রতি ভয়হীনতাই অনপত্রপা। ত্রাসহীনতা এর লক্ষণ। পতঙ্গ যেমন অগ্নিশিখা আলিঙ্গনে ভয়হীন, অনপত্রপী ব্যক্তিও তেমনি পাপকর্ম সম্পাদনে ত্রাসহীন।
৪. ঔদ্ধত্যঃ আলম্বন হতে চিত্তের উৎক্ষেপনই ঔদ্ধত্য। চিত্তের অশান্তি এর লক্ষণ, অস্থিরতা সম্পাদন এর কৃত্য, অব্যবস্থিতা এর পরিণাম ফল এবং অনুচিত চিন্তা এর মূল কারণ। ভষ্মস্তুপে আঘাত করলে ভষ্মরাশি যেমন উৎক্ষেপিত হতে থাকে এই চৈতসিকও সেরূপে চিত্তকে আলম্বন হতে পুনঃ পুনঃ উৎক্ষেপন করতে থাকে।
৫. লোভঃ লিপ্সা, পিপাসা, কামনা, আসক্তি ইত্যাদি অর্থে লোভ। লোভ চিত্তকে রূপাদি আলম্বনে আসক্ত করে রাখে। ত্যজনীয় বিষয় পরিত্যাগ না করা এর লক্ষণ এবং বিষয়কে রক্ষা ও উপভোগ করা এর স্বভাব। সত্ত্বগণকে সুখ-মরীচিকায় লুব্ধ করে জন্ম-মৃত্যু প্রবাহে ভাসিয়ে দুঃখ সাগরে চালিত করা এর কাজ। লোভ সূত্র পিটকে ‘তৃষ্ণা’, অভিধর্ম পিটকে ‘অভিধ্যা’ এবং জয়মঙ্গল অষ্টগাথায় ‘সহস্রবাহু’ রূপে চিত্রিত হয়েছে।
৬. দৃষ্টিঃ দৃষ্টি বলতে এখানে মিথ্যাদৃষ্টি, বিপরীত দর্শন, মিথ্যাবাদকেই বুঝতে হবে। মিথ্যাদৃষ্টিক মনে করে তার অভিমতই সত্য, অন্য সব মিথ্যা। এরূপে মিথ্যায় মনঃসংযোগ দৃষ্টির লক্ষণ। আলম্বনের মিথ্যা ধারণা গ্রহণ এর স্বভাব। মিথ্যাদৃষ্টি পরকাল, কুশলাকুশল কর্মফল বুঝতে পারেনা। অনিত্যকে নিত্য, অনাত্মাকে আত্মা, দুঃখকে সুখ মনে করাই দৃষ্টির কাজ।
৭. মানঃ আমিত্ব বোধই মান। অন্যের সঙ্গে তুলনা পূর্বক ‘মান’ নিজকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। ধ্বজা সমূহের মধ্যে কেতু (বৃহৎ পতাকা) যেমন শ্রেষ্ঠ, তেমনি অন্যান্য ব্যক্তির মধ্যে নিজকে শ্রেষ্ঠ মনে করাই ‘মানের’ লক্ষণ। আমিত্ব বোধ অন্যের সাথে সৌন্দর্য, কৌলিন্য, বুদ্ধিমত্তা, বিদ্যাবত্তা, ধর্মজ্ঞান, চরিত্র প্রভৃতি নানা বিষয়ে নিজকে তুলনা করে এবং শ্রেষ্ঠ মনে করে। সমকক্ষ বা নীচ মনে করাও মানের লক্ষণ।
৮. দ্বেষঃ দূষণ স্বভাব বিশিষ্ট মনোবৃত্তিই দ্বেষ। আলম্বনকে হনন করে বলে এর অন্য না ‘প্রতিঘ’। আলম্বনের হিত-সুখের বিপদ আকাঙ্খা করে বলে এটা ‘ব্যাপাদ’। ক্রোধ বা চন্ডতা এর লক্ষণ। চন্ডতা বিষধর সর্প হতেও ভীষণতর; অন্তর্দাহে দাবাগ্নি সদৃশ। আত্মহিত সাধনে শত্র“সম; সর্বস্ব অহিত সাধনে পূতি-মূত্রবৎ।
৯. ঈর্ষাঃ পরশ্রীকাতরতাই ঈর্ষা। অন্যের মান, যশ, গুণ, সৌভাগ্য ও সুখ সমৃদ্ধির অসহিঞ্চুতা ও তজ্জনিত চিত্ত-ক্ষোভ ঈর্ষার লক্ষণ। এগুলোর উৎসন্নতা সাধন এর কৃত্য। পরনিন্দা, দোষারোপ, ছিদ্রান্বেষণ, বিপদ কামনা ঈর্ষার অভিব্যক্তি বা আকার। ঈর্ষা সর্বতোভাবে অহিতকর ও ভয়ংকর অকুশল চৈতসিক।
১০. মাৎসর্যঃ আত্ম সম্পত্তি সঙ্গোপনেচ্ছাই মাৎসর্য্য। আমার লব্ধ সম্পত্তি আমার প্রয়োজনার্থ, অন্যের জন্য নহে-এরূপে আত্ম সম্পত্তিই মাৎসর্য্যরে আলম্বন। লব্ধ সম্পদ আত্ম প্রয়োজনার্থ গোপন করে রাখা মাৎসর্য্যরে লক্ষণ। মাৎসর্য্যরে অপর নাম কৃপণতা, স্বার্থপরতা, নীচতা ইত্যাদি। মাৎসর্য্য চিত্তকে সঙ্কুচিত করে রাখে বিধায় দানাদি পরহিত সম্পাদনে অক্ষম থাকে।
১১. কৌকৃত্যঃ খেদ, অনুশোচনা, অনুতাপ, বিপ্রতিসা এবং তজ্জনিত উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগই কৌকৃত্য। এই উদ্বেগ দুই প্রকারে উৎপন্ন হয়। যথা- কুশল কর্ম করা হলনা এবং অকুশল কর্ম করা হল। অকুশল কর্মের পূর্ব সঞ্চিত অভ্যাস পরিত্যাগ করে কুশল কর্ম সম্পাদন করতে পারা যাচ্ছেনা বলে যে অনুশোচনা তাই কৌকৃত্য।
১২. স্ত্যানঃ চিত্তের অলসতা; আলম্বন সম্বন্ধে সঙ্কোচহীনতা ও অস্পষ্ঠতা; অকর্মণ্যতা; অনুৎসাহতাই হলো ‘থীন’ বা স্ত্যান। স্ত্যান চৈতসিক কুশল আলম্বন গ্রহণ করতে রোগ দুর্বল হস্তের ন্যায় শুধু শক্তিহীন নহে, অনিচ্ছুকও বটে। চিত্তের পরাক্রম বিনাশ এর কাজ।
১৩. মিদ্ধঃ নাম কায়ের অর্থাৎ বেদনা-সংজ্ঞা-সংস্কারের অকর্মণ্যতা, আলম্বনে সঙ্কোচভাবই মিদ্ধ। সম্প্রযুক্ত চৈতসিকের পরাক্রম বিনাশ এর কৃত্য। স্ত্যান ও মিদ্ধের উভয়ের কাজই হলো উদ্যমকে বিনাশ করা। উভয়ের লক্ষণই অকর্মণ্যতা। তাদের কাজ ও লক্ষণ একরূপ হওয়ায় পঞ্চ নীবরণে যুগলরূপে গৃহীত হয়েছে।
১৪. বিচিকিৎসাঃ সংশয়, সন্দেহ, দ্বিমতি, দোদুল্যমানাবস্থায়ই বিচিকিৎসা। চিত্ত যখন ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’র মধ্যে ঘড়ির দোলকের মত দুলতে থাকে তখন বিচিকিৎসার অবস্থা। কোন বিষয়ে মীমাংসার অক্ষমতা হেতু চিত্তের অস্থিরতা এর লক্ষণ। নানান আলম্বনে চিত্তকে পরিভ্রমণ করানো বিচিকিৎসার কাজ। অনিশ্চয়তা এর পরিণাম ফল।
এই চৌদ্ধ প্রকার অকুশল চৈতসিকের মধ্যে মোহ, অহ্রী, অনপত্রপা ও ঔদ্ধত্য সমস্ত অকুশলে জড়িত থাকে বলে “সর্ব অকুশল চিত্ত সাধারণ”। লোভ, দৃষ্টি, মান উৎপন্ন হয় লোভমূলক চিত্তে। দ্বেষ, ঈর্ষা, মাৎসর্য, কৌকৃত্য এই চার চৈতসিক দ্বেষ মূলক চিত্তে উৎপন্ন হয়। স্ত্যান ও মিদ্ধ চৈতসিকদ্বয় লোভ ও দ্বেষ মূলক উভয় অকুশল চিত্তে উৎপন্ন হয় বলে এদের নাম “অকুশল প্রকীর্ণ”। বিচিকিৎসা শুধু মোহমূলক চিত্তে সংযুক্ত থাকে বিধায় এটি একক এবং মৌলিক চৈতসিক। যেকোন প্রকার অকুশল কর্ম সম্পাদনে এদের কোননা কোন একটি অকুশল চৈতসিক উৎপন্ন হয়েই সম্পাদিত হয়।
0 Comments