ইতিহাসের নির্মম সত্য
ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু
ব্রাহ্মণ্য ধর্মে এমন কিছু ছিলনা যাকে নৈতিকতার আধারে বিচার করা যায়। তাঁরা সব কিছু বৌদ্ধদের কাছ হতে চুরি করে বা ধার করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মোহর লাগিয়ে তা হিন্দু ধর্মরূপে প্রচার করে আসছে।এখানে আমি তার কয়েকটি মাত্র দৃষ্টান্ত দেব।
১) গুরু পূর্ণিমা:-
গৌতম বুদ্ধ আষাঢ়ী পূর্ণিমার দিনে সারনাথে প্রথমবার পাঁচ জন ঋষি বা পরিব্রাজককে দীক্ষা দিয়েছিলেন। সেদিন তাঁরা বুদ্ধকে গুরুবলে স্বীকার করেছিলেন বলে আষাঢী পূর্ণিমাকে গূরু পূর্ণিমা রূপে মান্য করে আসতেন। বৌদ্ধ পরম্পরায় তা অনুসরণ করে এ দিনে ভিক্ষুরা গুরু দর্শনে বা বুদ্ধ পূজায় আসতেন। বৌদ্ধধর্ম সমাপ্ত হলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের টীকাদারেরা তা কব্জা করে নিজেদের গুরু পুর্ণিমা চালু করে বসেন।
২) কুম্ভ মেলা:-
কুম্ভমেলার প্রবর্তন করেছিলেন বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭)। উদ্দেশ্য ছিল মেলা আয়োজন করে বুদ্ধের বিচার ধারাকে সর্বসাধারণের নিকট পৌঁছে দেওয়া। এ মেলাতে দূর দুরান্ত থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষু- শ্রামণ, রাজা, প্রজা ও সৈনিকেরা অংশ গ্রহণ করতে আসতেন। বৌদ্ধ ধর্মের পতনের পর ব্রাহ্মণেরা অন্ধবিশ্বাস ডুকিয়ে কাহিনী বানিয়ে তা কুম্ভ মেলায় রূপ দেয়।
৩) চার ধাম যাত্রা:-
বৌদ্ধ ধর্মে চার ধাম বা চার পুণ্যস্থানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। চার পুণ্যস্থান হল লুম্বিনী, বুদ্ধগয়া, সারনাথ ও কুশীনগর। বুদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণী, উপাসক-উপাসিকা প্রত্যককে জীবনে একবার চার তীর্থস্থান দর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। বৌদ্ধধর্মের চার তীর্থকে নিজেদের কাল্পনিক দেবী- দেবতাদের মন্দিরে পরিবর্তন করে তাদের ধর্মের গুরুত্ব দিতে চার ধাম যাত্রা শুরু করেছে।
৪) জাতক কথা:-
জাতকের গল্পগুলো বৌদ্ধধর্মে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। জাতকের গল্পের দ্বারা বুদ্ধ বোধিসত্তের দশ পারমী অনুশীলনের বর্ণনা করে শ্রোতাদের বুঝাতেন। পরবর্তীকালে এ সমস্ত জাতক কথা নানা দেশে নানা ভাবে তাদের মত করে সাজিয়ে কাহিনী রচনা করেছে। বৌদ্ধধর্মকে পতন করে ব্রাহ্মণেরা জাতকের গল্পকে ব্রাহ্মণীকরণ করে ব্রাহ্মণেরা নিজেদের ধর্মে ডুকিয়ে ফেলে। এবং জাতকের সাথে কিছু মনগড়া কাল্পনিক মসলা মিশিয়ে ও ঐতিহাসিক বৌদ্ধ স্থলের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে রামায়ন ও মহাভারত রচনা করেছে। এ সম্পর্কে ড. সুকুমার সেনের মত কিছু গবেষক ও বিশেষজ্ঞ লেখালেখি করলে কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন।
৫) বিজয়া দশমী বা দশহরা:-
খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোক ভয়ানক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কলিঙ্গ বিজয় করার পর আশ্বিন দশমীর দিনে বৌদ্ধধর্মকে আলিঙ্গন করেছিলেন। এ দিন অশোকা বিজয়া দশমী নামে প্রসিদ্ধ ছিল। এদিনে ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙগ মৌর্য বংশের দশম রাজা বৃহদ্রথ মৌর্যকে হত্যা করেছিলেন। মৌর্য সম্রাটেরা দশ পারমিতা পালন করতেন। বৃহদ্রথকে হত্যার মাধ্যমে মৌর্য বংশের দশ রাজার শাসনের অবসানের প্রতীকরূপে ব্রাহ্মণেরা এ দিন দশমুণ্ড রাবণের দহন প্রথা চালু করে দশহরা পালন শুরু করে।
বৌদ্ধধর্ম সমাপ্ত করে ব্রাহ্মণেরা এ দিনে কাল্পনিক কথা রামায়নের রাম- রাবনের কাহিনী জুড়ে দশহরা বানিয়ে দেয়। তুলসী দাসের রাম চরিত মানস অনুসারে রাবণ চৈত্র মাসেই মারা যান। আশ্বিন মাসে নয়।
৬) দীপাবলী উৎসব:-
সম্রাট অশোক সমগ্র ভারত বর্ষে ৮৪০০০ বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহার নির্মাণ করিয়েছিলেন। এ সমস্ত স্তূপ ও বিহার নির্মাণের পর সেগুলোর উদ্ঘাটন ও উৎসর্গ অনুষ্ঠান কার্তিক অমাবশ্যায় করেছিলেন। অনুষ্ঠান উপলক্ষে সমগ্র জম্বুদীপ (ভারত)ব্যাপী দীপ জালিয়ে আলোকোৎসব করেছিলেন। এবং তা স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রতিবছর ‘দীপদানোৎসব’ নামে পালন করা হত। সমস্ত চৈত্য সমূহ কেবল ভারতেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এ দীপ দানোৎসব ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল। বৌদ্ধ রাজত্ব ধ্বংসের পরে ব্রাহ্মণেরা তাঁদের ধর্মের সাথে জুড়ে দিতে কাল্পনিক পাত্র রামায়নের রামের সংযুক্তি করণ করে দীপাবলী উৎসব পালনের রেওয়াজ করে।
৭) লিঙ্গ-যোনী পূজা:-
পুষ্যমিত্র শুঙগের পতনের পরে প্রথম শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মের দুর্দশা শুরু হয়। ব্রাহ্মণেরা ভিক্ষুদের সাথে তর্ক করতে বলত ঈশ্বর আছে যিনি সৃষ্টি করেছেন। তোমাদেরকেও ঈশ্বরই বানিয়েছেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ব্রাহ্মণদের বলতেন ঈশ্বর হল কল্পনা মাত্র। মনুষ্য লিঙ্গ- যোনীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে। এবং ইহা প্রাকৃতিক পদ্ধতি। ব্রাহ্মণেরা প্রতিক্রিয়া স্বরূপ নিজেদের শক্তি বলে ভিক্ষুদেরকে লিঙ্গ- যোনী মূর্তি বানিয়ে পূজা করতে বাধ্য করেছিলেন। পরে ইহাকে মনগডা কাহিনী বানিয়ে পুরাণের শিবের সাথে জুড়ে দেন। এবং অন্ধবিশ্বাসী লোক লিঙ্গ-যোনীকে শিব লিঙ্গ বলে পূজা চালু করে।
৮) ব্রাহ্মণদের ব্যবসায়িক কেন্দ্র মন্দির:-
বর্তমানে যেখানে যেখানে ব্রাহ্মণদের কাল্পনিক দেব-দেবীদের বড় বড় মন্দির আছে সে সবের প্রত্যেকটিতে ছিল বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার কেন্দ্র। যেমন: অযোধ্যা, কাশী, রামেশ্বরম, মথুরা, পুরী, তিরুপতি প্রভৃতি। বৌদ্ধ ধর্ম পতনের পর সমস্ত মন্দিরকে কব্জা করে রূপ পরিবর্তন করে। আপনারা গিয়ে দেখতে পারেন বর্তমানে তিরুপতি বালাজী মন্দিরের মূর্তি স্বয়ং বুদ্ধমূর্তি। এ মন্দিরকে ব্রাহ্মণেরা দখল করে বুদ্ধকে আভূষণ ও কাপড় লাগিয়ে পৃথক নাম দিয়েছে। তিরুপতি যে বুদ্ধ মন্দির ছিল তার অকাট্য প্রমাণ দিয়েছেন ড. যমুনা দাস লিখিত তাঁর ‘ Tirupati was a Buddhist Shrine’ বইতে। ইহাকে কেহ বালাজী, কেহ বেন্কট্শ্বর, কেহ শিব, কেহ হরিহর, কেহ কৃষ্ণ এবং কেহ শক্তি বলে থাকেন।
ইতিহাসে প্রমাণ পাওয়া যায় পুরী মন্দিরও ছিল বুদ্ধ মন্দির। ইহার আসল নাম ছিল দন্তপুরী। কারণ সেখানে বুদ্ধের দাঁত ছিল। পরবর্তীতে দাঁত শ্রীলংকায় স্থানান্তরিত হলে ব্রাহ্মণেরা দখল করে দন্তবাদ দিয়ে কেবল পুরীটাই রেখেছে।
বুদ্ধগয়া মন্দিরেও তো যে মূর্তি সমূহকে পাঁচ পাণ্ডবরূপে ব্রাহ্মণেরা দখল করে পূজা করছে সেগুলোওতো বুদ্ধমূর্তি। তা তো দিবালোকের মত পরিস্কার।কপালে সিন্দুর ও গায়ে লাল কাপড় জড়িয়ে দিলেই কি পাঁচ পাণ্ডব বানানো যায়?
৯) বট বৃক্ষ পূজা:-
বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বে সন্ন্যাসী অবস্থায় সিদ্ধার্থ বুদ্ধগযার সেনানী গ্রামে বটবৃক্ষের নীচে বসেছিলেন। সে গ্রামের মেয়ে সুজাতা বটবৃক্ষের নীচে বৃক্ষদেবতাকে পূজা দিতে গিযে সেখানে সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থকে দেখতে পেয়ে বৃক্ষ দেবতা মনে করে তাঁকে পূজা করেছিলেন। এবং সারনাথে বুদ্ধ তাঁর প্রথম ধর্মেপদেশ পাঁচজন ঋষিকে বটবৃক্ষের নীচেই দিয়েছিলেন। এজন্য লোকেরা বটবৃক্ষকেও পূজা করত। পরবর্তীতে বাহ্মণেরা ইহাকে নিজেদের কাল্পনিক কাহিনী সত্যবান- সাবিত্রীকে জুড়ে দিয়ে পূজা করতে আরম্ভ করে।
১১) শির মুণ্ডন:-
বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিজেদের চুল কেটে মুণ্ডন করে থাকতেন। বৌদ্ধ ধর্ম নষ্ট করার পর ব্রাহ্মণেরা ভিক্ষুদের প্রতি ঘৃণার্থে মৃত্যুর পরে পরিবারের লোকদের মুণ্ডন সংস্কার চালু করেন।
এভাবেই ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধধর্মের সবকিছু বিকৃত করে গ্রাস করে বসে। ইহাই ইতিহাসের নির্মম সত্য।
0 Comments