আজকাল অনেক লোকদেরকে অতিষ্ঠ হয়ে বলতে শুনেছি যে, ভিক্ষুদের কি কেবল চাঁদা সংগ্রহ এবং দান চাওয়াই কি একমাত্র কাজ? এগুলি ব্যতীত ভিক্ষুদের অন্য কোনো কাজ কি নাই? লোকেরা বিরক্ত হয়ে এগুলি যে কটাক্ষ করে বলছেন, সেগুলি একেবারে অমূলক বা অযৌক্তিকও নয়।
ভিক্ষুদের চাঁদা চেয়ে নেওয়া হল শতভাগ অন্যায়, অপরাধ এবং অধম্ম। তা বুদ্ধ শিক্ষার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচরণ এবং ভারতীয় শ্রামণ্য সন্ন্যাস পরম্পরার গর্হিত, দূষিত ও বিরোধী কর্ম।
চাঁদা চেয়ে নেওয়া ভিক্ষুদের মধ্যে কিছু রয়েছেন যাঁরা অনেকটা দাবী করে, জোর খাটিয়ে নিয়ে থাকেন। তাঁরা যাঁর কাছ হতে অর্থ চাঁদা বা বস্তু দান চাচ্ছেন, সে ব্যক্তির পরিবার-পরিস্থিতি ও মানসিক অবস্থার দিকে তাঁদের সামান্যতমও দৃষ্টি নাই। ভিখারীর মত পুণঃ পুণঃ গিয়ে বলে বলে বা অনেকটা জোর করে চাঁদা চেয়ে নেন। ঘরে ঘরে গিয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে অযাচিত ভাবে ডুকে সকলের কাছ হতে, দোকানে বা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে এমনকি বাজার বা মার্কেটে গিয়ে পর্যন্ত অর্থ চাঁদা নেওয়ার জন্য ধর্ণা দেওয়া ভিক্ষুদের পক্ষে কত যে বেমানান বা অশোভন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কোনো কোনো ভিক্ষুরা চাঁদা আদায়ে দাদাগিরি পর্যন্ত প্রদর্শন করে থাকেন।
অনেক লোক রয়েছেন, যাঁদের আর্থিক অবস্থা খুবই দুর্বল। তাঁরা অনেক সমস্যার মধ্যে দিনাতিপাত করে থাকেন। স্ত্রী-পুত্রের ভরণ-পোষণ করতে অথবা পরিবার পরিজনের নানা চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে অনেকে ধার-দেনা করে ডুবে রয়েছেন। একবেলা ভালমতে ভোজন করাও অনেকের কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। অসুস্থ হলে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করার জন্য অর্থও থাকেনা। এরকম লোকদের কাছ হতে স্বর্গ-ব্রহ্ম লোকের ও অপ্সরার প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ চাঁদা নিতে কোন্ মহাপুরুষ শিখিয়েছেন? বা কোন্ ধম্ম গ্রন্থে লিখা রয়েছে?
কিছু লোকের কাছে অর্থ থাকলেও তাঁদের দেওয়ার ইচ্ছা থাকেনা বা দেওয়ার মতো শ্রদ্ধা থাকেনা বা পূর্ব হতে অন্য কোনো স্থানে চাঁদা দিয়ে ফেলেছেন। এরকম লোকদের কাছে অযাচিতভাবে চাঁদা চাওয়ার জন্য যেতে কোন্ মহাপুরুষ বলেছেন বা কোন্ ধম্মগ্রন্থে লিখেছে?
তদুপরি চাঁদা সংগ্রহকারীগণের মধ্যে কতজন লোক শীলবান, সদাচারী, শ্রদ্ধাবান, ধম্মবান, প্রজ্ঞাবান, প্রামাণিক, সেবাভাবাপন্ন, সমাজসেবী, দেশপ্রেমী, বিনম্র রয়েছেন? তা কোটি টাকার প্রশ্ন। চাঁদা চাওয়া ভিক্ষুগণ বুদ্ধ ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রতি গম্ভীর অনুশীলন কতজনের রয়েছে? দেখানো যাবে?
চাঁদা চাওয়া ভিক্ষুগণ এবং লোকদের অনেকে হলেন দুঃশীল, দুরাচারী, মিথ্যাবাদী, মাদকাসক্ত, কামসেবী কিংবা ব্যভিচারী, হিংস্র এবং নানা অসামাজিক কাজকর্মে আসক্ত। তাঁদের উপরে একরূপ এবং বাহিরে অন্য রূপ অথবা ভিতর-বাহির সর্বত্রই ভ্রষ্টাচারে পরিপূর্ণ।
যে কোনো ধম্মীয় অনুষ্ঠান করতে দান স্বরূপ যা পাওয়া যায়, তদনুসারে সম্পন্ন করা উচিত এবং না চেয়ে যতটুকু পাওয়া যায় বা যা স্বেচ্ছায় দিয়ে থাকেন, তাকেই বলা হয় দান।
চেয়ে নিয়ে যা জমা করা হয়, তা কোনো ভাবেই দান হতে পারেনা। কারো কাছ হতে জোর-জবরদস্তি করে চাঁদা আদায় করা হল অসভ্য, অন্যায়, অনুচিত এবং নিন্দনীয় কর্ম। এগুলি হল ঘৃণাষ্পদ কর্ম, অযোগ্য-অশোভন কর্ম এবং অনার্য কর্ম। সেভাবে দান নেওয়ার প্রথা আর্য বিনয়ে সম্মতি দেয়না।
কারো কাছ হতে দাদাদিরির দ্বারা জোরজবরদস্তি করে চাঁদা আদায় করা হল আইনগতভাবেও অপরাধ। দাদাগিরি দ্বারা কারো কাছ হতে জবরদস্তি চাঁদা নেওয়া হল বুদ্ধ শিক্ষার পরিপন্থী, ভারতীয় শ্রমণ সংস্কৃতি বা পরম্পরার বিপরীত।
কার্যক্রমের আয়োজকগণ কেবল এতটুকু ঘোষণা করতে পারেন যে অমুক তারিখ, অমুক সময়ে আমাদের এরূপ অনুষ্ঠান করা হবে এবং কর্মসূচীর পরিকল্পনা প্রচার করতে পারেন। কত পরিমাণ অর্থ লাগতে পারে তারও একটা আনুমানিক ধারণা দিতে পারেন। তা দেখে যাঁরা সম্পূর্ণ বা আংশিক পৃষ্টপোষক করার জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে দিয়ে যাবেন বা পাঠিয়ে দেন, সেগুলিই হল প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদত্ত দান। দাবী করে চেয়ে নেওয়ার প্রকৃত শ্রদ্ধাদান হতে পারেনা।
উদ্যোক্তাগণ মধ্যে মধ্যে কয়েকবার প্রচার প্রচারণা করতে পারেন। নিজেদের মধ্য থেকে যথাসাধ্য পৃষ্টপোষক করতে পারেন।
নিয়ম অনুসারে কেবল এবং কেবল সজ্জন, শ্রদ্ধাবান, সদাচারী লোকদের দানই অধিকতর নেওয়া উচিত। তাও কেবল স্বেচ্ছায় দান করলে। দুর্জন-দুরাচারী লোকেরা দান দিলে সে দানের আশানুরূপ ফল হয়না।
পরিস্কার বক্তব্য হল স্বেচ্ছায় দেওয়াই ধম্ম এবং চেয়ে নেওয়া হল অধম্ম।
আমাদের এরকম সংস্কৃতি চালু করা উচিত যে, বিনা চাঁদায় নিজেদের সামর্থ্য অনুসারে সামাজিক বা ধাম্মিক কার্য সমূহ সম্পাদন করা। নিজের কাছে যতটুকু সামর্থ্য রয়েছে সে সাধ্যের মধ্যে কর্তব্য সম্পাদন করা উচিত। ছোট অনুষ্ঠান করুন, কিন্তু অন্যের কাছ হতে কিছু চেয়ে নিয়ে নয়।
লোকদেরকে দান দেওয়ার জন্য প্রেরণা অবশ্যই করতে হবে। যাতে তাঁরা পুণ্যার্জন করতে পারেন। কিন্তু তা যেন নিজের লাভের জন্য না হয় এবং জোর জবরদস্তির না হয়। স্বেচ্ছায় দিলে নিজেরও মঙ্গল হয় এবং অন্যেরও কল্যাণ হয়। পবিত্র চেতনায়, নিষ্পাপ চেতনায় ও উদ্দেশ্যে দিতেও হবে এবং সেরকম চেতনায় নিতেও হবে। কার্যক্রমের জন্য চেয়ে নেওয়া, চেয়ে খাওয়া হল সর্বতোভাবে অশোভন। এগুলি বুদ্ধ শিক্ষায় অনুমোদন নাই।
সত্যিকারভাবে যাঁরা দান দেবেন, তাঁরা স্বয়ংই আপনার কাছে এসে দান দিয়ে যাবেন। আপনাকে দরজায় দরজায় গিয়ে ধর্ণা দিয়ে নিতে হবেনা। এগুলি হল ইতরামি। আপনি বুদ্ধ শিষ্য। কেনো আপনি দরজায় গিয়ে অর্থ চেয়ে নিবেন?
0 Comments