********************”"""

আধুনিক মানব সভ্যতার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে সবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তথাগত বুদ্ধের অমৃতময় দিব্য প্রেমমূর্তি। তাঁর বদন মণ্ডলের স্বর্গীয় আভা। বিশ্বপ্রেম শান্তির বাণী অন্তরে তাহার, সমস্ত জীবনের প্রতি অনুপম দয়া, মৈত্রী, মুদিতা, উপেক্ষা ইতিহাসের অগণিত নর-নারীর মধ্যে এই মানবীয় মানুষকে অনায়াসে চেনা যায়। তিনি সমস্ত জীবন ধরেই প্রচার করে বেরিয়েছেন মানবের মুক্তি ও নির্বাণের অমোঘ বাণী। তথাগত বুদ্ধ মানব ইতিহাসে এক অতুলনীয় দান। তিনি ছিলেন শান্তি প্রীতি ও আনন্দের অফরঃ প্রদ্রবণ। এই অনন্ত শান্তি উৎস থেকে মানবকল্যাণের পীযষ ধারা দিগিদিদিকে প্রভাবিত হচ্ছে। তথাগত বৃদ্ধ কোনো দেশ বা কোনো জাতির গণ্ডিতে আবদ্ধ হন নাই। তিনি সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের আধার। সূর্য যেমন ধনী-গরীব লম্বা বেটে, স্কুল বৃহৎ কোনোরূপ চিন্তা না করে আলো দিয়ে যায়, ঠিক তেমনি ভাবে তথাগত বুদ্ধ সমগ্র মানবের কল্যাণে তার লব্ধ বুদ্ধজ্ঞান মানবকল্যাণে প্রচার করেছেন সার্বজনীনভাবে।
পৃথিবীর ইতিহাসে বহু মানবের অমর অবদানের কথা লেখা আছে কিন্ন তথাগত বুদ্ধের মহানুভবতা, প্রজ্ঞতা সর্বদিক দিয়ে তাদের সকলের থেকে শ্রেষ্ঠ, বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন। মহামানবের শৈশব কেটেছে কঠোর দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করে নয়, বুদ্ধ ছিলেন রাজার নন্দন। রাজ্যের ভাবি উত্তরাধিকারী বলেই তিনি পরম যত্নে আদরে প্রতিপালিত হয়েছে, কিন্তু তিনি দুহাতে সব রাজভোগ পরিত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লেন রাজপ্রাসাদ থেকে। নিজের মুক্তির জন্য শুধু নয় সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য। অপরাপর মানবগণ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন অদৃশ্যমান শক্তি বা ঈশ্বরের রাজত্ব।
অনেকে চেষ্টা করেছেন অদৃশ্য ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক স্থাপন করতে। কিন্তু বুদ্ধ এতোই সত্য অনুসন্ধান করেছেন যে মানুষ নিজেই যেন নিজের মুক্তি অর্জন করতে পারেন। তথাগত বুদ্ধ এসেছিলেন সকল জীবের মঙ্গলের জন্য ঈশ্বরের বাণী মানুষের মধ্যে প্রচার করার জন্য নয়। মানুষের মধ্যে মানবধর্ম প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এই মহা পৃথিবীতে তাঁর শুভ আগমন হয়েছিল, আমি ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষ এ দাবি তিনি করেননি, তিনি চেয়েছিলেন মানবসমাজকে সর্ববিধ দুঃখের হাত থেকে মুক্ত করতে, পাপময় জীবন থেকে উদ্ধার করতে, তিনি সত্যিকারের মানব ধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁর মতো মানব দরদি জগতে জন্মগ্রহণ করেননি, মানব মঙ্গল সাধনই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান ব্রত, তাঁর ধর্ম সত্যিকারের মানবধর্ম, তাই তাঁর ধর্ম দর্শন এর একটি মূলমন্ত্র 'জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
ধর্ম প্রচার করার জন্য কোনদিন তাকে তরবারি ধারণ করতে হয় নাই, তাঁর বাণী অহিংসা পরম ধর্ম জীব, হত্যা মহাপাপ, সর্ব দুঃখের মুক্তি সাধন, এই মহাবাণী তাঁর জীবনদর্শনের শিক্ষা, তাঁর নিকট তরবারি শক্তি অকিঞ্চিৎকর। তাই তিনি কোনো প্রকার অসি প্রয়োগ করার বোধ করেন নি, ত্যাগময় মৈত্রী আদর্শ দিয়ে সকলকে জয় করেছেন, তাঁর অবলম্বিত পন্থায় যে বিশ্ব শান্তির পক্ষে উৎকৃষ্ট পন্থা তা জগত মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে। যিশুখ্রিস্টের কয়েক শত বছর পূর্বে ৬২৩ বছর পূর্বে তথাগত বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং মানবজীবনে অহিংসা ও প্রেমের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর ভক্ত অনুরক্তগণ দিকে দিকে ভার এই মহান বাণী প্রচার করে জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি সহজ ও স্বচ্ছন্দ করে তোলেন। যীশুখ্রিস্ট যখন প্রেমের বাণী প্রচার করেন তখন প্যালেষ্টাইনে বুদ্ধের আদর্শের প্রভাব অপরিসীম। সূতরাং (Sermon on the Mount) এ বুদ্ধের প্রভাব আছে এ কথা অস্বীকার করা যায় না। পরবর্তী যুগে শ্রীচৈতন্য ও গান্ধীজী অহিংসা ও প্রেমের বাণী প্রচার করেছেন তার উৎস হচ্ছে তথাগত বুদ্ধের বাণী। ইসলামের সুফিগণ যে বহুলাংশে তথাগত বুদ্ধের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল তার প্রমাণ আছে। বর্তমান যুগে প্রচলিত বহু ধর্মের ওপর বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব আছে। আজ জগতে যে বিশ্বশান্তির কথা উঠে, তার মূলেই আছে বুদ্ধের আদর্শের প্রভাব। হত্যা করে নয়, ধ্বংসের করে নয়, পেশি শক্তি দিয়ে নয় প্রেম, প্রীতি ও অহিংসার পথে মানুষের মুক্তি, নির্বাণ এই মহান শিক্ষা তথাগত বুদ্ধের নিকট বিশ্বমানবকে আবার নতুন করে শিখতে হবে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ধর্মপদে বলেছেন-
নহি বেরেন বেরানি সম্মন্তীধ কুদাচনং
অবেরেন চ সম্মন্তি এসে ধম্মো সনন্তনো।
অর্থাৎ- জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনও শত্রুতার উপশম হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়। ইহাই সনাতন ধর্ম। তথাগত বুদ্ধের দূরদৃষ্টি অতুলনীয়। আড়াই হাজার বছর আগে তিনি বিশ্বমানবের তথা সমগ্র জীবের কথা গভীরভাবে চিন্তা করেছিলেন। পৃথিবীতে বোধহয় তিনি প্রথম আন্তর্জাতিক মানুষ, যিনি দেশ ও জাতির গণ্ডি অতিক্রম করে সারা জগতের কথা ভেবেছিলেন। ভারতের সঙ্গে নিখিল বিশ্বে সংযোগ স্থাপনের কথা তিনি প্রথম ভেবেছিলেন। ভারতের রূপমণ্ডুকতা ভেঙে দিয়েছিলেন এবং ভারতকে বিশ্বের সম্মুখে উপস্থাপন করেছিলেন। তাই কবি বলেছেন 'সন্তান যার তিব্বত, চীন, জাপানে গড়িল উপনিবেশ' শুধু তিব্বত চীন জাপান নয় মিশর, রোম, পারস্য, রাশিয়া সহ তৎকালজাত সমগ্র বিশ্বেই তথাগত বুদ্ধের শিক্ষা প্রবর্তিত হয়েছিল। তাঁর শিক্ষা সহজেই মানুষকে আকর্ষণ করেছিল তাঁর শিক্ষার মূলনীতি ছিল উদারতা, চির দুঃখ হতে মুক্ত হাওয়া। প্রথম জীবনে তিনি নানান পথে সাধনা করেছিলেন কিন্তু নিজের
অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলেন বাহ্যিক ক্রিয়াকাণ্ড, আচার বিচারের মাত্রাধিক সমস্ত পথকে পল্লিল করে তুলেছে, কেবল বাদানুবাদ, তর্ক অব গণ্ডগোলই সার হয়েছে। একদল লোক অ্যাবস্ট্রাক্ট চিন্তাতেই সমস্ত শক্তি নিযুক্ত যুক্ত করেছে, বাস্তবতার দিকে কোথায়ও
সম্মুখে গণ মানর পড়ে আছে, তারাই তো জাগ্রত ভগবান, তাদেরকেই তো সৎ শিক্ষার মাধ্যমে ভগবান করা যায়, কিন্তু সেদিকে লক্ষ কারো দৃষ্টি নাই। নাই- লক্ষ আছে কোন এক অচিন্তনীয় অদৃশ্য শক্তির ওপর। এতে বিশ্বের কল্যাণ নেই।
তথ্যগত বুদ্ধ দেখলেন যে প্রচলিত পন্থায় এদের জন্য কিছু করা যাবে না। বহু চিন্তা ও ধ্যানের পর তিনি আবিষ্কার করলেন যে, সম্মা বিশ্ব একটি সুনির্দিষ্ট আইন বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নানা পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্বচক্র অহরহ ঘুরে বেড়াচ্ছে। দীরে দীরে তাঁর মনের বাঁধা কেটে গেল, অন্ধকার অপসারিত হল, তিনি গয়ার বোধিমূলে বুদ্ধত্ব লাভ করলেন। কপিলাবস্তুর সিদ্ধার্থ বুদ্ধ বা আলোকিত মহামানব রূপে আত্মপ্রকাশ করলেন। তারপর তিনি প্রচার করতে লাগলেন সমস্ত প্রকার দ্বন্দ্ব, দ্বেষ, কলুষ কালিমা দূর করে জীবনকে পবিত্র, মহান, সুন্দর করে তুলতে হবে এটাই হলো তার প্রধান কথা।
তিনি শিষ্যদের উপদেশ দিলেন নিজের মুক্তির কথা চিন্তা করার সাথে সাথে সর্ব মানুষের কল্যাণের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হবে। তিনি মানুষকে কোনো হিংসা প্রতিহিংসার শিক্ষা দেননি। তিনি সব সময় মুক্তির আশ্রয় নিতেই উপদেশ দিতেন। তাঁর সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যুক্তিপূর্ণ। আর এই যুক্তির বলেই তিনি মানুষকে আকৃষ্ট করেছেন। তিনি বলতেন ভক্তির ভক্ত হওয়া চাই সত্য তবে যক্তি ব্যতীত সত্যের প্রতিষ্ঠা নাই, তাঁর মতে ব্রহ্মবিহার এর অর্থ এই নয় যে, সাধককে মানব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে বরং ব্রহ্মবিভার এর অর্থ এই যে, এমন একটি মহৎ চিন্তার মাধ্যমে নিমজ্জিত থাকতে হবে। যার ফলে সমগ্র হৃদয় থেকে হিংসা দূর হয়ে যায় এবং প্রেম দ্বারা পূর্ণ হয়ে সকলের সাথে মিলে মিশে মানব কল্যাণ কাজ করতে। তিনি তাঁর শিষ্যদের বলতেন বিনা প্রমাণে কিছুই বিশ্বাস করো না. শাস্ত্রীয় পুস্তক নয় বা ঐতিহ্যও নয়, এমন কি তাঁর নিজের নামের দোহাই দিয়ে ও তারা পরিচালিত হবে না। গোপন সত্য বলেই কোনো জিনিসের অস্তিত্ব তিনি স্বীকার করেন নি।
তিনি বলতেন যে আমাদের মনের মধ্যে যে ভালো চিন্তা বা বিবেক আছে, সেটি হচ্ছে চরম অথরিটি। তিনি ধর্ম ব্যাপারেও স্বাধীন চিন্তাকে সমর্থন করতেন। এই বিষয়ে তথাগত বুদ্ধ আধুনিক যুগের পূর্বগামী। ধর্মের ব্যাপারে ব্যক্তিগত মতের স্বাধীনতা পশ্চাত্য জগত বহুদিন স্বীকার করেনি। ধর্মের নামে সেখানেই কত উৎপীড়ন সংঘাত হয়েছে।
আর তথাগত বুদ্ধ আড়াই হাজার বছর আগে ধর্মের ব্যাপারে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার অধিকার ঘোষণা করে গিয়েছেন। তাই বলা যেতে পারে আড়াই হাজার বছর আগে এই ধর্ম আবিষ্কৃত হলেও তিনি মনেপ্রাণে ছিলেন একেবারে আধুনিক। তিনি সমস্ত মতবাদকে ধৈর্যের সঙ্গে বিবেচনা করতে উপদেশ দিয়েছেন, তাঁর সামনেই কেউ যদি আপর ধর্মের নিন্দা অথবা অযৌক্তিক সমালোচনা করতেন, তবে তিনি তাদের থামিয়ে দিতেন। পরম উদারতার সাথেই তিনি সকল মতবাদ এর প্রতি সদয় ব্যবহার করতেন, বিরুদ্ধ মতবাদকে শান্ত সং ব্যবহারের ধারা খণ্ডন করেছেন। কখনো ক্রোধ বা নিন্দার দ্বারা বিরোধীকে আক্রমণ করেননি।
তথাগত বুদ্ধ এমন একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন যে তাঁর বিরুদ্ধবাদিগণ ভক্তিভরে তাঁর নিকট নতশিরে বন্দনা করে নির্বাণ আদর্শ বরণ করেছিল। সুদীর্ঘ বছর ধরে তথাগত বুদ্ধের ধর্ম দর্শন বিশ্বময় ব্যপ্ত হয়েছিল। পৃথিবী কত পরিবর্তন ও বিবর্তন হয়ে গেল কিন্তু তবুও বুদ্ধের আদর্শ শিক্ষা আজও অচল হয়নি। বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা আসলেই বুদ্ধের শিক্ষার কথা চলে আসে, মানবতার কথা আসলেই বুদ্ধের শিক্ষার কথ্য চলে আসে, ঐক্যের কথা আসলেই বুদ্ধের শিক্ষার কথা চলে আসে, পৃথিবীর আবালবৃদ্ধবনিতা সর্বজনীনভাবে সকলের কাছে বুদ্ধের শিক্ষা এখনো দীপ্তমান সূর্যের মতো।
বুদ্ধের এই শিক্ষা যেমন নিজেকে সমৃদ্ধ করে তেমনিভাবে অপরকেও মহিমান্বিত করে তাই যুগে যুগে কালে কালে মহাজ্ঞানীগণ বুদ্ধের আদর্শকে বরণ করে নিয়েছে তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে। সেই পথের তেমনি একজন মানুষ ড. এফ দীপংকর মহাথের।
১৯৭২ সালের ২০ মার্চ ফটিকছড়ি উপজেলার ফরাঙ্গীরখীল গ্রামের পিতা নান্টু বড়ুয়ার ঔরসে মাতা পুটি রানী বড়ুয়া র গর্ভে হতে ভূমিষ্ঠ হন এক পুত্র সন্তান। তার নাম রাখা হয় দীপংকর বড়ুয়া টিম্পু। ছয় ভাই এক বোনের মাঝে তিনি তৃতীয়।
যথাসময়ে তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ১৯৯১ সালের ১৭ জুন প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন, তাঁর নাম রাখা হয় দীপংকর শ্রামণ। শ্রামণ্য দীক্ষাগুরু কর্মবীর পূর্ণজ্যোতি মহাথের। ভারত বাংলা উপমহাদেশের মহাপণ্ডিত বাংলায় থেরবাদ প্রতিষ্ঠার সূতিকাগার মহামুনি মহানন্দ সংঘরাজ বিহারের অন্যতম রূপকার মহাধ্যক্ষ, থেরবাদ আদর্শের শাসনস্তম্ভ, বিচিত্র ধর্মকথিক, মহামান্য উপসংঘরাজ পরম শ্রদ্ধেয় ভদন্ত ধর্মপ্রিয় মহাথের মহোদয়কে আচার্য ও উপাধ্যায়ত্বে বহু গুণী পণ্ডিত ভিক্ষু সংঘের উপস্থিতিতে ২০ অক্টোবর ১৯৯৪ সালে উপসম্পদা গ্রহণ করেন। নাম রাখা হয় দীপংকর ভিক্ষু।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনে তিনি এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত কলেজে হতে বিএ অনার্স এবং এমএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করে স্বর্ণপদক এ ভূষিত হন। ভারত সরকারের আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় প্রক্রিয়া মেনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
২০১১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৯১২ সালের শেষের দিকে সাধনাময় জীবনযাপনের নিমিত্তে রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলা কাপ্তাই থেকে ৫ থেকে ৬ ঘন্টা নৌপথে গিয়ে গভীর জঙ্গলে সাধনাময় জীবনে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন সম্পূর্ণ একাকীভাবে। বন থেকে বনান্তরে সাধনাময় জীবনযাপনের এক পর্যায়ে ১৯১৬ সালে বান্দরবান পার্বত্য চট্টগ্রামের সদরের কাছে গভীর জঙ্গলে একটি গুহায় অবস্থান করেন। পরবর্তীতে যার নাম হয় আর্যগুহা ধুতাঙ্গ বিহার। এখানে অবস্থান করে তিনি বর্তমানে আত্ম সাধনায় নিমগ্ন আছেন সাথে নির্বাণ প্রত্যাশী সকল মানুষকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের কল্যাণে তিনি বুদ্ধের অমৃতময় শিক্ষা প্রচার প্রসার করে যাচ্ছেন।
পরম শ্রদ্ধেয় ডক্টর দীপংকর মহাথেরো একজন উচ্চশিক্ষিত বৌদ্ধ সাংঘিক বাক্তিত্ব, সম্ভবত ২০০৪/৫ সালে আমি যখন কলকাতা গমন করি আমার পরমজ্ঞাতি সাতকানিয়া লোহাগাড়ার জন্মজাত পুণ্যপুরুষ ভারতীয় সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার দ্বিতীয় সংঘরাজ প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথের মহোদয়ের সাধনপীঠ পঠারিরোড এর বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রে পরম শ্রদ্ধেয় ডক্টর দীপংকর মহোদয়ের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। তার প্রতি আমার দৃষ্টিবদ্ধ হলো এই জন্য যে তিনি সেই সময় পাত্র (ছেবাইক) দিয়ে পিও গ্রহণ করছেন। দেখে আমি অত্যন্ত বিমুগ্ধ হলাম। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বৌদ্ধভিক্ষুদের মাঝে পাত্র মধ্যে আহার গ্রহণ করাটা এত বেশি সহজ নয়। কারণ সেটা বহন করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর। তিনি সেই কষ্ট সহ্য করে বিনয়ের প্রতি বুদ্ধের শিক্ষার গৌরব করে পাত্রপিণ্ডক জীবন অতিবাহিত করছেন। তখনি তিনি আমার হৃদয় জয় করলেন। একজন বিনয়ী ভিক্ষু হিসেবে আমার উপলব্ধি হলো। সেই থেকে আজ অবধি আমি তাঁর প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল।
বিভিন্ন সময় কথোপকথনে তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করে পণ্ডিত বলে সম্বোধন করেন। অথচ আমি মনে করি তিনিই পণ্ডিত। সৌভাগ্যক্রমে আমার সাথে তার সম্পর্ক আরও গভীর হয়, পরবর্তীতে প্রায় সময়ই কলকাতা গেলে তাঁর সাথে আমার দেখা হতো, কথা হতো, কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় কারণে-অকারণে একসাথে ঘুরে বেড়িয়েছি।
বিশেষ করে পটারিরোড বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রে এক দিন কথোপকথনের সময় তিনি
আমাকে বললেন লোকজিৎ 'এখন তো আমার উচ্চশিক্ষা শেষ 'চিন্তা করছি আমি কি করব, এই দেশে থাকবো, নাকি বিদেশে গিয়ে কোনো বিহার করবো, নাকি বাংলাদেশে যাবো।' আমি বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বললাম দেশে গেলে ভালো হবে আপনার মতো গুণীভিক্ষুর প্রয়োজন।
২০১১ সালে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একসাথে যাওয়া আসার সৌভাগ্য হয়। তিনি অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, ধর্মের প্রতি গৌরবশীল একজন সাংঘিক ব্যক্তিত্ব, বিশেষ করে বিহার পরিচালনা কমিটির কারনে অকারণে ভিক্ষুদের ওপর খবরদারি করা তিনি মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। যার কারণে তিনি একদিন সিদ্ধান্তের কথা জানালেন লোকজিৎ আমি যদি বিশ্ববিদ্যালয় পাঠদানের সুযোগ পাই তাহলে সেখানে থেকে শাসন সদ্ধর্মের কিছু কাজ করার চেষ্টা করবো। নয়তো আমি একাকী বনচারী হয়ে যাব। ঠিকই তিনি একসময় বনচারী হয়ে গেলেন। একজন উচ্চশিক্ষিত নাম যশ খ্যাতি প্রতিপত্তি সম্পন্ন ভিক্ষু আরও অতি সাধারণ জীবনযাপনের জন্য ধুতাঙ্গব্রত গ্রহণ করে বন থেকে বনান্তরে দুর্গম থেকে দুর্গম পথে বিমুক্তির পথ গ্রহণ করে উৎকৃষ্ট ত্যাগময় জীবনাচারণ করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। একজন উচ্চশিক্ষিত সুসদ্ধর্মদেশক, লেখক, খ্যাতিমান ভিক্ষু হয়েও তিনি যে বনচারী তা তো সকলকে ভাবিয়ে তুলে। এই ত্যাগ কিন্তু এতো সহজ নয়। তাই তো তিনি সকলের কাছে মহীয়ান। ভগবান তথাগত বুদ্ধের শিক্ষায় দুই পথের কথা আছে একটি হচ্ছে
গ্রন্থধূর আরেকটি হচ্ছে বিদর্শনধূর। তবে তথাগত বুদ্ধ বিদর্শনধূরকে বেশি প্রশংসা করেছেন। পরম শ্রদ্ধেয় ডক্টর এফ, দীপংকর মহাথের পবিত্র উপসম্পদা গ্রহণের পর তিনি প্রথমে গ্রন্থধুরের সাধনায় ত্রিপিটক শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন এবং সর্বোচ্চ একাডেমিক সার্টিফিকেট অর্জন করেছেন। বুদ্ধের মূল শিক্ষা বিমুক্তি লাভ তথা সমগ্র দুঃখ হতে চির মুক্তির জন্য নির্বাণ সাক্ষাত করার জন্য ধুতাঙ্গব্রত গ্রহণ করে বনচারী হলেন। তা বুদ্ধের শিক্ষার প্রতিফলন। তাই বলি বুদ্ধের শিক্ষা পথে পরম শ্রদ্ধেয় ডক্টর এফ দীপংকর মহাথের।
তাঁর ৫০তম শুভ জন্মবার্ষিকী উদযাপন সত্যিই আজকের সময়ে প্রাসঙ্গিক। কারণ
তরুণ প্রজন্মকে সদ্ধর্ম শিক্ষায় আলোকিত করতে হলে আলোকিত জ্ঞানী মানুষের জীবনকথাগুলো উপস্থাপনা করা একান্ত দায়িত্ব এবং কর্তব্য। তাই আমাদের প্রয়োজনে শ্রদ্ধেয় ডক্টর দীপংকর মহাথেরোর জন্মদিন উদযাপনের মাধ্যমে তাঁর জীবনগাথা তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া সময়ের দাবি। যতটুকু শুনেছি তিনি এই জন্মবার্ষিকী উদযাপনে অনেকটা অনীহা প্রকাশ করেছেন। তথাপি তাঁর ভক্ত মণ্ডল শুভানুধ্যায়ীগণ উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যথার্থ করেছেন। কারণ আগামী প্রজন্মকে গুণীদের জীবনকথা অন্তর প্রবেশ করাতে না পারলে আমাদের শাসন সদ্ধর্ম রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই এই সুন্দর আয়োজন সাধুবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানের সফলতা কামনা করছি এবং পরম শ্রদ্ধেয় আমার পরম কল্যাণমিত্র ডক্টর এফ, দীপংকর মহাঘেরর নীরোগ দীর্ঘ জীবন কামনায় বিনম্র শ্রদ্ধা ও পুণ্যদান করছি।
জয়তু দীপংকর মহাথেরো
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
0 Comments