বৌদ্ধধর্ম ও অন্যান্য ধর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণ।
-------------------------------------
ভদন্ত বুদ্ধানন্দ মহাথেরো
********************
বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে মহাসাগরের ন্যায়। বিভিন্ন নদী-উপনদীর জল প্রবাহিত হয়ে মহাসাগরে পতিত হলে যেমন সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় , সেখানে অন্যকোন রূপ ধারণ করেনা তদ্রুপ " নম, শুদ্র, বৈশ্য , ব্রাহ্মণ, কলো, সাদা, উচ্চ-নীচু যে বংশ বা গোত্র থেকেই বুদ্ধের শাসনে বা বৌদ্ধধর্মে প্রবেশ করুক না কেনো সেখানে আর জাত-পাতের" কোন,পরিচয় বা ভেদাভেদ থাকেনা, মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মানুষের পরিচয় কিংবা উচ্চ-নীচু ভেদাভেদ হয় তার কুশল-অকুশল ও ভালো-মন্দ কর্মের মাধ্যমে।
ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেই ব্রাহ্মণ হয়না, আর চণ্ডালের ঘরে জন্মগ্রহণ করলে চণ্ডাল হয়না।কর্মের দ্বারাই ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, ভালো-মন্দ পরিচয় বহন করে।
যেমন- কেউ ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মগ্রহণ করে যদি অ-ব্রাহ্মণের কাজ করে, অকুশকর্ম অথবা পঞ্চশীলের পরিপন্থী (প্রাণীহত্যা, চুরি, ব্যভিচার, মিথ্যা কথা, নেশাদ্রব্য সেবন) কর্ম সম্পাদন করে। শীল-সমাধি-প্রজ্ঞার অনুশীলন করেনা, তাহলে কিভাবে সে ব্রাহ্মণ হবে ? তাছাড়াও ব্রাহ্মণ হতে হলে মৈত্রী , করুণা , মোদিতা ও উপেক্ষা এ চার গুণধর্ম তারমধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে ! এ চার গুণধর্মকে বলা হয় চারি ব্রহ্মবিহার !
অন্য একজন চণ্ডালের ঘরে জন্মগ্রহণ করে সে যদি কোন প্রকার পাপকর্ম না করে, পঞ্চশীল, অষ্টশীল, দশশীল প্রতিপলানসহ মৈত্রী, করুণা, উপেক্ষা এ চার গুণধর্ম ব্রহ্মবিহার ভাবনা অনুশীলন এবং শীল-সমাধি-প্রজ্ঞার অনুশীলন করে তবে সেইতো ব্রাহ্মণ বা উত্তম মানব বলে পরিচিত হবেন। এখানে তার আর চণ্ডালের পরিচয় বহন করেনা। এখানেই বুদ্ধের ধর্মের সাথে অন্য ধর্মের পার্থক্য।
বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনে স্বর্গ, দেবলোক অথবা ব্রহ্মলোক লাভ করাকে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করা বুঝায়না। দেবলোক (স্বর্গলোক), ব্রহ্মলোক লাভে আত্মা বা তৃষ্ণার (লোভ, দ্বেষ, মোহ) বিনাশ হয় না। তৃষ্ণা বা আত্মার কারণে সংসারে পুনঃ পুনঃ জন্মধারণ করে জরা, ব্যাধি, মৃত্যুসহ নানা রকম দুঃখ ভোগ করতে হয়। কিন্তু বুদ্ধের ধর্ম বা বৌদ্ধধর্মে শীল-সমাধি-প্রজ্ঞার অনুশীলনের মাধ্যমে (লোভ, দ্বেষ, মোহ) সর্বতৃষ্ণা ক্ষয় করে দেবলোক, ব্রহ্মলোক অতিক্রম করে লোভ-দ্বেষ-মোহ , কামনা-বাসনা ইত্যাদি আত্মার বিনাশ ও সম্পূর্ণরূপে মূলোৎপাটন বা ধ্বংস করে নির্বাণ লাভ কিংবা নির্বাণ অধিগত হওয়াকেই বিমুক্তি বলা হয়। লোভ, দ্বেষ, মোহ বা তৃষ্ণার বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট থাকেনা বলে আত্মাও বিনাশ হয়ে যায় বিধায় পুনর্জন্মের কোন সম্ভাবনা থাকেনা। জন্ম, জরা, ব্যাধি, সৃত্যুর আর কোন বিষয় আসয় অবশিষ্ট থাকেনা বলে একে নির্বাণ বলা হয়, আর বৌদ্ধ পরিভাষায় সেটাই নির্বাণ।
বৌদ্ধধর্মে নিজে মুক্তি লাভের জন্যে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা অথবা আশীর্বাদের প্রয়োজন হয়না। নির্বাণ লাভ করার জন্য ঈশ্বরের কোন ভূমিকা নেই। শুধু তাই নয়, জগতে কোন কাজে সফল হওয়ার জন্য নিকট আশীর্বাদ প্রার্থনার প্রয়োজন নেই। নিজে নিজে অষ্টাঙ্গিক মার্গ ও শীল, সমাধি, প্রজ্ঞার অনুশীলন দ্বারা নির্বাণ লাভ করা সম্ভব। নিজের চেষ্টায় সমস্ত কাজে সফলতা লাভ করা যায়।
বুদ্ধ বলেছেন, আত্মদীপ প্রজ্জ্বলন করো, নিজের শরণ নিজে গ্রহণ করো। নিজেই নিজের ত্রাণ কর্তা, নিজে ব্যতীত অন্য আবার কে ? সুতরাং আত্মনির্ভরশীল হও।
বৌদ্ধধর্মে সকল জীবের প্রতি সীমাহীন দয়া ও মৈত্রীভাব প্রদর্শন করার কথা বলা হয়েছে।
লোভ, দ্বেষ, মোহ বা তৃষ্ণাই মানব জীবনের সকল দুঃখ এবং পুনর্জন্মের কারণ। অতএব সকল প্রকার পাপকর্ম হতে বিরত থেকো, কুশল কর্ম বা সৎ কর্ম সম্পাদন করো, স্বীয় চিত্তকে পবিত্র, পরিশুদ্ধ করো। দান-শীল-ভাবনা, শীল-সমাধি-প্রজ্ঞার অনুশীলন" করার মাধ্যমে লোভ, দ্বেষ, মোহ, কামনা-বাসনা এক কথায় তৃষ্ণাকে সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করে নির্বাণ লাভ করা সম্ভব l ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা কিংবা আশীর্বাদ প্রার্থনা, ঈশ্বরের কৃপালাভের প্রয়োজন নেই।
বুদ্ধ কোন ঈশ্বর, ঈশ্বরের পুত্র, ঈশ্বরের বার্তা বাহক অথবা দেবতা কোনটাই নন। ভগবান বুদ্ধ হলেন মানব জীবনের দুঃখ মুক্তি ও নির্বাণের পথ প্রদর্শক এবং শাস্তা বা শিক্ষক মাত্র।
অন্যান্য ধর্মে ঈশ্বরই হলেন জন্মমৃত্যু, সুখ-দুঃখ, জরা-ব্যাধি, ধনী-দরিদ্র, সুশ্রী, কুশ্রী, অন্ধ, বিকালঙ্গ, স্বর্গ-নরক সমস্ত কিছুর মালিক। হিন্দুধর্মের অবতারগণ যুগে পৃথিবীতে অবতরণ করেন বলে অবতার তারা অবতার। যেহেতু তাঁরা তৃষ্ণামুক্ত নন তাই পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করেন। সেজন্য হিন্দুধর্ম ও অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাস করে আত্মার বিনাশ হয়না, আত্মা অবিনশ্বর। বৌদ্ধধর্ম বিশ্বাস করে আত্মার অস্তিত্ব বিদ্দমান নেই, সবই অনিত্য। এখানেই বৌদ্ধ ধর্মের চিন্তা-চেতনা, কর্ম-ভাবনা, ধর্মদর্শনের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের মূল পার্থক্য। বিষয়গুলো জ্ঞানী ও বিজ্ঞজনদের গভীরভাবে গবেষণা এবং বিচার্য বিষয়।
সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, সুস্থ থাকুন।জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক, দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করুক। পৃথিবীতে বুদ্ধের শাসন সদ্ধর্ম চিরস্থায়ী হোক। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠত হোক।
ভদন্ত বুদ্ধানন্দ মহাথেরো, প্রতিষ্ঠাতা উপাধ্যক্ষ
আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার, ঢাকা এবং
সিনিয়র সহ-সভাপতি
বাংললাদেশ বদ্ধিস্ট ফেডারেশন !
0 Comments