Hot Posts

6/recent/ticker-posts

Ad Code

ফাল্গুণী পূর্ণিমা ও নরসিংহের পরিচয় ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু


 

নরের মধ্যে সিংহ বা নরসিংহ যে বলা হয়, সে নর সিংহ কে ছিলেন? এ নরসিংহের সাথে জড়িত রয়েছে মহান ফাল্গুণী পূর্ণিমার গৌরব গাথা।

ভগবান তথাগতের গৃহত্যাগের সাত বছর পর বুদ্ধরূপে প্রথম বাবের মতো তিনি যখন কপিলবাস্তুতে আগমণ করছিলেন তখন কপিলবাস্তবাসী শাক্যরা তাঁদের আরাধ্য রাজনন্দন বুদ্ধকে অভিনন্দিত ও স্বাগত জানাতে বিশাল জন সমাবেশে মিলিত হয়েছিল এবং তাঁদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছিল। সমগ্র কপিলবাস্তু নগরী ধ্বজা, ফুল ও আলোকরশ্মি দ্বারা সুসজ্জিত করা হয়েছিল। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে করজোড়ে তথাগত বুদ্ধের আগমণ প্রতীক্ষা করছিলেন। কলাকারেরা আনন্দিত হয়ে বাদ্য যন্ত্র সহকারে নৃত্য-গীত করে আনন্দোৎসবে পরিবেশকে মুখরিত করে তুলেছিলেন।
অপেক্ষমান প্রত্যেক ব্যক্তি কপিলবাস্তুর মহানায়ক ‘তথাগত বুদ্ধ’কে একটি বার দেখার জন্য ধৈর্যহারা হচ্ছিলেন। মহারাজা শুদ্ধোদনের রাজধানী কপিলবাস্তু নগরে বুদ্ধ আগমণকে স্বাক্ষী হয়ে থাকার জন্য সমাজের অনেক কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতি জগতের খ্যাতনামা লোকজন এসে ভীড় করেছিলেন। রাজ প্রাসাদে রাহল মাতা যশোধরা এবং বুদ্ধের বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমীর সাথে সাত বছরের শিশু রাজকুমার রাহুলও মহান ব্যক্তিত্ব বুদ্ধকে দেখার জন্য উৎসুক্য ছিলেন। রাহুল স্বীয় মাতার হাত ধরে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো স্বীয় মহান পিতাকে দেখতে অধীরভাবে অপেক্ষা করেছিলেন। হাজারো ভিক্ষু সঙ্ঘের সাথে রাজপথে ধীর ও শান্তভাবে অগ্রসরমান ছিলেন তথাগত বুদ্ধ। সড়কের উভয় দিক হতে অপেক্ষারত জনগণ তথাগত বুদ্ধকে বন্দনা ও শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করছিলেন। বাচ্চাগণ মাতা-পিতার স্কন্ধোপরি উঠে রয়েছে, যাতে তারা তথাগত বুদ্ধকে দর্শন করতে পারে। সেদিন ছিল মহান ফাল্গুণী পূর্ণিমার পূন্য লগ্ন।
গৃহ ত্যাগের সাত বছর পরে ফাল্গুণী পূর্ণিমা তিথিতে ভগবান বুদ্ধ পিতা-মাতা এবং জ্ঞাতী দর্শনে কপিলবাস্তুতে পদার্পণ করেছিলেন। রাজ প্রাসাদের বারান্দা হতে রাজকুমরার রাহুল ভিক্ষু সঙ্ঘের পুরোভাগে অগ্রসরমান দিব্য কান্তিময়, তেজস্বী এবং ওজস্বী শ্রমণ সম্পর্কে মায়ের কাছ হতে জানতে চেয়েছিলেন যে, এ দীর্ঘ সারির মধ্যে আমার যশস্বী পিতা কে? যিনি পুরোভাগে রয়েছেন, জোতির্ময় যাঁর কান্তি, তিনিই কি আমার সেই আরাধ্য পিতা? তখন মাতা যশোধরা রাহুলের জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে গিয়ে সাধারণভাবে পরিচিত করাননি। তিনি অসাধারণভাবে পুত্রকে পিতৃ পরিচয় করিয়েছিলেন। বুদ্ধগুণ সমূহ তথা শারীরিক সৌন্দর্যের অনন্য সাধারণ ব্যাখ্যা মূলক নয়টি গাথা দ্বারা তিনি বুদ্ধকে উপস্থাপন করেছিলেন। পালি সাহিত্যে সেগুলি ‘নরসিংহ গাথা’ নামে জানা যায়। গাথা সমূহ হল নিম্নরূপ-
১) ‘চক্ক বরঙ্কিত রত্ত-সুপাদো
লক্খণ মণ্ডিত আযত পণ্হি।
চামর ছত্ত বিভূসিত পাদো,
এস হি তুয্হ পিতা নরসিহো।’
অর্থাৎ যিনি রক্তবর্ণ চরণচক্র দ্বারা অলঙ্কৃত, যিনি দীর্ঘ মঙ্গল গোড়ালি লক্ষণ সম্পন্ন, যাঁর চরণে বিশিষ্ট চিহ্ন এবং ছত্র অঙ্কিত রয়েছে এবং যিনি নরের মধ্যে সিংহ, তিনিই তোমার পিতা।
২) ‘সক্য কুমার বরো সুখুমালো,
লক্খণ চিত্তিক পুণ্ণ সরীরো।
লোক হিতায গতো নরবীরো,
এস হি তুয্হ পিতা নরসীহো।’
অর্থাৎ যিনি হলেন শ্রেষ্ঠ শাক্য কুমার, যাঁর সম্পূর্ণ শরীর সুন্দর লক্ষণ সমূহ দ্বারা চিত্রিত, নরের মধ্যে যিনি বীর, যিনি লোক হিতে গৃহত্যাগ করেছেন, এবং যিনি নরের মধ্যে সিংহ, তিনিই তোমার পিতা।
৩) ‘পুণ্ণ সসঙ্ক নিভো মুখবণ্ণো,
দেবনরান পিযো নরনাগো।
মত্ত গজিন্দ বিলাসিত গামী,
এস হি তুয্হ পিতা নরসীহো।’
অর্থাৎ যাঁর মুখ পূর্ণ চন্দ্রের মতো প্রকাশিত, যিনি নরের মধ্যে হাতীর সমান, সকল দেব-নরের যিনি প্রিয়, যিনি গজেন্দ্রের মতো নির্ভিক গমণকারী এবং যিনি নরের মধ্যে সিংহ তিনিই তোমার পিতা।
৪) ‘খত্তিয সম্ভব অগ্গ কুলীনো,
দেব মনুস্স নমস্সিত পাদো।
সীল সমাধি পতিহিত চিত্তো,
এস হি তুয্হ পিতা নরসীহো।’
অর্থাৎ যিনি অগ্র ক্ষত্রিয় কুলোৎপন্ন, যাঁর চরণদ্বয়ে সকল দেব এবং মনুষ্য বন্দনা করে থাকেন, যাঁর চিত্ত শীল-সমাধিতে সুপ্রতিষ্ঠিত, যিনি নরের মধ্যে সিংহ, তিনিই তোমার পিতা।
৫) ‘আযত যুত্ত সুসণ্ঠিত নাসো,
গোপক্খমো অভিনীল সুনেত্তো।
ইন্দধনু অভিনীল ভমুকো,
এস হি তুয্হ পিতা নরসীহো।’
যাঁর নাসিকা চওড়া তথা সুডৌল, বাচুরের চোখের মতো যিনি উজ্জ্বল চক্ষু বিশিষ্ট, যাঁর নেত্রবর্ণ সুনীল, যাঁর ভ্রূ যুগল ইন্দ্রধনুর মতো এবং যিনি নরের মধ্যে সিংহ, তিনিই তোমার পিতা।
৬) ‘বট্ট সুমট্ট সুসণ্ঠিত গীবো,
সীহহনু মিগরাজ সরীরো।
কঞ্চন সুচ্ছবি উত্তম বণ্ণো,
এস হি তুয্হং পিতা নরসীহো’
যাঁর গ্রীবা হল গোলাকার, সুসণ্ঠিত, থুতনি সিংহরাজের মতো উত্তম এবং যাঁর শরীর মৃগরাজের মতো সুন্দর উজ্জ্বল, যাঁর দেহবর্ণ সুবর্ণের মতো কান্তিময়, যিনি নরের মধ্যে সিংহ তিনিই তোমার পিতা।
৭) সিনিদ্ধ সুগম্ভীর মঞ্জু সুঘোসো,
হিঙ্গুলবদ্ধ সুরত্ত সুজিব্হো,
বীসতি বীসতি সেত সুদন্তো,
এস হি তুয্হং পিতা নরসীহো।’
যাঁর বাণী হল স্নিগ্ধ, গম্ভীর, সুন্দর, যাঁর জিহ্বা সিন্দুরের মতো রক্তবর্ণ, যাঁর মুখে শ্বেত বর্ণের বিশটি বিশটি দন্ত রয়েছে, যিনি নরের মধ্যে সিংহ, তিনিই তোমার পিতা।
৮) ‘অঞ্জন বণ্ণ সুনীল সুকেসো,
কঞ্চন পট্ট বিসুদ্ধ নলাটো।
ওসধি পণ্ডর সুদ্ধ সুউণ্ণো,
এস হি তুয্হং পিতা নরসীহো।
যাঁর কেশ সুরমার মতো গভীর নীলবর্ণ, ললাট স্বর্ণের মতো বিশুদ্ধ, যাঁর ভ্রূ যুগলের মধ্যভাগের লোম ঔষধি তারার মতো হাল্কা হলুদ বর্ণের এবং যিনি নরের মধ্যে সিংহ, তিনিই তোমার পিতা।
৯) ‘গচ্ছতি নীলপথে বিয চন্দো,
তারাগণা পরিবেঠিত রূপো।
সাবক মজ্ঝগতো সমণিন্দো,
এস হি তুয্হ পিতা নরসীহো।’
যিনি আকাশের চাঁদের মতো অগ্রসরমান আছেন, যিনি শ্রমণদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শ্রমণেন্দ্র এবং যিনি শ্রমণ ভিক্ষুদের মধ্যে আকাশে তারা বেষ্টিত চন্দ্রের মতো থাকেন, নরের মধ্যে যিনি সিংহ, তিনিই তোমার পিতা।
মহাকারুণিক বুদ্ধের গৌরবশালী এবং গুণ প্রকাশক একশত নামের মধ্যে অন্যতম একটি নাম হল ‘নরসিংহ।’ বুদ্ধকে ‘সিংহ’ এবং বুদ্ধবাণী উচ্চারণের শব্দকে ‘সিংহনাদ’ বলা হয়েছে। সিংহ হল বনের রাজা এবং সিংহ নির্ভয়ে বনে বিচরণ করে থাকে। বুদ্ধকে শাক্য সিংহও বলা হয়। সিংহের এরূপ গৌরবশালী প্রতীককে যুক্ত করে সম্রাট অসোক সারনাথে সিংহ স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। স্তম্ভের শীর্ষদেশে চারিদিকে গর্জনরত চারি সিংহ মুখ বিশিষ্ট স্তম্ভ হল আজ ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীক। সম্রাট অসোক সিংহ চিহ্নিত আসনে বসে সম্রাজ্য পরিচালনা করেছেন বলে সে রাজাসনকে ‘সিংহাসন’ বলা হত। সিংহ হল শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। কালান্তরে বুদ্ধানুসারীগণ অনেকের নামের পদবীও ‘সিংহ’ ব্যবহার করেছে। সিংহ হতেই শ্রীলঙ্কার নাম ‘সিংহল’ হয়েছিল।
নরের মধ্যে এ শ্রেষ্ঠ নর বুদ্ধ ‘নরসিংহ’ শারীরিকরূপে একজন মনুষ্যের মতো ছিলেন, কিন্তু এ গৌরবশালী প্রতীককে পরে আত্মসাৎ করে এবং বিকৃত করে অর্ধেক মনুষ্য এবং অর্ধেক সিংহের রূপ দিয়ে ‘নৃসিংহ’ নামে অবতার বানিয়ে দিয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা।

Post a Comment

0 Comments

Ad Code

Responsive Advertisement