রত্ন সূত্রের উৎপত্তি :
-------------------------- ---
ভগবান বুদ্ধের জীবদ্দশায় বৈশালী অতিশয় সমৃদ্ধশালী নগর ছিল। কালের গতিকে সর্ববিধ উপভোগ্য পরিভোগ্য বিত্তসম্পদ সমৃদ্ধ বৈশালীতে অনাবৃষ্টি দেখা দিল। অনাবৃষ্টির দরুণ কৃষকগণের শস্যক্ষেত্র বিনষ্ট হইয়া ভীষণ দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া পতিত হইল। প্রথমে সহায় সম্বলহীন দরিদ্র মানুষেরা অনাহারে মৃত্যু বরণ করিতে লাগিল। তাহাদের মৃতদেহ নগরের বাহিরে ফেলিয়া দেওয়া হইত। কাজেই মৃতদেহের ভীষণ দুর্গন্ধ পাইয়া প্রেত-পিশাচাদি অমনুষ্যগণ নগরে আশ্রয় গ্রহণ করিল। কালক্রমে এত অধিক লোকের মৃত্যু হইতেছিল যে, মৃতদেহের সৎকার করা অসম্ভব হইয়া পড়িল। পঁচা-দুর্গন্ধময় মৃতদেহ দেখিতে দেখিতে ভয়ানক ঘৃণার উদ্রেক হইল, ঘৃণার দ্বারা নগরে বিসুচিকা রোগের প্রাদুর্ভাব হইল। দুর্ভিক্ষ, রোগ ও অমুনষ্য উপদ্রব এই ত্রিবিধ ভয়ে সন্ত্রস্ত বৈশালীবাসী প্রজাসাধারণ রাজার নিকট উপস্থিত হইয়া তাহাদের অসহ্য দুঃখ-কাহিনী বিবৃত করিতেছিলেন-
“মহারাজ, নগরে ত্রিবিধ ভয় উৎপন্ন হইয়াছে। ইতিপূর্বে রাজ-পরম্পরা সাত রাজার রাজত্ব কাল পর্য্যন্ত এরূপ দুর্দশা দেখা যায় নাই। আমাদের মনে হয়- ইহা আপনার অধার্মিকতার দ্বারাই ঘটিতেছে।” এতদশ্রবণে রাজা উদ্বিগ্ন চিত্তে মন্ত্রণাগৃহে সম্মিলিত হইয়া বলিলেন- “তোমরা আমার অধার্মিকতা সম্বন্ধে বিবেচনা করিয়া দেখ।” তাহারা সকলে বিচার করিয়া রাজার কোনও দোষ দেখিতে পাইলেন না।
অতঃপর তাহারা রাজার কোন প্রকার দোষ দেখিতে না পাইয়া ভাবিতে লাগিলেন- “কি প্রকারে আমাদের এই দুর্দশার অবসান হইবে?” তথায় কেহ কেহ বলিতে লাগিল- পুরাণ কশ্যপ, মক্ষলি গোশাল প্রভৃতি আজীবক (সন্ন্যাসী) শাস্তাগণ আছেন। তাহাদের পদধূলি পড়িলেই বৈশালীর মঙ্গল হইবে। অপর কেহ কেহ বলিতে লাগিল- “জগতে বুদ্ধ উৎপন্ন হইয়াছেন। সেই ভগবান সমস্ত প্রাণীর হিতের জন্য ধর্মোপদেশ করিয়া থাকেন। তিনি মহাঋদ্ধিবান, মহাপ্রভাবশালী। তাঁহার পদার্পণেই আমাদের সমস্ত ভয় তিরোহিত হইয়া যাইবে।”
‘বুদ্ধ’ এই নাম শুনিয়া তাহারা সকলে আনন্দিত হইয়া বলিতে লাগিল- “ভগবান বুদ্ধ সম্প্রতি কোথায় অবস্থান করিতেছেন? আমরা যদি লোক প্রেরণ করি, তিনি আসিবেন কি?” এ প্রস্তাবে অপর কেহ কেহ বলিতে লাগিল- “বুদ্ধগণ লোকের প্রতি অনুগ্রহকারী, কেন আসিবেন না?” তিনি এখন রাজগৃহে আছেন, মহারাজ বিম্বিসার তাঁহার সেবা করেন। তিনি যদি আসিতে বাধা না দেন, তবে অবশ্যই আসিবেন। “তাহা হইলে রাজাকে জানাইয়া আনয়ন করিব।” এই ভাবিয়া তাহারা দুইজন লিচ্ছবিকুমারকে সৈন্যবাহিনীসহ প্রভূত উপঢৌকন দিয়া রাজা বিম্বিসারের নিকট পাঠাইলেন এবং বলিলেন “রাজা বিম্বিসারকে বলিয়া ভগবানকে লইয়া আস।” তাঁহারা রাজগৃহে যাইয়া, রাজা বিম্বিসারকে তাঁহাদের উপঢৌকন প্রদান পূর্বক মনোবাঞ্চা নিবেদন করিলেন। রাজা তাঁহাদের অনুরোধ রক্ষা করিতে অসমর্থ হইয়া কহিলেন- “ইহা তোমরাই বুঝিতে পার।”
তাঁহারা ভগবানের চরণে উপনীত হইয়া প্রার্থনা করিলেন- “ভন্তে, আমাদের নগরে ত্রিবিধ ভয় উৎপন্ন হইয়াছে, যদি করুনাধার ভগবান করুনা করিয়া একবার বৈশালীতে শুভপদার্পন করেন, আমাদের অশেষ কল্যাণ সাধিত হইবে।”
তখন ভগবান সর্বজ্ঞতা প্রভাবে চিন্তা করিয়া দেখিতে পাইলেন- “আমি যদি বৈশালীতে ‘রত্নসূত্র’ দেশনা করি, তাহা হইলে ইহা কোটি শত সহস্র চক্রবালের রক্ষাদ- সদৃশ হইবে এবং চুরাশী হাজার প্রাণীর ধর্মজ্ঞান উৎপন্ন হইবে।” এই চিন্তা করিয়া ভগবান তাঁহাদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিলেন।
রাজা বিম্বিসার ভগবান নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়াছেন জানিয়া যথোচিত উৎসব এবং ধুমধামের সহিত আগু বাড়াইয়া দিলেন। আর বৈশালীবাসীর ও রাস্তা-ঘাট সুসজ্জিত করিয়া স্তসম্মানে ভগবান বুদ্ধকে আগু বাড়াইয়া লইলেন। ভগবান বৈশালীর সীমায় পৌঁছিলে লিচ্ছবিগণ রাজা বিম্বিসারের চেয়ে দ্বিগুণ পূজা করিলেন।
সেই সময় আকাশ হঠাৎ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল এবং বিদ্যুৎ চমকিয়া গড় গড় শব্দে মেঘ গর্জ্জন করিতে করিতে বারিবর্ষণ আরম্ভ করিল। মূষলধারে বারিবর্ষণের ফলে যেই জলপস্নাবন হইয়া ছিল, তাহা দ্বারা বৈশালীর দুর্গন্ধ মৃতদেহ ভাসিয়া গিয়া ভূভাগ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হইয়া গেল। ভগবান যখন বৈশালীতে উপনীত হইলেন, তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবপরিজন পরিবৃত হইয়া তথায় উপস্থিত হইয়াছিলেন। মহাপ্রভাবশালী দেবতাগণের আবির্ভাবে প্রেত-পিশাচাদি অমনুষ্যদের অনেকে অন্তর্হিত হইয়া গেল।
অতঃপর ভগবান বুদ্ধ, প্রিয় শিষ্য আনন্দ স্থবিরকে ডাকিয়া কহিলেন- “আনন্দ, এই ‘রত্নসূত্র’ শিক্ষা করিয়া ধর্মপূজার উপকরণ সমূহ গ্রহণ করাইয়া লিচ্ছবি কুমারগণসহ বৈশালী নগরে তিনটি প্রাকারের অন্তরে বিচরণ করিতে করিতে আবৃত্তি কর।” কোটিলক্ষ চক্রবালের দেবতাগণ সেই ‘রতন সূত্রের’ আদেশ পালনে বাধ্য হয়। তাহারই প্রভাবে বৈশালীর রোগভয়, অমনুষ্য ভয় ও দুর্ভিক্ষভয় শীঘ্রই অন্তর্হিত হইয়া যাইবে। স্থবির আনন্দ ভগবানের আদেশে পরিত্রাণ পাঠ করিতে করিতে ভগবানের ব্যবহৃত পাত্রে জল লইয়া সমস্ত নগরে ছিটাইয়া ছিটাইয়া বিচরণ করিয়াছিলেন। এই জন্য ভূমিকায় বলা হইয়াছে “বেসালিযা পুরে তিসু পাকারন্তরেসু ...... আযস্মা আনন্দথোরো বিয কারুঞ্ঞচিত্তং উপট্ঠপেত্বা।”
0 Comments