নারী দিবসে একদিন নারীদের প্রতি যে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা হয়, তাতে নারীদের যথার্থ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন হয়না। নারীদের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা দান করতে হলে তাঁদেরকে বোজা মনে না করে সম্পদরূপে গড়ে তুলতে হবে। নিজের বোন, কন্যাদেরকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে হবে। তাঁদেরকে উপযুক্ত বিদ্যার্জন করাতে হবে এবং আর্থিক ও সামাজিকভাবে স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। তাঁদেরকে অধীনস্থ করে রাখলে, অশিক্ষিত করে রাখলে তাতে কোনোদিন নারী কল্যাণ সম্ভব নয়। সমাজের অর্ধেক জনসংখ্যা হল নারী। এ অর্ধেক জনসংখ্যাকে অশিক্ষিত ও অধীন রেখে কখনও সমাজের প্রগতি হতে পারেনা। সমাজে এখনও নারী নির্ভয়ে একাকী চলাফেরা করতে পারেননা, নারী ধর্ষিতা হন, পুরুষদের দ্বারা নারী লাঞ্ছিত হন। তাহলে কিভাবে আমরা নারীকে সম্মান করছি বা মর্যাদা প্রদান করছি। নারীরা ঘরের কিংবা বাহিরে কোথাও নিরাপদ নন।
ভারতবর্ষে নারীদের অনেক দুর্দশা আমরা অতীত হতে দেখে ও শুনে আসছি। ভারতের ব্রাহ্মণ্য ধর্ম শিখিয়েছে নারীকে জীবন্ত আগুনে জ্বালানো, নারী নরকের দরজা, নারী অপবিত্রা, নারী দুঃচরিত্রা, নারীকে পশুর মতো পিটানো ইত্যাদি। অর্থাৎ যত রকমের কু-ধারণা সবই নারীর প্রতি আরোপ করেছে একমাত্র ধর্ম সমূহ। এখনও অনেকে আছেন যারা কন্যা ভ্রণকে হত্যা করে, কন্যা সন্তানকে বোজা মনে করে, কন্যা সন্তানকে লেখা-পড়া না শিখিয়ে অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে দিয়ে সারাজীবন দুঃখের কারাগারে নিক্ষেপ করে দেয়। নারীর গায়ে হাত তোলে, নির্যাতন করে, যৌতুকের জন্য হত্যা করে, দাসী বা চাকরের মতো ব্যবহার করে ইত্যাদি আরও কতভাবে যে নির্যাতন করে তার ইয়ত্তা নাই।
অথচ নারীকে আবার দেবী বানিয়ে পূজাও করে থাকে আমাদের ভারতবর্ষে। সেজন্য ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী শিক্ষিকা ও বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাত্রী সাবিত্রী বাই ফুলে (১৮৩১-১৮৯৭) লিখেছেন-
‘নারীদেরকে দেবী মান্য করার প্রয়োজন যেমন নাই, তেমনি পূজা করারও দরকার নাই। নারীদেরকে সম্মান এবং সমানাধিকার দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাই রয়েছে।’
নারী শিক্ষার আলোদানকারী সাবিত্রী বাই ফুলের উপরি উক্ত কথন সে সময়ের সামাজিক ব্যবস্থার উপর ছিল কঠোর প্রহার। তৎকালীন সময়ে নারীদেরকে দেবীরূপে তো প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু শিক্ষা, অর্থ, সম্পত্তি, ধর্ম এবং সামাজিক মর্যাদা প্রভৃতির অধিকার হতে তাঁদেরকে বঞ্চিতই রাখা হয়েছিল। সাবিত্রী বাই ফুলে পরিস্কার বলেছেন যে, নারীদেরকে সত্যিকার শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন নিহিত রয়েছে, তাঁদেরকে সমস্ত প্রকার নাগরিক অধিকার প্রদানের মাধ্যমে।
ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত যখন নারীদেরকে শিক্ষা, স্বাধীনতা প্রভৃতি ছিল স্বপ্নের মতো, সে সময় সাবিত্রীবাই ফুলে এ সমস্ত সাহসীকতাপূর্ণ বক্তব্য লেখনীর মাধ্যমে এবং কর্মের মাধ্যমে প্রকাশ করে সমাজে জাগরণ এনে দিয়েছিলেন। তিনি নারীদেরকে কেবল পূজার বস্তু নয়, বরং সমাজে সমানাধিকার প্রদান করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
বঙ্গে নারী শিক্ষা জাগরণের পথিকৃত ছিলেন বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২)। তিনি অনেক সংগ্রাম করে সামাজিক ও ধর্মীয় বেড়াজাল ভঙ্গ করে লেখাপড়া করেছেন এবং নারীদের জন্য বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনা করেছিলেন। তাঁর জীবনের অনেক সংঘর্ষপূর্ণ তিক্ত অভিজ্ঞতা তিনি লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। পুরুষেরা এবং প্রচলিত ধর্ম সমূহ কত ভয়ঙ্কর ক্রুর ও নারী বিদ্বেষী তা দেখাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন যে-
‘যখনই কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করেছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তার মস্তক চূর্ণ হয়েছে। আমরা প্রথমত, যা মানি না, তা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়ে শিরোধার্য করেছি। আমাদের অন্ধকারে রাখার জন্য পুরুষরা ওই ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করেছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলো পুরুষ রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।’
তাই তিনি নারীদেরকে পুরুষের শৃঙ্খল ছিন্ন করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন-‘ভগিনীরা! চুল রগড়াইয়া জাগে উঠুন, অগ্রসর হউন! মাথা ঠুকে বল মা! আমরা পশু নই; বল ভগিনী! আমরা আসবাব নই; বল কন্যে আমরা জড়োয়া অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্ধুকে আবদ্ধ থাকার বস্তু নই; সবাই সমস্বরে বল আমরা মানুষ।’
নারী মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য অতীতে অনেক নারীর অসামান্য আত্মত্যাগ থাকলেও এখনও সকল নারীরা তাঁদের মর্যাদা ও আত্মসম্মান সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন নন। যুগ যুগ হতে চলে আসা মানসিক গোলামী তাঁদের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ডুকে রয়েছে। অধিকাংশ নারী এখনও প্রচুর অর্থ ব্যয় করে কেবল বস্ত্রালঙ্কার কিনে সাঁজ-সজ্জা করার জন্য এবং বস্ত্রালঙ্কারের মাধ্যমে পুরুষকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু তাঁরা তদুনুরূপ বিদ্যা-শিক্ষা লাভ করে স্বাবলম্বী হয়ে স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপনের জন্য চেষ্টা করতে কম দেখা যায়। যে নারী নিজের অলঙ্কার এবং বস্ত্রের প্রতি সংযমতা পূর্বক অর্থ সাশ্রয় করে সে অর্থ দ্বারা লেখাপড়ার দিকে মনোযোগী হন এবং জ্ঞান আহরণ করতে বই-পুস্তক ক্রয় করেন, তাঁরাই সমাজে বীরাঙ্গনা, যুক্তিশীলা, স্বাধীন, স্বাবলম্বী হতে পারবেন এবং পৃথিবীকে উৎকৃষ্টতর বানাতে নারী-পুরুষের জন্ম দিতে পারবেন।
আজ হতে আড়াই হাজার বছর পূর্বে ভগবান তথাগত বুদ্ধ নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সঙ্ঘে নারীদের পূর্ণ অধিকার প্রদান করেছিলেন। সম্রাট অসোক বুদ্ধের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর কন্যা রাজকুমারী সঙ্ঘমিত্রাকে ঘরবন্দী করে না রেখে ভিক্ষুণী সঙ্ঘে দান করে শ্রীলঙ্কার মতো বহির্বিশ্বে ধম্ম প্রচারের জন্য প্রেরণ করেছিলেন।কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী বিচারধারা পরবর্তী সময়ে বুদ্ধ এবং সম্রাট অসোকের মতাদর্শকে উল্টে দিয়ে নারী বিদ্বেষী শাস্ত্র রচনা করে নারীর সব রকমের অধিকার হরণ করেছে।
পাশ্চাত্য দেশে সামাজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসার অন্যতম মুখ্য কারণ হল নারী-পুরুষের বৈষম্যহীনতা। নারীকে তাঁরা নারীরূপে না দেখে মানুষরূপে দেখে থাকেন। কোনো নারী সেখানে ধর্ষিত হওয়ার ভয় নাই, নির্ভয়ে মাথা উঁচু করে চলাফেরা করতে পারে। অবাধে শিক্ষা লাভ করতে পারে, নিজের স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারে। কেননা তারা কারো উপর নির্ভরশীল নয়। শিক্ষার শক্তি যেমন তাদের রয়েছে, তেমনি তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। সুতরাং তাদের মধ্যে কোনো গোলামী মানসিকতা নাই।
আর যেখানে নারীকে দেবী মান্য করে পূজা করা হয়, মানুষ বেশি করে ধর্মের লেবাস পড়ে রয়েছে, সেখানেই নারীরা ভয়ঙ্কররূপে অভিশাপগ্রস্থ, নির্যাতিত, ধর্ষিত ও পোষ্য পশু-পাখীর মতো খাঁচায় গৃহবন্দী। আমাদের দেশের পুরুষেরা মনে করে নারীকে ধর্মের ভয় দেখিয়ে শিক্ষা, অর্থ প্রভৃতি হতে পিছিয়ে রাখতে পারলে তাতে নিজের অধীনস্থ রেখে সব রকমের শোষণ করতে সহজতর হবে। ।
অতএব, নারী দিবসে নারীদের প্রতি শুভেচ্ছা জানানোর অর্থ এ নয় যে, নারীদের প্রতি সকল পুরুষের সম্মান রয়েছে। উপরে শুভেচ্ছা জানালেও অন্তরে পোষণ করে প্রচণ্ড ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বৈষম্য। তাই বলছি শুভেচ্ছা জানানোই কেবল যথেষ্ট নয়, নারীর প্রতি আমাদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন করতে হবে। যৌতুক ও কন্যা সম্প্রদানের মতো মানসিকতা তৈরী করে আমরা নারীকে ভোগ্যপণ্য বানিয়ে ফেলেছি। এরূপ মানসিকতা থাকলে শত নারী দিবস পালন করলেও কখনও নারী সম্মান প্রদর্শন হবেনা।
0 Comments