তথাগত বুদ্ধ আস্তিক যেমন নন, তেমনি তিনি নাস্তিকও নন। তিনি ছিলেন বাস্তববাদী। বুদ্ধ কোনো রকমের কল্পনার উপর ভিত্তি করে ধম্ম প্রচার যেমন করেননি, তেমনি তিনি কাউকে স্বর্গ পাইয়ে দেওয়ার কোনো মিথ্যা আশ্বাসও দেননি এবং নরকের শাস্তির ভয়ও কাউকে দেখাননি। তিনি মৃত্যু পরবর্তী জীবনের স্বপ্নে বিভোঢ় হতে শিক্ষা দেননি। তাঁর উপদেশ ছিল অতীত সম্পর্কে অনুশোচনা না করা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রলোভনের ফাঁদে পা না দেওয়া ( অতীতং নানুসোচন্তি, নপ্পটিকঙ্খে অনাগতা)। তিনি উপদেশ দিয়েছেন-‘পচ্চুপ্পন্না চ যে ধম্মা তত্থ তত্থ বিপস্সতি’ অর্থাৎ বর্তমান সময়ে ষড়েন্দ্রিয় দ্বারে উৎপন্ন বিষয়কে স্মৃতি সজাগতা সহকারে দর্শন করে কুশল ধম্মকে ধারণ করতে এবং অকুশল ধম্মকে ত্যাগ করতে। কেহ মুক্ত করে দেবেন বা উপর হতে কেউ দয়া করবেন-এরূপ ভেবে কারো উপর ভরসা করে বসে না থাকতে উপদেশ প্রদান করেছেন। বুদ্ধের উক্তি হল-‘অত্তাহি অত্তনো নাথো, কোহি নাথো পরোসিযা?’ অর্থাৎ নিজেই নিজের ত্রাণকর্তা বা রক্ষাকর্তা, নিজে ছাড়া অন্য অন্য আর কোথায় ত্রাণকর্তা আছে?
অতীত হতে এখনও পর্যন্ত কাল্পনিক ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার নামে লোকদেরকে মুর্খ বানিয়ে ধর্মগুরুরা তাঁদেরকে ধর্মের নেশা পান করিয়ে অন্ধের মতো ব্যবহার করার কাজ করছেন মোল্লা-পুরোহিতেরা। এ সংসারে কোনো ঈশ্বর, আল্লাহর অস্তিত্ব নেই। অথচ ঈশ্বর-আল্লাহর ভয় দেখিয়েই লোকদেরকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিরন্তর গোলাম বানিয়ে রেখেছেন ধর্মের ঠিকাদার পুরোহিতেরা। পুরোহিতেরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করার জন্য কাল্পনিক ঈশ্বর-আল্লাহ এবং স্বর্গ-নরকের ফাঁদ সৃষ্টি করেছেন।
এ পৃথিবীর উৎপত্তি যেমন কার্য-কারণের উপর হয়, তেমনি কার্য-কারণের দ্বারা সবকিছু চলমানও রয়েছে এবং বিলয়ও হয় কার্য-কারণের মাধ্যমে। যাকে বুদ্ধ ‘পটিচ্চসমুপ্পাদ নীতি’ বলে অভিহিত করেছেন এবং এ পটিচ্চসমুপ্পাদ নীতি বা Defended Origination হল বুদ্ধের নিজস্ব আবিস্কার। এ পটিচ্চসমুপ্পাদ নীতিকে গভীরভাবে গবেষণা করেছেন আধুনিক বিশ্বের সেরা দু’জন পদার্থ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫) এবং স্টীফেন হকিন্স (১৯৪২-২০১৮)। তাঁরা বলেন পদার্থ বিজ্ঞানের এখনও পর্যন্ত অদ্বিতীয় এবং সর্বোচ্চ গবেষণার অধিকারী। বুদ্ধের কার্য-কারণ তত্বকে আইনস্টাইন নামকরণ করেছেন ‘Theory of Relativity’. বুদ্ধ এবং আইনস্টাইনের সমান্তরাল সিদ্ধান্ত বিষয়ে গবেষণা পুস্তক রচনা করেছেন প্রখ্যাত গবেষক Thomas J. McFarlane.
আরেক অদ্বিতীয় পদার্থ বিজ্ঞানী স্টীফেন হকিন্স তাঁর ফাইনাল পুস্তকে ব্যক্ত করেছেন-There is No god and there is probably no heaven and no afterlife.’ এরূপ সাহসী বাক্য স্টিফেন হকিংয়ের মতো অদ্বিতীয় বিজ্ঞানী বলেছেন বলে সবাই চুপ করে রয়েছেন। আমরা কেহ বললে এখন হাজারো লোক আক্রমণ করতে তেড়ে আসতো। বিজ্ঞান জগতে স্টিফেন হকিন্সের এত বেশী প্রভাব ছিল যে, তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর মুখোমুখি হয়ে মোকাবিলা করার জন্য কেহ সাহস দেখাতে পারেননি।
বাংলা-ভারত উপমহাদেশের মতো রাষ্ট্র সমূহ লোকদেরকে ধার্মিক অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখে ধার্মিক গোলাম বানানোর জন্য ধর্মগুরু তথা মোল্লা-পুরোহিতেরা ঈশ্বর, স্বর্গ-নরক ইত্যাদির অবতারণা করেছেন। আমাদের দেশের নীতি নির্ধারকেরা ধার্মিক অন্ধ বিশ্বাস হতে মুক্ত হতে পারছেননা বলে আমাদের দেশ সমূহ উন্নতি করতে পারছেনা। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে অন্ধ বিশ্বাস ও অন্ধ মান্যতায় ডুবিয়ে রেখেছে সবাইকে। আজ হতে আড়াই হাজার বছরেরও পূর্বে তথাগত বুদ্ধ বিজ্ঞানবাদী সদ্ধম্মের নির্মাণ করেছিলেন এবং ধর্মান্ধতা হতে মানুষকে মুক্ত করেছিলেন। মৌর্য শাসক সম্রাট অসোক বাস্তববাদী বুদ্ধের বাস্তব সম্মত বৈজ্ঞানিক ধম্মকে গ্রহণ করে ইহার ব্যাপক প্রচার-প্রসার করলে ভারতবর্ষ অভাবনীয় উন্নতি ও বিশ্বগুরুর আসন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বুদ্ধের এ বিজ্ঞাবাদী ধম্মকে কাল্পনিক ঈশ্বরবাদী স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণেরা নষ্ট করে ব্রাহ্মণ্য যজ্ঞবাদী ধর্মান্ধতায় আবদ্ধ করেছে লোকদেরকে। ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষ শতাব্দীর পর শতাব্দী গোলামী ও শোষণের শিকার হয়েছে বিদেশীদের হাতে।
ইউরোপ-আমেরিকা ইত্যাদি দেশ সমূহ যতদিন ধর্মান্ধতায় আবদ্ধ ছিল ততদিন তারা কোনো প্রগতি করতে পারেনি। তাদের ধর্মগুরু যাজকদের রোষানলে পড়ে জিওর্দানো ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০) এবং কোপার্নিকাশের (১৪৭৩-১৫৪৩) মতো বিশ্ব প্রসিদ্ধ মহান বিজ্ঞানীদেরকে অমানবিক নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকাকে খৃষ্টীয় ধর্মান্ধতা তথা ধার্মিক গোলামী হতে মুক্ত করার জন্য যাঁরা প্রাণপন সংঘর্ষ করে কাজ করেছেন তাঁদের অন্যতম হলেন মহান বৈজ্ঞানিক আইজাক নিউটন (১৬৪৩-১৭২৭), আইনস্টাইন এবং স্টিফেন হকিন্সের মতো বাঘা বাঘা আধুনিক বিজ্ঞানীগণ। তাঁদের অক্লান্ত শ্রম এবং গবেষণায় ইউরোপ-আমেরিকার দেশ সমূহ ধার্মিক গোলামী হতে বের হয়ে আজ বিশ্বে তাঁরা সবচেয়ে বেশী বিকশিত, সভ্য ও শক্তিশালী দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আর যারা ইউরোপ-আমেরিকা প্রভৃতি দেশকে কথায় কথায় নাস্তিক বলে কটাক্ষ করে, গালি দেয়, সে সকল ধর্মান্ধরাই আবার বর্তমানে নাস্তিকদের দেশে গিয়ে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ জীবনের আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছে।
ভারত-বাংলাদেশের মতো দেশ সমূহ যারা এখনও গভীর ধর্মান্ধতায় ডুবে রয়েছে, তারা রয়েছে ভীষণ অনুন্নত অবস্থায় ও অগ্রসরতার চরম শিখরে। দারিদ্রতার কষাঘাতে লোক পরস্পরের মধ্যে হানাহানি, লুটপাট, ধর্ষণের মতো ভয়ানক নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি করে মানবেতর জীবন-যাপন করছে ধর্মান্ধ দেশ সমূহে। ইহাই হল ধর্মান্ধতার পরিণতি। জনসংখ্যাধিক্যের ভারে অনাহারে, অর্ধাহারে ও অভাব-অনটনে লোক অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে অপুষ্টিতে সীমাহীন দুঃখ ভোগ করছে। পর্যাপ্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বাসস্থানের সুবিধা নাই। এ সমস্ত দুরবস্থা হতে উত্তরণের জন্য তাদের কাল্পনিক ঈশ্বর-আল্লাহকে কোনোরূপ সহযোগিতা করতে সেখানে দেখা যায়না। স্বার্থবাদী ধর্মগুরু পুরোহিত ও মোল্লারা লোকদেরকে ভ্রমিত করে রেখেছেন ঈশ্বর-আল্লাহর ভয় দেখিয়ে।
পৃথিবীর প্রথম বৈজ্ঞানিক তথাগত বুদ্ধের বাস্তব সম্মত শিক্ষা ও সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে আধুনিক যুগকে বিজ্ঞানের শিক্ষা প্রদানকারী মহান বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন এবং স্টিফেন হকিন্সের মতো মহান বৈজ্ঞানিকেরা পাশ্চাত্য জগতে এনে দিয়েছেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
0 Comments