
ভগবান তথাগত বুদ্ধ মানুষের জীবনের মঙ্গলকারক আটত্রিশটি মাঙ্গলিক উপদেশ দিয়েছে, যা ‘মহামঙ্গল সূত্র’ নামে সূত্র পিটকের খুদ্দক নিকায়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে। আমরা সাধারণত: দেখতে পাই যে, আমাদের বৌদ্ধদের মধ্যেও অনেকে মঙ্গল বিবেচনা করে কোনো যাত্রায় বা কোনো কাজের জন্য শুভ মুহুর্ত, শুভ ক্ষণ বা শুভ লগ্ন ইত্যাদি খুঁজতে থাকে। আবার অনেকে মঙ্গলের জন্য হাতে সূতা কিংবা বাহুতে বা কোমরে অথবা গলায় তাবিজ কবচ ধারণা করে থাকে। আবার কেহ কেহ কোথাও কোথাও মানতাদিও করে থাকে। অনেক ভিক্ষুরাও ভক্তদেরকে হাতে-গলায় সূতা পরিয়ে মঙ্গল কামনা করে থাকেন এবং সূতা ধারণের জন্য ও মানত করার জন্য ভক্তদেরকে উৎসাহিত করে থাকেন। এরূপ পরম্পরা যে আমাদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, সেগুলি বুদ্ধ দেশিত মঙ্গল সূত্রের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক দেখা যায়। সেখানে এ কর্মগুলির কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়না। মহাকারুণিক বুদ্ধ মঙ্গল সূত্রের কোথাও বলেননি যে, মঙ্গলের জন্য শুভ মুহুর্ত, শুভ ক্ষণ বা শুভ লগ্ন দেখতে হবে অথবা সূতা, তাবিজ-কবচ ধারণ করতে হবে বা মানত করতে হবে। এ সমস্ত আচরণ দেখলে মনে স্বতঃই প্রশ্ন জাগে যে, আমরা কি বুদ্ধকে সত্যিকারভাবে অনুসরণ করছি? নাকি অন্ধ ভক্তি ও অন্ধবিশ্বাসে ডুবে রয়েছি। বুদ্ধের সূত্র দেশনা আমরা প্রতিনিয়ত পাঠ করলেও সেগুলির সাথে আমাদের মন-মানসিকতা ও বাস্তব জীবনাচরণের কোনো মিল খুঁজে পাইনা।
মঙ্গল সূত্রের মধ্যে অন্যতম একটি মঙ্গলের বিষয় হল ‘পুত্ত-দারস্স সংগহো’ অর্থাৎ স্ত্রী-সন্তানের ভরণ-পোষণ, তাদের প্রসন্ন রাখা, এবং তাদের প্রতি যথাযথ কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করাই হল উত্তম মঙ্গল।
একজন গৃহস্থ পুরুষ তাঁর স্ত্রীকে কিভাবে যুক্ত করে রাখবেন? এ সম্পর্কে বুদ্ধের নির্দেশনা কি? পতি-পত্নীর মধুর সম্পর্ক ধরে রাখতে হলে পরস্পর-পরস্পরকে সম্মান ও মর্যাদা দান করতে হবে। পতির উচিত যে,পত্নীকে সন্তুষ্ট রাখতে সর্বদা চেষ্টা করা। যে পতি পত্নীকে সন্তুষ্ট রাখে, তখন পত্নীও পতিকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করবে।
পত্নীকে কখনও অবজ্ঞা, অবহেলা, অসম্মান, অমর্যাদা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য সূচক বাক্য বলা উচিত নয়। কখনও পরনারীর প্রতি আসক্ত হয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। অনুরূপভাবে পত্নীরও উচিত যে, কখনও পর পুরুষের প্রতি আসক্ত না হওয়া। পতি হল গৃহের অর্থ রোজগারের মুখ্য স্রোত। সুতরাং পতির কর্তব্য যে, পত্নীকে সব কিছুর ভাগীদার করে উপার্জিত সম্পত্তির দায়িত্ব অর্পণ করে অধিকারিণী করা।
স্ত্রীরও উচিত যে, স্বীয় পতিতে সন্তুষ্ট থেকে একজন আদর্শ জীবন সঙ্গিনীরূপে ধম্ম কর্তব্য সম্পাদন করা। তিনি পতির কষ্টার্জিত অর্থ-বিত্তকে সযত্নে রক্ষা করবেন, কুশলতা পূর্বক গৃহের কাজ-কর্ম সম্পাদন করবেন। নিজের এবং পতির সকল আত্মীয়-স্বজন ও মিত্র-পরিজনদেরকে সম্মান ও গৌরব করবেন। গৃহকর্ম দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করতে সদা তৎপর থাকবেন। প্রমাদ বা আলস্য বশতঃ কর্তব্য কর্মে অবহেলা করা উচিত নয়।
এভাবে উভয়ে কুশলতা পূর্বক ধম্মময় দাম্পত্য জীবন সংগ্রহ করবেন। পরস্পর পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, সন্দেহ ও অশ্রদ্ধা হয় তেমন কাজ-কর্ম ও বাক্যালাপ হতে বিরত থাকা সর্বদা বাঞ্ছনীয়। সুখে-দুঃখ, ভাল-মন্দে, উত্থান-পতনে সর্বদা পরস্পর-পরস্পরের বিশেষ ভার বহন করার নামই হল বিবাহ। কেবল সুখে সঙ্গ দিয়ে দুঃখের সময় ঠেলে দূরে ফেলে দেওয়ার নাম বিবাহ নয়।
একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গ হলে তাতে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়। অশান্তি বৃদ্ধি পায়। ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হয়। তাতে পরস্পরের বিচ্ছেদ পর্যন্ত হতে পারে। ডিভোর্স বা বিবাহ বিচ্ছেদ হলে নিজেদের জীবনে যেমন অমঙ্গল ও দুর্দশা নেমে আসে, তেমনি তাঁদের সন্তাদের জীবনেও চরম দুর্দশার সৃষ্টি হয়। এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি যাতে না হয়, সেজন্য প্রথম হতে পতি-পত্নী উভয়ের সচেতন থাকা প্রয়োজন। তাতে পতি-পত্নী ও সন্তানদের সাথে সর্বদা সুখে যুক্ত থাকা যায়।
সাত বছর বয়স পর্যন্ত নিজেদের সন্তানদেরকে অনেক আদর-স্নেহ করতে হবে। তাদেরকে সুন্দর আচার-ব্যবহার শিক্ষা দিতে হবে। আট হতে ষোল বছর বয়স পর্যন্ত সম্তাদেরকে সংযমতা পূর্ণ ও শাসন-অনুশাসন মূলক জীবন-যাপনের জন্য অভ্যস্ত করাতে হবে। যেখানে প্রয়োজন সেখানে স্নেহের সাথে কঠোর শাসন করতে হবে। ভাল-মন্দ প্রত্যেক কিছু সম্পর্কে জ্ঞান দান করতে হবে। সুশৃঙ্খল ও পরিচ্ছন্ন জীবন গঠনের জন্য দিক নির্দেশনা দিতে হবে। একজন আদর্শ শিক্ষককের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে মাতা-পিতাকে।
ষোল বছর বয়সের পর সন্তানদেরকে ভালমতে বন্ধুর মত আদেশ-উপদেশ ও বুদ্ধি-পরামর্শ প্রদান করে বুঝাতে হবে। এভাবে পারিবারিক জীবনে পতি-পত্নী ও পুত্র-কন্যা সকলকে নিয়ে উত্তম মঙ্গল সহকারে যাপন করা যায়। আদর্শ পতি-পত্নীর আদর্শ সম্তানরূপে গড়ে উঠে মঙ্গলময় জীবন গঠনে এগুলিই হল উত্তম ব্যবস্থাপত্র। কোনো মন্ত্র বা তাবিজ-কবচে বা সূতা ধারণে বা শুভ লগ্নে, ক্ষণে, মুহুর্তে মঙ্গল হয়না।
যদি মাতা-পিতা নিজেদের সন্তানদেরকে সঠিক রাস্তায় চলার জন্য শিক্ষা দিতে সময় ব্যয় না করেন, তাহলে সন্তান ভুল পথ অনুসরণ করে নিজের এবং পরিবারের ভয়ানক দুঃখ-দুর্দশা ডেকে আনবে। তখন মাতা-পিতাকেও অভিশপ্ত ও অমঙ্গলকর জীবন-যাপন করতে হবে। যথাসময়ে সম্তানদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে, আদর্শ চরিত্র শিক্ষা দিতে না পারলে, মানবীয় গুণ সম্পন্ন করতে না পারলে, তাদের উশৃঙ্খলতা দ্বারা জীবনে যখন অমঙ্গল নেমে আসবে, তখন তা পরিবর্তন করে মঙ্গলময় করতে কোনো তাবিজ-কবচ, জল-পড়া, সূতা ধারণ বা মানতাদি কোনো কিছুই কাজে আসবেনা। সব কিছুই তখন অসার, অনর্থ, অকার্যকররূপে পরিগণিত হবে। সবই ব্যর্থ হয়ে যাবে। এজন্য আমাদের জীবনে মঙ্গলের জন্য মঙ্গল সূত্রে বুদ্ধ দেশিত শিক্ষা সমূহের সঠিক অনুশীলন করা অতীব আবশ্যক।
0 Comments