Hot Posts

6/recent/ticker-posts

Ad Code

বৌদ্ধ পতাকার ইতিবৃত্ত ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু

 বৌদ্ধ পতাকার ইতিবৃত্ত

ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু
খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় অব্দে সম্রাট অসোকের পুত্র-কন্যা রাজকুমার মহেন্দ্র থের এবং রাজকুমারী সঙ্ঘমিত্রা থেরীর মাধ্যমে দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধম্মের বীজ বপন করা হয়েছিল। তখনকার সে বীজ আজ ফলে-ফুলে, শাখা-প্রশাখার মহীরুহ আকারে বিস্তার লাভ করেছে। শ্রীলঙ্কা যদিও একটি ছোট্ট রাষ্ট্র তথাপি বৌদ্ধ ধম্মের প্রচার-প্রসারে তারা বিশ্ব ব্যাপী অতীব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। সমগ্র পৃথিবীতে যখন কাগজ আবিস্কার হয়নি, সে যুগে তালপত্রে প্রথম বুদ্ধবাণী ত্রিপিটক লিখা হয় শ্রীলঙ্কায়। অট্ঠকথাও লিখা হয় শ্রীলঙ্কায়। শ্রীলঙ্কা হতে বুদ্ধবাণী ত্রিপিটক ও ইহার অট্ঠকথা পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে। অরহত সঙ্ঘমিত্রা থেরী প্রতিষ্ঠিত ভিক্ষুণী শাসন শ্রীলঙ্কা হতেই চীনে প্রবেশ করেছিল।
শ্রীলঙ্কাতেই বিশ্ববৌদ্ধ পতাকা (১৮৮৫) ও বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সঙ্ঘ (১৯৫০) বা World Fellowship of Buddhists, WFB’র জন্ম হয়েছে। শ্রীলঙ্কার উদ্যোগে এবং প্রচেষ্ঠায় জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক বৈশাখী পূর্ণিমাকে স্মরণ করতে ‘Vesak Day’ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে ২০০০ সাল হতে। শ্রীলঙ্কা তথা বিশ্বের বৌদ্ধ বরপুত্র অনাগারিক ধম্মপাল (১৮৬৪-১৯৩৩) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মহাবোধি সোসাইটি অফ ইণ্ডিয়া’র (১৮৯১) মরণপণ সংঘর্ষের প্রভাবে ভারতে বৌদ্ধ তীর্থ বুদ্ধগয়া, সারনাথ ইত্যাদি উদ্ধার হয়েছে এবং বৌদ্ধ ধম্মের পুনরুত্থান হয়েছে।
আজ এখানে বিশ্ব বৌদ্ধ পতাকা জন্মের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে আলোচনা করব। বিশ্ব বৌদ্ধ পতাকা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বৌদ্ধ ধম্মের বিশ্বজনীন প্রতীকরূপে আত্ম প্রকাশ করেছিল। সে পতাকায় রয়েছে ছয়টি বর্ণ বা জ্যোতি, যা বুদ্ধত্ব লাভের পরে চতুর্থ সপ্তাহে তিনি রতনঘর চৈত্যে পট্ঠান সম্বন্ধিত ধ্যানের সময় তাঁর শরীর হতে নির্গত হয়েছিল।
ইতিহাস
———-
বৃটিশ উপনিবেশের সময় শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে বৌদ্ধ পতাকার নক্সা তৈরীর জন্য সেখানকার প্রখ্যাত বৌদ্ধ চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটির সভাপতি বা চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকাললীন প্রসিদ্ধ বিদ্যোদয় পরিবেণের (বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠাতা (১৮৭৩), শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধম্ম পুনরুত্থানের অন্যতম অগ্রসেনা, দেশব্যাপী শিক্ষা বিস্তারে অসামান্য অবদানে গৌরবদীপ্ত প্রতিভা পরম পূজ্য হিক্কাদুবে শ্রী সুমঙ্গল মহানায়ক থের (১৮২৭-১৯১১)। সম্পাদক ছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রখ্যাত সমাজসেবী ও বৌদ্ধ ধম্মের বিশিষ্ট সংরক্ষক মি. করোলিস পূজিত গুণশেখর (১৮৫৪-১৯২৬)। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন সদ্ধম্মের অসাধারণ প্রবক্তা, বাগ্মীশ্বর, খৃস্টানদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে তিনবারের বিজয়ী ভদন্ত মিগেত্তুবত্তে গুণানন্দ থেরো (১৮২৩-১৮৯০), বিদ্যোদয় পরিবেণের ভূমিদাতা ও প্রধান পৃষ্টপোষক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী অনাগারিক ধম্মপালের পিতা মি. ডন করোলিস হেববিতরনে (১৮৩৩-১৯০৬), বৌদ্ধ ধম্মের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী, সমাজসেবী , অনাগারিক ধম্মপালের মাতামহ মি. এণ্ড্রিস পেরেরা ধম্মগুণবর্ধনে (১৮০৯-১৮৯০), বিশিষ্ট সমাজসেবী চার্লস এ ডে সিল্ভা, শিল্পপতি এবং সমাজসেবী পিটার ডে এব্রিউ (১৮৬২-১৯৪০), শ্রীলঙ্কার থিওসফিক্যাল সোসাইটির অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব এবং পিটার ডে এব্রিউ’র পিতা উইলিয়াম ডে এব্রিউ, সমাজসেবী এইচ. উইলিয়াম ফার্ণান্ডো এবং শিল্পপতি ও সমাজসেবী মি. এন. এস. ফার্ণান্ডো।
কমিটির সদস্যগণ অনেক সভা-সমাবেশের মাধ্যমে বুদ্ধের শরীর হতে নির্গত ষড়রশ্মিযুক্ত বৌদ্ধ পতাকার নক্সা তৈরী করেছিলেন। বিগত ২০০২ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি কলম্বো হতে ‘Sunday Observer’ পত্রিকায় ‘Colonel Olcott : The Great Buddhist Revivalist’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে-কর্ণেল (১৮৩২-১৯০৭) অলকট হলেন বিশ্ব বৌদ্ধ পতাকার নক্সা প্রস্তুত কারক। ঐতিহাসিক বিশ্বস্ত সূত্র মতে তা কিন্তু সঠিক নয়। যদিও ইহা সত্য যে, বিশ্ব বৌদ্ধ পতাকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমেরিকান থিওজফিক্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা কর্ণেল হেনরি অলকট মহোদয় প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন।
তাঁর অনুপস্থিতিতে উপরি উক্ত কমিটির লোকেরা পতাকার যে নক্সা তৈরী করেছিলেন, তার বর্ণ বা রং ঠিক থাকলেও আকার-আকৃতি ঠিক ছিলনা। পরে কর্ণেল অলকট এসে আকার-আকৃতির পরিবর্তন করে কিছুটা পরিমার্জিত করেছিলেন। ১৮৮৫ সালের ২৮শে এপ্রিল পবিত্র বুদ্ধ জয়ন্তী উপলক্ষে পূজ্য মেগিত্তবত্তে গুণানন্দ মহাথেরো প্রথম এ পতাকা জনসমক্ষে উত্তোলন করেছিলেন। সে বছরই বৃটিশ সরকার শ্রীলঙ্কায় বৈশাখী পূর্ণিমাকে রাষ্ট্রীয় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিলেন।
১৯৫০ সালে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় শ্রীলঙ্কা তথা বিশ্ববৌদ্ধদের প্রাণপুরুষ অধ্যাপক ড. গুণপাল পিয়সেন মালালাসেকর (G. P. Malasekera 1899-1973) মহোদয়ের উদ্যোগে আয়োজিত বিশ্ববৌদ্ধ সম্মেলনে স্থাপিত বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সঙ্ঘ বা World Fellowship Of Buddhists (WFB) গঠিত হলে বিশ্ববৌদ্ধদের দ্বারা এ পতাকা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে এবং সর্বত্র এ পতাকা সমাদৃত হয়। বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সঙ্ঘের কেন্ডী অধিবেশনে ২৫শে মে ১৯৫০ সালে বিশ্ব বৌদ্ধদের দ্বারা প্রথম বারের মত আন্তর্জাতিকভাবে এ পতাকা উত্তোলন করা হয়।
পতাকার রং


—————
এ পতাকায় ছয় প্রকারের বর্ণ বা রং ব্যবহার করা হয়েছে। পালি ভাষায় সেগুলির বর্ণনা হল নিম্নরূপ-
‘নীলবণ্ণো পীতোদাতো পভাস্সরো চ লোহিতো
মঞ্জিট্ঠানং গহং কত্বা ইধাযতো সিরিন্ধরো।
অর্থাৎ নীল, হলুদ, লোহিত (লাল), সাদা (ওদাত), মঞ্জিষ্ঠা বা পাকা কমলা বর্ণ এবং প্রভাস্বর বা উপরের পাঁচ বর্ণ মিশ্রিত।
নীলবর্ণ বুদ্ধের কেশধাতু হতে নির্গত হয়েছিল যার প্রতীক হল বিশ্বজনীন সকল প্রাণীদের প্রতি মৈত্রী ও করুণা। ইহা বৌদ্ধ ধম্মের শান্তি ও মৈত্রীর বার্তা প্রদান করে থাকে।
পীত বা হলুদ বর্ণ ভগবান বুদ্ধের দেহের ত্বক হতে নির্গত হয়েছিল। যার হল সমস্ত চরমকে পরিহার করার মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করে বিমুক্তির মধ্যম মার্গ নির্দেশক। এ মধ্যম মার্গ হল পরিপূর্ণ দুঃখ মুক্তি অর্থাৎ শূণ্যতার সূচক।
লোহিত বা লাল বর্ণ তথাগতের শরীরের মাংস হতে নির্গত হয়েছিল। তা হল জগৎ কল্যাণে বুদ্ধের ধম্ম প্রবর্তনের প্রতীক। লোহিত বর্ণ বুদ্ধের অপার অর্জন, প্রজ্ঞা, শীল এবং সম্মানকে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে।
সাদা বা ওদাত বর্ণ নির্গত হয়েছিল ভগবান বুদ্ধের দন্ত এবং অস্থি হতে। তা হল বুদ্ধের শিক্ষা ও সত্বদের মুক্তির শুদ্ধতা নির্দেশক। এ শ্বেত বর্ণের দ্বারা বুদ্ধের ধম্ম স্থান ও কাল নির্বিশেষে সর্বদা বিশুদ্ধতা ও মুক্তির জন্য বিদ্যমান থাকবে নির্দেশ করছে।
মঞ্জিষ্ঠা বা কমলা বর্ণ নির্গত হয়েছিল বুদ্ধের ওষ্ঠ, হাতের তালু এবং পায়ের গোড়ালিদ্বয় থেকে। ইহা বুদ্ধের অকম্পমান ও নিঃসন্দিগ্ধ শিক্ষা এবং প্রজ্ঞা সম্বন্ধিত ভাব প্রকাশক। বুদ্ধের অসীম প্রজ্ঞা, শক্তি এবং মর্যাদা সূচক হল এ মঞ্জিষ্ঠা বর্ণ।
প্রভাস্বর বা মিশ্রিত বর্ণ বুদ্ধের শরীরকে আবৃত করে রেখেছিল। তা বুদ্ধ শিক্ষার বিশ্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার প্রতীক। এ বর্ণ বুদ্ধই একমাত্র সত্য এবং তাঁর অদ্বিতীয়তা ঘোষণা করছে।
বিশ্ব বৌদ্ধ পতাকার জন্ম দিতে ৮ই জানুয়ারী ১৮৮৫ সালে প্রথম সভা হয়েছিল। এজন্য ৮ই জানুয়ারী বিশ্ব বৌদ্ধ পতাকার জন্ম দিনরূপে পালন করা হয়।

Post a Comment

0 Comments

Ad Code

Responsive Advertisement