Hot Posts

6/recent/ticker-posts

Ad Code

মহামানব বুদ্ধ ও বিশ্বশান্তি :- ভদন্ত বুদ্ধানন্দ মহাথেরো

মহামানব বুদ্ধ ও বিশ্বশান্তি
**********************
 ভদন্ত বুদ্ধানন্দ মহাথেরো 





রাজ কুমার সিদ্ধার্থ জন্মজন্মান্তরে দশ পারমী, দশ উপ-পারমী, দশ পরমার্থ পারমী মোট ত্রিশ প্রকার পারমী পরিপূর্ণ করে  সর্বোপরি জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুকে জয় করার দৃঢ়সংকল্প নিয়ে রাজসংসার, বিলাস ব্যসন, রাজ্যশাসন পরিত্যাগ করে বরণ করে নিয়েছিলেন সন্যাস ব্রতকে। মৃত্যু মানব জীবনের এক চিরন্তন সত্য, সমগ্র জীবের মৃত্যু অবধারিত। কুমার সিদ্ধার্থ জাগতিক সকল প্রকার দু:খকে জয় করার মহান ব্রতকে সামনে রেখে সাধনার উপযুক্ত স্থান হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন জনমানব বিহীন গভীর অরণ্যকে। সেখানে তিনি দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনার পর বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে গয়ার বোধিদ্রুম মূলে বজ্রাসনে উপবেশন করে লোভ, দ্বেষ, মোহরূপ সকল প্রকার তৃষ্ণাকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষয় সাধন বা মূলোচ্ছেদ করে সম্যক সম্বুদ্ধ হয়েছিলেন। বুদ্ধ শব্দের অর্থ মহাজ্ঞানী।
তথাগত ভগবান বুদ্ধের জীবন দর্শনকে যথযথভাবে অনুধাবন করতে হলে তাঁর সমকালীন সময়ের দিকে তাকাতে হবে। সে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচার, নির্যাতনে সাধারণ দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, বর্ণবৈষম্য, জাতিভেদ, উঁচুনীচ ভেদাভেদ, হিংসা, যাগযজ্ঞ, হোমাগ্নি, দেবতার নামে পশুবলি এমন কি নরবলি দিতেও কুণ্ঠাবোধ করতো না। সাধারণ মানুষের প্রতি নর্যাতন, নিপিড়ন দেখে ভগবান বুদ্ধের কোমল হৃদয়ে প্রচণ্ড রেখাপাত করেছিলো। তখন থেকে তিনি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আরম্ভ করলেন এবং তার বিপরীতে অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী ও মহাকরুণার বাণী প্রচার করেছিলেন মানব জাতি তথা প্রাণী জগতের উদ্দেশ্যে।
আমরা জানি, করুণাঘন বুদ্ধ অত্যন্ত সহজ-সরল-সাধারণ ভাষায় নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতেন অতি সাধারণ মানুষের কাছে। খুব অল্প বাক্য কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথা।
বুদ্ধের মাত্র তিনটি উপদেশ (১ সকল প্রকার পাপকর্ম হতে বিরত থেকো, (২) কুশল কর্ম বা সৎ কর্ম সম্পাদন করো, (৩) নিজের চিত্তকে পরিশুদ্ধ রেখো। এ উপদেশগুলোর মধ্যে কোথাও জটিলতা নেই। অত্যন্ত সরল ভাষা, বুঝতে কারো সাহার্যের প্রয়োজন হয়না। না দার্শনিকতা, না পাণ্ডিত্য, না অন্য কারো দোহাই ! জনগণের কাছে থেকে জনগনের কথা - নিজের কর্মই নিজের ভবিষ্যৎ। তুমি তোমমার প্রদীপ সদৃশ, আত্মদীপ প্রজ্বলন করো, নিজেই নিজের ত্রাণকর্তা, এসো, দেখো, ভাব বুঝতে চেষ্টা করো, ভালো লাগলে গ্রহণ করো, অন্যতায় কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কেউ তোমার মুক্তিদাতা নয়, তোমার মুক্তির পথ তোমাকেই রচনা করতে হবে। আমি শিক্ষক বা পথ প্রদর্শক মাত্র। এসমস্ত বক্তব্যে পারলৌকিক প্রতিফলন নেই। তবে পরবর্তী জীবন আছে, সত্য আছে, সত্য বলার আড়ম্বর নেই। কোথাও ঠকাবার মানসিকতা নেই। বাস্তবতার সাথে সম্পৃক্ত এসব বক্তব্য, এজন্যে মাধুর্যমণ্ডিত। যে কারণে মানব জাতির সঙ্গে বুদ্ধের সেতুবন্ধন হয় অতিসহজে।
আজ পৃথিবী জুড়ে চলছে যুদ্ধ, সংঘাত, হানাহানী, হিংসা, একদেশ অন্যদেশের উপর খবরদারি, আগ্রাসন নীতি, পারমানবিক অস্ত্রের বাড়াবাড়ি, হুমকি, যুদ্ধ প্রস্তুতি। আমার মতে মহামানব বুদ্ধের পঞ্চশীল, মৈত্রী ও অহিংসা নীতি ভিত্ততে বিশ্বের সকল প্রকার সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। তাছাড়াও এই মুহুর্তে দরকার আড়াই হাজার বছর পূর্বে তথগত বুদ্ধের প্রবর্তিত পঞ্চশীল ও মৈত্রীর বাণীকে আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত করা। পঞ্চশীল, অহিংসা, সাম্য এবং মৈত্রীর বাণীই পৃথিবীতে স্হায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। পঞ্চশীলকে নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করলে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, বুদ্ধ জগতের মঙ্গলের জন্য অপরিমেয় মৈত্রী, করুণা ও অনুকম্পা প্রদর্শন করেছিলেন। বুদ্ধের অমোঘ বাণী হলো "বৈরীতার দ্বারা বৈরীতা, শত্রুতার দ্বারা শত্রুতা কখনো প্রসমিত করা যায়না, অবৈরীতা ও মিত্রতার দ্বারাই বৈরীতা ও শত্রুতার চির অবসান হয়, ইহাই সনাতন ধম্ম।" জগতের কল্যাণ সাধনে মহামানব বুদ্ধের সমকক্ষ অন্য কেউ নেই। তথাগত ভগবান বুদ্ধ মানব কবাস্তবসম্মত যে সকল বাণী পৃথিবীতে প্রচার করে গেছেন তা চিরসত্য ও চির সমুজ্জ্বল, এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। 
এইচ জি ওয়েলস্ বলেন - "Buddhism has done more for the advance of world civilization and true culture then any other influences in the chronicles of mankind.
মানব ইতিহাসের অন্য সকল শক্তির চেয়ে বৌদ্ধধর্ম বিশ্বসভ্যতা ও প্রকৃত সংস্কৃতিকে অধিকতর এগিয়ে দিয়েছে।
বৌদ্ধধর্ম সম্পূর্ণ নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বমৈত্রীতে অনুপ্রাণিত। দেশকাল-জাতিভেদ শূণ্য, সর্বজনীনতা বৌদ্ধধর্মে দেখা যায়। মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। এই সাম্যবাদ বুদ্ধের মুখ থেকেই সর্বপ্রথম ধ্বনিত হয়য়েছিলো।
বৌদ্ধধর্ম মানুষের অন্তরের ধর্ম। কোন বাহ্যিক নিদর্শন, আচার-অনুষ্ঠানের নির্দেশ এখানে নেই। সকল মানুষের প্রতি মৈত্রীদৃষ্টি, সব ধর্মের সমদৃষ্টি এ ধর্মের শিক্ষা। বুদ্ধ মানুষকেই সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির প্রতি এতবড় প্রশান্তি তাঁর পূর্বে অন্য কোন ধর্ম সংস্কারক স্হাপন করতে পারেননি। 
"সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই "। 
কবির এ উক্তি যেনো বুদ্ধবাণীরই প্রতিধ্বনি। মানুষ ক্ষুদ্র নয়। দেবী কৃপা তাঁর জীবন চলার পথের পাথেয় নয়। আত্মশক্তির উদ্বোধনে সে হতে পারে "সতত মহিয়ান"। এই শক্তি লাভে সকল মানুষের জন্মগত অধিকার।  
বুদ্ধের ধর্মমত ঈশ্বরের কৃপার উপর নির্ভরশীল নয়, আত্মার অস্হিত্বে বিশ্বাস করেনা। অপ্রমাণ্য, অপ্রত্যক্ষমূলক সিদ্ধান্ত এই ধর্মে নেই। যুক্তিপূর্ণ বাস্তব সত্য চিরদিনই সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে। তাই বৌদ্ধধর্ম আজ মানব জাতির একমাত্র শান্তি ও মুক্তির ধর্ম।
প্রসিদ্ধ ভারতীয় দার্শনিক ডঃ রাধাকৃষ্ণ বলেছেন,- 
"If Buddhism appealed to the modern mind it was becouse it was scientific, empirical and not based on any dogma "বৌদ্ধধর্ম যে আধুনিক মনে স্হান পেয়েছে তার কারণ, এটা বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতাপ্রসুত এবং কোন মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।
ঐতিহাসিকগণ জানেন যে, ধর্মযুদ্ধে পৃথিবী বহুবার মানুষের রক্তে প্লাবিত হয়েছে। কারণ ঈশ্বরের পৃথিবীতে মানুষের সুখ-দুঃখের চেয়ে ঈশ্বরের আদর্শই শক্তিমান বলে বিবেচিত হয়েছে । অথচ বৌদ্ধধর্ম প্রচারে ও প্রসারে একবিন্দু নররক্তে পৃথিবী কখনও কলঙ্কিত হয়নি এবং একবিন্দু পশুরক্তে বুদ্ধের পবিত্র মন্দির অপবিত্র হয়নি। যদিও বৌদ্ধধর্ম প্রায় অর্ধেক  পৃথিবীতে প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছিলো। 
কবি ডি এল রায়ের ভাষায় -
"উদিল যেখানে বুদ্ধ- আত্মা মুক্ত করিতে মোক্ষ দ্বার, 
আজিও জুড়িয়া অর্ধজগৎ ভক্তি-প্রণত চরণে তাঁর"। 
আমাদের আজকের প্রার্থনা হবে, মহামানব বুদ্ধের অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী ও করুণার বাণী দ্বারা হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে পরম শান্তি স্হাপন করা।
কবির ভাষায় - 
সমরে করিতে না'রে মন অধিকার, 
হিংসায় হিংসায় ইন্ধন জ্বলে বারবার।
মৈত্রীর সমান গুণ নাই ধরণীতে,  
মৈত্রীই আনিবে শান্তি, অশান্ত পৃথিবীতে । 
জগতের সকলে মঙ্গল লাভ করুক। 
বিশ্বের সকল প্রাণী সুখী হোক।। 
লেখক ---
#ভদন্ত বুদ্ধানন্দ মহাথেরো 
★প্রতিষ্ঠাতা উপাধ্যক্ষ
আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার, ঢাকা ।
★সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট 
বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন ।

Post a Comment

0 Comments

Ad Code

Responsive Advertisement