** অভিধর্ম শব্দের অর্থ কি? অভিধর্মের রচনাকাল আলোচনা কর?
উত্তর ঃ অভিধর্ম ঃ “অভি” উপসর্গের সঙ্গে “ধম্ম” শব্দটি যোগ করে অভিধর্ম পদ গঠিত হয়েছে। অভি উপসর্গের অর্থ অতি বা অধিকতর এবং ধম্ম শব্দের অর্থ চিন্তনীয় বিষয়। সুতরাং অভিধর্মের অর্থ অতিরিক্ত ধর্ম বা অধিকতর ধর্ম। আচার্য বুদ্ধঘোষ অভিধর্মের অর্থ করেছেন “ধম্মাতিরেক ধম্ম বিসেসত্থেন অভিধম্মো’, অর্থাৎ ধর্মের অতিরিক্ত অভিধর্ম।
প্রকৃত পক্ষে ধর্ম ও অভিধর্মের আলোচ্য বিষয় প্রায় এক রুপ। যখন পালি শাস্ত্র ত্রিপিটক রুপে শ্রেণী বিন্যাস্ত হয়নি তখন বুদ্ধ বচনকে ধম্ম বিনয় বলা হত। এখানে ধম্ম বলতে সুত্ত পিটকের অন্তভূক্ত সূত্রগুলোর মধ্যে প্রতীত্য সমুৎপাদ আর্যসত্য, স্মৃতি প্রস্থান, সপ্তবোধ্যঙ্গ, নির্বান ইত্যাদি বুদ্ধের ধর্মতত্ত্বকে বুঝায়। উপরোক্ত ধর্মতত্ত্ব গুলো অভিধর্মের ও আলোচ্য বিষয় এবং বিষয় বিন্যাস ও ব্যাখ্যা কুশলতা ব্যতীত উভয়ের তেমন কোন পার্থক্য নেই।
অভিধম্ম নাম করণের কারণ সুত্তপিটকে যা উপমা কাহিনী এমন কি গাথার সাহায্যে সরস ভঙ্গীতে বর্ণিত ও ব্যাখ্যাত হয়েছে তা অভিধম্ম পিটকে পুঙ্খানুপুঙ্খ রুপে বিশেষ ভাবে বিভাজন বা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সে জন্য অভিধম্ম পিটক সুত্তপিটকের তুলনায় নীরস ও পান্ডিত্য পূর্ন হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ের বিশ্লেষণ ও শ্রেনী বিন্যাস অভিধম্ম পিটকের একটি বৈশিষ্ট্য।
অভিধম্ম পিটক সম্পূর্ন রুপে প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিতে রচিত হয়েছে। মজঝিম নিকায় ও অঙ্গুত্তর নিকায়ের কতিপয় সূত্র প্রশ্নোত্তর পদ্ধতির মাধ্যমে ও ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সুত্ত পিটকে শীল ধর্ম ও র্দাশনিক তত্ত্বের যে তালিকা পাওয়া যায় অভিধম্ম পিটকে সে তালিকার বিশদ ও পরিবর্ধিত রুপ পাওয়া যায়। অভিধম্ম পিটক সুত্ত পিটকের পরিপুরক বলা যায়। বৌদ্ধ ঐতিহ্যে সুত্তকেই অভিধম্মের ভিত্তি বলা হয়।
অভি ধর্মের রচনা কাল ঃ অভিধম্ম পিটকের রচনা কাল সম্পর্কে আধুনিক পন্ডিতের মধ্যে মতভেদ আছে। বুদ্ধঘোষের মতে, বৌদ্ধ সঙ্গীতিতে সুত্তপিটক ও সুত্তপিটকের সঙ্গে অভিধম্মও আবৃত্তি করা হয়েছিল। তথাপি ইহার সত্যতা সম্পর্কে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি।ি সংহলী বংশকাব্য দীপবংস ও বুদ্ধ ঘোষের সমান্ত পাসাদিকা হতে জানা যায় যে, সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতির শেষে সম্মেলনের সভাপতি মো¹লিপুত্ত তিসস বিভজ্যবাদ বা থেরবাদ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অভিধম্ম পিটকের অন্যতম গ্রন্থ কথাবুত্থ সংকলণ করেছেন।
আধুনিক পন্ডিতেরা মনে করেন কথাবত্থুর অভিধম্ম পিটকের শেষ পর্যায়ের রচনা। কারণ এতে যে সকল মতবাদ খন্ডন করা হয়েছে তাদের মধ্যে অনেক গুলোর উদ্ভব বুদ্ধের পরিনির্বাণের দুই শত বৎসরের পূর্বে হয়নি। সুতরাং আমরা যদি কথাবত্থুর রচনা খৃঃপূঃ তৃতীয় শতাব্দীতে হয়েছিল বলে স্বীকার ও করি তাহলে ধম্ম সংগণি, বিভঙ্গ ইত্যাদি পূর্ববতী গ্রন্থ গুলো খৃঃপূঃ তৃতীয় শতাব্দীর পূর্বে রচিত হয়েছিল। থেরবাদ বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুসারে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ অভিধম্ম দেশনা করেছেন। কথিত আছে, বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে গিয়ে মাতা মায়া দেবীর নিকট অভিধম্ম ব্যাখ্যা করেছেন।
অঙ্গুত্তর নিকায়, মজ্ঝিমা নিকায় ও পটিসম্ভিদা মগ্গে অভিধম্ম পদ্ধতিতে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ধর্মতত্ত্ব বিশ্লেষণ করার প্রয়াস আমরা দেখতে পাই। সুতরাং অভিধম্ম রচনা সুচনা যে বহু পূর্বে আরম্ভ হয়েছিল তা অসম্ভব নয়। সম্ভবতঃ সুত্তপিটক সংকলনের অব্যবহিত পরে থেরবাদী পন্ডিত ভিক্ষুগণ অভিধম্ম সংকলন করতে তৎপর হয়েছিলেন। তবে এই সংকলন কার্য খৃঃপূঃ তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতাব্দীর পূর্বে সমাপ্ত হয়েছিল বলে মনে হয় না। ভারহুত ও সাঁচীর শিলালিপিতে আমরা পঞ্চনেকায়িক, সুত্তন্তিক , ধম্ম কথিক, পেটকিন ইত্যাদির উল্লেখ পাই কিন্তু অভিধম্মের পিটকরুপে কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না।
আবার মিলিন্দ প্রশ্ন গ্রন্থে ত্রিপিটক শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে। সুতরাং ত্রিপিটকের চুড়ান্ত সংকলনের পূর্বে অর্থাৎ খৃঃপূঃ দ্বিতীয় বা প্রথম শতাব্দীর মধ্যে যে অভিধম্ম পিটক সংকলিত হয়েছিল নিঃসন্দেহে মেনে লওয়া যায়। কোন কোন পন্ডিত মনে করেন অভিধম্ম পিটক সিংহলে সংকলিত হয়েছিল।
বিখ্যাত বৌদ্ধাচার্য বুদ্ধ দত্তের মতে, অভিধর্ম পিটকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় চারটি চিত্ত, চৈতসিক, রুপ ও নির্বাণ। এই চারটি বিষয়কে সংক্ষেপে দুইটি বিষয়ে রুপান্তরিত করা যায় রুপ ও অরুপ। যা চিন্তা করা যায় তাই চিত্ত। চিত্তের অপর নাম মন, অন্তকরণ, হৃদয়, বিজ্ঞান ইত্যাদি। এদের যে কোন একটি অপরটির প্রতিশব্দ রুপে ব্যবহৃত হতে পারে। মনন, চিন্তন ও বিজ্ঞানন মন বা চিত্তের ধর্ম। আলম্বণ, আরম্মন বা অবলম্বন বিষয়ে চিন্তা করা বা জ্ঞাত হওয়া চিত্তের স্বভাব।
চিত্ত সাধারণতঃ ভাস্বর। চৈতসিক বা চিত্তবৃত্তি সহযোগে এটি সংশ্লিষ্ট হয়। চিত্ত ও চৈতাসিক এক নয় আবার ভিন্ন ও নয়। চিত্ত ব্যতিত চৈতাসিকের কল্পনা করা বৃথা। চৈতসিকে মনের সাথে এক সঙ্গে উৎপন্ন হয় এবং এক সঙ্গে নিরুদ্ধ হয়। এরুপ চিত্ত বা চিত্ত বৃত্তির সংখ্যা বায়ান্ন। এই বায়ান্ন প্রকার চৈতিসিক মনের সাথে যুক্ত হয়ে উননব্বই বা বিস্তৃতভাবে একশত একুশ প্রকার চিত্ত উৎপত্তির হেতু হয় প্রত্যেক চিত্তে কত প্রকার, চিত্ত বৃত্তি একক বা দল বদ্ধ ভাবে উৎপন্ন হয়, অভিধর্ম পিটকে এটি সুন্দর ভাবে প্রদর্শিত হয়েছে।
অভিধর্ম পিটকে আর ও বলা হয়েছে যে, নির্বাণ লোকুত্তর ধর্ম এর উৎপত্তি ও বিনাশ নেই। চার প্রকার আর্য মার্গ, শ্রামণ্য ফল ইত্যাদি অসংস্কৃত ধর্মই লোকুত্তর ধর্ম। পরমার্থিকভাবে নির্বাণ বিদ্যমান। কারণ এটি শুধু অভাবাথর্ক নয়। এটি পরমার্থিক ভাবে বিদ্যমান আছে বলে মার্গ চিত্ত ও ফল চিত্তের আলম্বন হয় । নির্বাণ অবলম্বন ব্যতিত মার্গ চিত্ত ও ফল চিত্ত উৎপন্ন হয় না।
অভিধর্ম পিটকের অর্ন্তভূক্ত সাতটি গ্রন্থ। যথা- ধম্ম সঙ্গনি, বিভঙ্গ, ধাতুকথা, পু¹ল পঞ্ঞত্তি, কথাবুত্থ, যমক ও পট্ঠান। এই সাতটি গ্রন্থকে একত্রে সত্তপকরণ বা সপ্তপ্রকরণ বলা হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে,অভিধর্ম হচ্ছে ত্রিপিটকে একটি গুরুত্বপূর্ন অংশ। এর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে চিত্ত, চৈতসিক, রুপ ও নির্বাণ। এতে সুত্রপিটকে উল্লেখ্য বিষয় বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
0 Comments