কথিত ধুতাঙ্গজীবিদের ভয়াবহতা!!
নশ্বর সুজয়
==============================
আমাদের বড়ুয়া বৌদ্ধসমাজে সাধারন গৃহীরা যতদিন পর্যন্ত বুদ্ধের প্রকৃত দর্শন ও ত্রিপিটক বিষয়ক প্রাথমিক ধারনা থাকবে না ততদিন পর্যন্ত কিছু কিছু অতিধূর্ত ভিক্ষুরা অর্হৎ-মার্গলাভী ধূতাঙ্গধারী রূপ ধারন করে লাভ-সৎকারে ডুবে থাকবে।
মুলত “ধুতাঙ্গ” বুদ্ধ প্রজ্ঞাপ্ত কোনো শীল বা বিনয় নয়। এটি অল্পেচ্ছুক, বিনয়শীল, যথা লাভে সন্তুষ্টতা ও নির্মাণকামী ভিক্ষু-গৃহীদের ব্রত অধিষ্ঠান মাত্র। ধুতাঙ্গের তারতম্যানুসারে ভিক্ষু-শ্রামন ও সাধারন গৃহী যেই কেউ অধিষ্ঠান ও অনুশীলন করতে পারে।
এখানে উল্লেখ করা ভাল- ত্রিপিটিক সহ বৌদ্ধ সাহিত্যে আমরা ১৩ প্রকার ধুতাঙ্গের উল্লেখ দেখতে পাই। ভিক্ষু-গৃহী যেই কেউ এই ১৩টির ধুতাঙ্গের যেকোনো ১টি অধিষ্ঠান করলে কমপক্ষে এক ঋতুকাল অধিষ্ঠানটি নিরবিচ্ছিন্নভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ রক্ষা করতে হয়। (বৌদ্ধিক নিয়মে চার মাসে একঋতু) ।
তাহলে অধিষ্ঠানটির পূর্ণতা পায়। নিজের সুবিধামত দুই চারটা অধিষ্ঠান করলাম বাকিগুলো করলাম না, তাহলে “ধুতাঙ্গ সাধক” বলা অযৌক্তিক।
মূলত ধুতাঙ্গের ঊদ্দেশ্য হল স্ব স্ব চিত্তকে সর্বদিকে আরো একমাত্রায় সংযত ও দমন করার প্রয়াস মাত্র।
২২৭ শীল প্রতিপালন করেও যিনি সর্বদিকে অপ্রমত্ততার চর্চা করেন তিনি কোনো অংশে কমনয়। বরং এগিয়ে থাকেন
ত্রিপিটকে দেখা যায় ধুতাঙ্গ প্রতিপালনে কাশ্যপ ভান্তের চেয়ে অদ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। তাই বলে কি বুদ্ধের অন্যান্য শ্রাবকশিষ্যরা মার্গ লাভ করেন নি?
মোর্দ্দা কথা হল- চিত্তের অপ্রমত্ততার চর্চায় যিনি যতবেশী এগিয়ে তিনিই ততবেশী বুদ্ধাদর্শী।
আমি শতভাগ নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি- বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিংবা আধুনিক সময়ে ১৩টি ধুতাঙ্গ একসাথে, একই ঋতুতে পালন/রক্ষা করা সম্ভব নয়।
আমি সাধারন গৃহীদের কথা বাদই দিলাম, বর্তমানে প্রসিদ্ধ ধুতাঙ্গজীবী ভিক্ষুদের অনেকই পরিস্কার করে বলতে পারবে না, ত্রিপিটকের কোন কোন অংশে ধুতাঙ্গের আলোচনা হয়েছে। প্রসিদ্ধ ধুতাঙ্গজীবিদের অনেকই পুরো ত্রিপিটক পাঠ করে দেখার সদিচ্ছা টুকুও নেই।
সদ্ধর্ম রত্নাকর, রত্ন চৈত্য দু,একটি গ্রন্থ থেকে ৮/৯টি সুত্র মুখস্থ করে গানে সুরে পালি উচ্চারণ করে গাইতে পারলে তার জনপ্রিয়তা কে ঠেকায়? শশ্মানে বা পাহাড়/অরণ্যে ধুতাঙ্গের সাইনবোর্ড ঠাঙ্গিয়ে কিছুদিন থাকতে পারলে “ধুতাঙ্গ সাধক” উপাধির জনপ্রিয়তা কে ঠেকায়?
বিগত কয়েক বছর পূর্বে পরিচিত একটি গ্রামে এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল গ্রামবাসী সবাই।
কথিত এক ধুতাঙ্গজীবি সাময়িক পরিক্রমা করতে বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গিয়েছিল, ভিক্ষুটি একদিন শ্মশানে অবস্থান করবে হেতু ঐ শ্মশানের দেয়াল সহ তোরন /গেইট ভেঙ্গে ফেলতে হয়েছিল।
এভাবে শশ্মানের দেয়াল ভেঙ্গে, গেইট ভেঙ্গে, গাড়ির ছাদ খুলে ধুতাঙ্গের কতরকম ধোকাবাজি চলছে আমাদের বৌদ্ধ সমাজে।
বর্তমানে সাধারন মানুষের শ্রদ্ধাকে এভাবে পুঁজি করে ধুতাঙ্গের নামে রমরমা ব্যবসায় পরিনত করেছে এরা।
বিগত দিনে জনৈক এক কথিত ধুতাঙ্গজীবির আগমন উপলক্ষে রাস্তায় রাস্তায় যেভাবে শোডাউনের আয়োজন হয়েছে- রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীদেরকেও হার মানায়।
কয়েক বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠান ও মূর্তিস্থাপনার নামে এভাবে সাধারন মানুষের শ্রদ্ধায় প্রদত্ত লাখ লাখ টাকায় ভেস্তে দিয়েছেন কথিত ঐ ধুতাঙ্গজীবী।
তবে এর জন্যে আমাদের ভক্তিবাদী গৃহীরাই দায়ী।
ভক্তিবাদি গৃহীরাই ভক্তির জোরে নিজ নিজ মনগড়া আর্যপুরুষ, মার্গলাভী আর্যশ্রাবক, ধুতাঙ্গ সাধক সহ নানা উপাধি জুড়ে দিচ্ছে ভিক্ষুদের নামের সাথে। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায় ভিক্ষুরাও ঐ উপাধিগুলোতে ভিক্ষুজীবনের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রীতি অনুভব করেন।
মুলত ধুতাঙ্গ চর্চার অপর নাম হলো শুধু তেরো প্রকার ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠান করা নয়, নিজেকে একেবারে সঙ্কোচন করে ফেলা, জনবহুলতা থেকে একেবারেই সরিয়ে রাখা, প্রচার প্রসারতা থেকে নিজেকে একেবারে লুকিয়ে রাখা।
ধুতাঙ্গের গুণ উল্লেখ করতে মহাপ্রাঙ্গ নাগসেন ভান্তে রাজা মিলিন্দকে অভূতপূর্বভাবে তা ব্যাখ্যা করেছেন।”মহারাজ! ধুতাঙ্গ গুণরাজির দ্বারা যাহারা বিশুদ্ধ হননি তাদের ধর্মজ্ঞান লাভ হয় না।”
বিশুদ্ধিমার্গ গ্রন্থে দৃষ্ট হয়- দায়কের কাছে ভিক্ষুর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি না হওয়ার নিমিত্তে একজন ধুতাঙ্গচারী ভিক্ষু নিজেকে খুবই তুচ্ছ করে উপস্থাপন করেছিলেন।
এমনকি ত্রিপিটকে দেখা যায়, একই বিহারে খুবই ঘনিষ্ঠ দুইজন ভিক্ষু অবস্থান করার পরও একে অপরকে গোপন করেছিলেন ধুতাঙ্গ শীল অনুশীলনের কথা। যদি জানাজানি হয়ে যায় তাহলে, লাভ সৎকার বৃদ্ধির দরুন শীলপালনে প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে এ ভয়ে।
এছাড়াও অতিরঞ্জিত ব্রতচর্চার দোষ প্রকাশ করতে ত্রিপিটকে “জম্বুক স্থবিরের গাথায় উল্লেখ আছে-
পঞ্চপঞ্ঞাস বস্সানি রজো জল্লমধারযিং,
ভুঞ্জন্তো মাসিকং ভত্তং কেসমস্সুং অলোচযিং।
একপাদেন অট্ঠাসিং আসনং পরিবজ্জযিং,
সুক্খ গূথানি চ খাদিং উদ্দেসং চ ন সাদিযিং। .............।
বাংলা-
কাদা ধূলি মর্দনে করি অনশন,
মাসান্তে একাহারে ছিল জীবন,
প্রত্যহ কেশ-শ্মশ্রু করি উৎপাটন,
পঞ্চান্ন বৎসর এমন ব্রত করেছি পালন।
একপদে দাঁড়িয়ে দিবাও করতাম গত,
আহারেও উৎচিষ্ট খেতাম সতত।
এদাদৃশ হীনব্রতে জীবন সায়াহ্নে,
প্রতিষ্ঠিত হইনু আমি বুদ্ধের শরনে।
বুদ্ধেরই আজ্ঞাপথ করি অনুসরণ,
নির্বাণপ্রদ ধর্মেরগুণ করেছি দর্শন।
(অনুবাদে-নশ্বর সুজয়)
লিখতে গেলে অনেক কথা—- যদিও ধুতাঙ্গ বিষয়ে মূল ত্রিপিটকে তেমন বিশেষ সুস্পষ্ট বিবরণ পাওয়া যায় না, এমনকি ভিক্ষু পাতিমোক্খ গ্রন্থেও উক্ত তেরোপ্রকার শীল বা ব্রতগুলিকে উল্লেখ্ বা সংযোজন করা হয়নি। সঙ্গায়নে সঙ্গীতিকারকগণও ধুতাঙ্গ শীলগুলি বিনয়পিটকে স্পষ্ট উল্লেখ্ করেনি।
তবে বৌদ্ধ সাহিত্যের অনন্য পণ্ডিত বুদ্ধঘোষ বিরচিত বিশুদ্ধিমার্গ সহ বিমুক্তিমার্গ গ্রন্থে এর বিবরণ ও পালনবিধি দৃষ্ট হলেও ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কিছু প্রসঙ্গে অস্পষ্টতা রয়েগেছে। পূজনীয় প্রজ্ঞাবংশ মহাথের কর্তৃক বিরচিত“পরমার্থশীল ধুতাঙ্গ অনুশীলন ও গৃহী কর্তব্য” গ্রন্থে ত্রিপিটক ও পালি সাহিত্যের আলোকে তেরোপ্রকার ধুতাঙ্গের পালনবিধি সুবোধ্য ও পরিপূর্ণ যৌক্তিক ব্যাখ্যায় তুলে ধরেছেন। শ্রদ্ধেয় ভান্তের উক্তগ্রন্থটিই বৌদ্ধসাহিত্যে অন্যতম সংযোজন ধুতাঙ্গব্রত পালনকারীদের জন্যে।
এছাড়াও থেরগাথায় বর্ণিত ধুতাঙ্গব্রত অনুশীলনে বুদ্ধের সমকালীন ভিক্ষুদের মধ্যে মহাকাশ্যপ স্থবির অদ্বিতীয়। ধুতাঙ্গব্রত অনুশীলনের আনিসংশ এতোটাই মহৎ ও শ্রেষ্ঠ যে, তা স্বয়ং তথাগত বুদ্ধই বারংবার ব্যাখ্যা করেছিলেন।
বুদ্ধগণের বৈশিষ্ট্য বা ধর্মতা মতে বুদ্ধগণের ব্যবহার্য পাত্র-চীবরাদি অন্যকোনো ভিক্ষুশিষ্যগণ ব্যবহারের যোগ্যতা রাখে না, অন্তত গুণাকর বুদ্ধের শীলগুণ প্রজ্ঞাগুণ এতোই অসীম যে, তার ব্যবহার্য বস্তুআদি ব্যবহার বা ধারন করা কারোপক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি সারিপুত্র মহামোগ্গলায়নের মতো অগ্রশ্রাবকগণের পক্ষেও নয়।
তবে, বুদ্ধের জীবনদশায় স্বয়ং বুদ্ধই একমাত্র ধুতাঙ্গশ্রেষ্ঠ মহাকাশ্যপ স্থবিরের সাথেই ব্যবহার্য চীবর বিনিময় করেছিলেন, কেননা ধুতাঙ্গ প্রতিপালনের এতো গুণবহন করে তা বর্ণনাতীত। বুদ্ধগণের ধর্মতা অনুসারে এক বুদ্ধের জীবনে এমন ঘটনা একবারই ঘটে থাকে। মহাকাশ্যপ স্থবিরই একমাত্র যোগ্য ছিলেন তা ধারন করতে।
এছাড়াও মহাপরিনির্বাণ সূত্রে দৃষ্ট হয়, ধুতাঙ্গ প্রতিপালনের মহত্ত্বতা কিরূপ, মল্লদের শালবনে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ হলে সপ্তাহকালাধিক ব্যাপী বিভিন্ন রাজ্যের রাজা প্রজা সহ ভিক্ষুশিষ্যেগণ সকলে সমবেত হয়েও পরিণির্বাপিত বুদ্ধের শ্মশানে অগ্নি সংযোগে ব্যর্থ হন। সপ্তাহান্তে ধুতাঙ্গশ্রেষ্ঠ মহাকাশ্যপ স্থবির উপনীত হয়ে বুদ্ধের শ্মশানাগ্নি সংযোগ করেছিলেন।
ধুতাঙ্গ প্রতিপালনের এমনই মহত্ত্বতা।
প্রসঙ্গত বলতে হচ্ছে—
বর্তমানে আমাদের সমাজে গতানুগতিক ধুতাঙ্গজীবিদের বিপরীতেও প্রচার বিমুখ ধুতাঙ্গ চর্চাকারী ভিক্ষুও কম নেই,
সত্যিকথা বলতে আমরা দায়কশ্রেনীর হুযুগী দায়করা ব্যতিক্রমী কিছু দেখলে নিজেদেরকে সামাল দিতে পারি না, হোক না তা বুদ্ধের মতাদর্শের বাহিরে, তাতে কি।?
অনুরোধ থাকবে আমার মতামতটি কেউ যেন বিকৃত দৃষ্টিতে না নেন, মূলবক্তব্য হচ্ছে— বৌদ্ধধর্মের বিকৃত চর্চা রোধ করা। বুদ্ধের নির্বাণ প্রদায়ী ধর্মের প্রথম ভিত্তি হলো জ্ঞানপূর্বক অপ্রমত্তার চর্চা করা। কঠোর ব্রতও মুক্তির প্রতিবন্ধক। প্রজ্ঞাহীন শীল বা ব্রত অনুশীলনেও সাধনার পূর্ণতা আসে না। একে ত্রিপিটকের ভাষায় “শীলব্রতপরমাস” বলে- যা মিথ্যা শীল বা মিথ্যাব্রতের অনুশীলন বুঝায়।
যিনি যত বেশী নিজেকে জনবহুলতা থেকে গোপন করতে সক্ষম তিনিই হতে পারেন প্রকৃত ধুতাঙ্গজীবি। নচেৎ ভিন্ন গতি।
0 Comments