---
--- বীর
মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী জ্যোতি বিকাশ বড়ুয়া
অনেক অনেক কাল আগে গান্ধারের
মধ্যে অমরাবতী নামে একটি ছোট রাজ্য ছিল। দীপাবতী নগর ছিল সে রাজ্যের রাজধানী। সেখানে
সর্বানন্দ নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন। অমরাবতীতে সুমেধ নামে এক ব্রাহ্মণ কুমার ছিলেন।
সুমেধ যেমন ছিলেন রূপবান তেমনি মেধাবী। অতি অল্প বয়সেই বেদজ্ঞ পণ্ডিত হিসেবে তাঁর সুনাম
ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর এই অনন্য মেধা ও পাণ্ডিত্যের জন্য রাজা সর্বানন্দ তাঁকে পাঁচটি মূল্যবান
প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। পুরস্কারগুলি হলো- একটি স্বর্ণের জলের পাত্র, একটি মূল্যবান
ছড়ি, একটি স্বর্ণখচিত পালঙ্ক, পাঁচশত কর্ষাপণ মুদ্রা এবং পার্শবর্তী নগরের পুষ্কলাবতী
নামে এক উজ্জ্বল অপরূপা কন্যা। পষ্কলাবতী ছিলেন অপরূপ রূপসী এবং সর্বগুনে গুণান্বিতা,
নগরের যুবকদের হৃদয় হরণকারী। নির্দিষ্ট দিনে সুমেধ উপহার নিতে রাজ-সভায় উপস্থিত হন।
রাজা নিজ হাতে একে একে উপহারগুলি সুমেধের হাতে তুলে দিতে থাকেন। সুমেধ সবাইকে বিস্মিত
করে শেষের উপহারটি গ্রহণ করলেন না। বিনীতিভাবে রাজার কাছে মাফ চেয়ে নেন। এই উপহার গ্রহণ
না করার কারণ-সুমেধ এর আগেই সংসার জীবনের দুঃখ কষ্ট দেখে সংসারের প্রতি বিরূপ হয়ে পড়েছিলেন
এবং সিদ্ধান্ত নেন, লোকালয় ছেড়ে বনে গিয়ে তপস্যা করবেন। এদিকে প্রত্যাখ্যাত হলেও এই
প্রত্যাখান পষ্কলাবতীর অন্তরে সুমেধের প্রতি গভীর অনুরাগের সৃষ্টি করে। সুমেধকে পাওয়ার
জন্য তাঁর মন আকুল হয়। প্রবল আবেগকে সংযত করতে না পেরে অবশেষে একদিন তিনি নিজেই সুমেধের
কাছে গিয়ে তাঁকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু সুমেধ তাঁর সিদ্ধান্তে
অটল থাকেন।
এরপর সুমেধ বনে গিয়ে তপস্যা
শুরু করেন। হতভাগ্য পষ্কলাবতীও মনের দুঃখে বিবাগী হয়ে নিজ নগর ছেড়ে দীপাবতীর উপকণ্ঠে
এসে বসবাস করতে থাকেন এবং নিজেকে দেবদেবীর পূজায় সমর্পণ করেন। সেখানে তিনি এক উদ্যানপালককে
একটি শর্তে তাঁর সব অলঙ্কারাদি অর্পণ করেন।
শর্তটি হলো- ‘উদ্যানপালক প্রত্যেক দিন পূজার জন্য তাঁকে নীলপদ্ম সরবরাহ করবেন’।
সেই সময় পার্শবর্তী রাজ্য রম্যবতীতে
(নগরহারা’র আগের নাম) ‘বুদ্ধ দীপঙ্কর’ ধর্ম প্রচার করছিলেন। রাজা
সর্বানন্দ ও তাঁর প্রজাগণের খুব ইচ্ছে হল বুদ্ধ দীপঙ্করের দর্শন লাভের। রাজা বুদ্ধকে
তাঁর রাজ্যে আগমনের জন্য বিনীত আহ্বান জানালেন। বুদ্ধ রাজার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে দীপাবতীর
উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। বুদ্ধের আগমন উপলক্ষে নগরকে সুসজ্জিত করা হয়। রাস্তার দু’পাশ
ফুলে, পতাকায় ও মঙ্গল ঘটে সাজানো হয়। সভাসদসহ রাজা ও নগরবাসীরা পূজার আয়োজন সম্পূর্ণ
করে নব সাজে সজ্জিত হয়ে বুদ্ধের আগমনের প্রতীক্ষা করতে থাকেন। ঘটনাচক্রে সমেধও সেদিন
লবণ ও তৈল সংগ্রহের জন্য বন থএকে বের হয়ে দীপাবতী নগরে আসেন। তিনি দীপঙ্কর বুদ্ধের
আগমনের কথা শুনে ভাবলেন- তাঁর বহুদিনের লালায়িত স্বপ্ন ‘দীপঙ্কর বুদ্ধকে দেখা ও বরণ
করা’, আজ পূর্ণ হবে। দীপঙ্কর বুদ্ধকে বরণ করার
জন্য তিনি নগরে পদ্ম ফুলের সন্ধানে যান। ফুল খুঁজতে গিয়ে দেখেন ইতিমধ্যে দীপঙ্কর বুদ্ধের
জন্য সব ফুল রাজকর্মচারীরা নিয়ে গেছেন। ঠিক একই সময়ে পুষ্কলাবতীও পদ্মের জন্য তাঁর
সেই বাগানের পদ্মপুকুরে এসে দেখেন, সেই পুকুরের
সব পদ্ম রাজার লোকেরা নিয়ে গেছে। তিনি চোখ বন্ধ করে সমস্ত মনপ্রাণ সমর্পণ করে কামনা
করেন- যেন কোথাও না কোথাও থেকে যেন কিছু পদ্ম সংগ্রহ করতে পারেন। তিনি চোখ খুলে বিস্মিত
হয়ে দেখেন, পুকুরে যেখানে একটু আগেও কিছু ছিল না, সেখানে সাতটি নীলপদ্ম প্রস্ফটিত হয়ে
আছে। তিনি তৎক্ষনাত জলে নেমে ফুলগুলো তুলে আনেন। তারপর বুদ্ধ দর্শনের জন্য নগরের দিকে
রওনা দেন।
এদিকে সুমেধ পদ্ম খুঁজতে খুঁজতে
নগরের প্রায় বাইরে এলে হঠাৎ নগরে প্রবেশের জন্য আগুয়ান পুষ্কলাবতীকে দেখেন। দেখেন-
পুষ্কলাবতীর হাতে সদ্য ফোটা সাতটি নীলপদ্ম। তিনি পুষ্কলাবতীর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে পাঁচশত
মুদ্রার বিনিময়ে পাঁচটি নীলপদ্ম নিতে চান। পুষ্কলাবতী পূর্বের প্রত্যাখানের কথা স্মরণ
করে সুমেধকে ফুল দিতে অস্বীকার করেন। সুমেধ ফুলের জন্য অনুনয় বিনয় করতে থাকেন। তখন
পুষ্কলাবতী বললেন- ‘যদি তুমি আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করো, ভবিষ্যৎ জন্মে আমাকে তোমার স্ত্রী
হিসেবে গ্রহণ করবে, তাহলে আমি তোমাকে ফুল দিতে পারি’। অনন্যোপায় হয়ে সুমেধ পুষ্কলাবতীকে
ভবিষ্যৎ জন্মে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করার প্রতিজ্ঞা করেন। তখন পুষ্কলাবতী তাঁকে পাঁচটি
ফুল দেন।
ফুল নিয়ে দু’জনেই দীপঙ্কর বুদ্ধের
আগমনের পথের দিকে অগ্রসর হন। একটু পরেই সশিষ্য পরিবৃত দীপঙ্কর বুদ্ধ এসে পড়েন। সুমেধ
ও পুষ্কলাবতী তাঁদের একটু আগের প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করে হাতের পদ্মগুলি দীপঙ্কর বুদ্ধের
দিকে ছুঁড়ে দেন। ফুলগুলি বুদ্ধের গলায় মালা হয়ে ঝুলতে থাকে।
এদিকে দীপঙ্কর বুদ্ধের আগমন
উপলক্ষে নগরীর উপকন্ঠে রাস্তা সংস্কারের কাজ চলছিল। বুদ্ধ কাছে এসে পড়ার মুহুর্তেও
কিছু সংস্কার কাজ বাকি থেকে যায়। রাস্তায় অল্প একটু অংশে তখনও কাদা জল ছড়িয়ে ছিল। সংস্কারে
নিযুক্ত লোকজনেরা কি করবে ভেবে পেল না।
সুমেধ দেখলেন, সংস্কারকাজ সম্পূর্ণ
শেষ না হওয়ায় একটা জায়গায় বুদ্ধ ও শিষ্যগণকে কাদা-জল মাড়িয়ে যেতে হবে। তিনি ভাবলেন-
বুদ্ধের পায়ে কাদা-জল না লাগার ব্যবস্থা করতে হবে। তখন তিনি বুদ্ধের গমনপথে কাদা-জলের
ওপর উপর-হয়ে শয়ে পড়েন এবং শিষ্যগণসহ বুদ্ধকে তাঁর গায়ের উপর দিতে হেঁটে চলে যাবার জন্য
অনুরোধ করেন। প্রার্থনা করলেন- ‘এই পুণ্যের ফলে তিনিও যেন দীপঙ্কর বুদ্ধের মত একজন
বুদ্ধ হয়ে জগতের কল্যাণ সাধন করতে পারেন’। দীপঙ্কর বুদ্ধ তাঁর প্রার্থনা শুনলেন। দিব্যচক্ষুতে
দেখলেন, “এই শায়িত তাপস বহু কল্প পরে ভদ্রকল্পে ‘গৌতম বুদ্ধ’ নামে বুদ্ধ হবেন। রমণীয় কপিলাবস্তু হবে তাঁর জন্মস্থান। তাঁর
পিতা হবেন রাজা শুদ্ধোধন এবং মা হবেন রাণী মহামায়া। আজ থেকে তিনি ‘বোধিসত্ত্ব’ বা বুদ্ধাঙ্কূর”। সুমেধ ভাবলেন, “বুদ্ধের বাক্য কখনও বৃথা হবে না। সুতরাং
একদিন আমি বুদ্ধ হবই।“ তখনই তিনি বুদ্ধত্ব লাভের জন্য দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করলেন। দীপঙ্কর
বুদ্ধের ভবিষ্যৎ বাণী অনুযায়ী সেদিনের দীপাবতী নগরের মেধাবী রূপবান ব্রাহ্মণ কুমার
সুমেধ ভদ্রকল্পে শাক্যরাজের কপিলাবস্তু নগরে সিদ্ধার্থ
রূপে জন্মগ্রহণ করেন। সেদিনের দীপাবতীর রূপবতী গুনবতী কন্যা পুষ্কলাবতীও সেখানে
জন্ম নিয়ে যশোধরা নামে রাজপুত্র সিদ্ধার্থের
সহধর্মিনী হন।
সিদ্ধার্থ ও যশোধরা
পুনঃ
আফগানিস্তানের খাইবার পাস থেকে কাবুল উপত্যকা পর্যন্ত এলাকার নাম ছিল ‘নগরহারা’।
কাবুল
উপত্যকা থেকে আফগানিস্তানের সমগ্র উত্তরাঞ্চল, তাজিকস্তান ও উজবেকিস্তানের দক্ষিণাংশ
নিয়ে ছিল ‘ব্যাকট্রিয়া’ রাজ্য।
আফগানিস্তানের
উত্তর-পুর্বেও কিয়দংশ, পাকিস্তানের সমগ্র উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সোয়াত স্টেট
এবং পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের কিছু অংশ নিয়ে ছিল ‘গান্ধার’
রাজ্য।
চীনের
মহাপরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ভারত ভ্রমণে আসার সময় আফগানিস্তানের নগরহারা হয়ে এসেছিলেন।
তিনি তাঁর ভ্রমণ বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন – “লাম্পক রাজ্য থেকে তিনি একটি ছোট পর্বত
নদী অতিক্রম করে নগরহারায় প্রবেশ করেন। রাজধানী শহরের ২ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে ৩০০ ফুট
উঁচু একটি স্তূপ দেখেন। এই স্থানে বহু অতীত কল্পান্তরে শাক্য বোধিসত্ত্ব (সুমেধ তাপস)
দীপঙ্কর বুদ্ধের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। সম্রাট অশোক স্থানটিকে চির-স্মরণীয় করে রাখার জন্য
এই বিশাল স্তূপ নির্মাণ করেন। তিনি স্তূপ বন্দনা করেন এবং স্তূপের চারদিকে প্রদক্ষিণ
করেন।“
লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী জ্যোতি বিকাশ বড়ুয়া
ইমেইলঃ baruajb43@yahoo.com
0 Comments