Hot Posts

6/recent/ticker-posts

Ad Code

বেদনানুস্মৃতিতে চার আর্যসত্য ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু

 বেদনানুস্মৃতিতে চার আর্যসত্য

ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু
চারি আর্য সত্য হল বুদ্ধ শিক্ষার সার। পালি সাহিত্যের অঙ্গুত্তর নিকায়ে বুদ্ধ ব্যক্ত করেছেন-
‘বেদিযমানস্স খো পনাহং, ভিক্খবে, ইদং দুক্খংতি পঞ্ঞাপেতি, অযং দুক্খ সমুদযোতি পঞ্ঞাপেতি, অযং দুক্খ নিরোধোতি পঞ্ঞাপেতি, অযং দুক্খ নিরোধগামিনীপটিপদাতি পঞ্ঞামি।’
অর্থাৎ ভিক্ষুগণ! যারা বেদনা সমূহকে অনুভব করে থাকে, তাতে আমি দুঃখ আর্য সত্য শিখিয়ে থাকি, দুঃখ সমুদয় আর্যসত্য শিখিয়ে থাকি, দুঃখ নিরোধ আর্যসত্য শিখিয়ে থাকি এবং দুঃখ নিরোধগামিনী প্রতিপদা আর্যসত্য শিখিয়ে থাকি।
এখানে এ পরিচ্ছেদে বুদ্ধ সুস্পষ্ট বলেছেন যে, চার আর্যসত্যকে কেবল বেদনার সাহায্যে জ্ঞাত হওয়া যায়, অনুভব করা যায় এবং অনুশীলন করা যায়। তিনি আর্যসত্যকে বেদনার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে গিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন যে-
‘যং কিঞ্চি বেদযিতং, তংপি দুক্খস্মি’ অর্থাৎ যে সমস্ত বেদনা অনুভব হয়ে থাকে, তার সবই হল দুঃখ।
দুঃখ বেদনা অপ্রিয়ই হয়ে থাকে। কিন্তু সুখ বেদনা এবং অদুঃখ-অসুখ বেদনাও নিজের অনিত্য স্বভাবের কারণে দুঃখই হয়ে থাকে। উৎপন্ন হয়ে বিলয় হয়ে যাওয়া হল অনিত্যতার বৈশিষ্ঠ্য। প্রত্যেক সুখ বেদনার মধ্যে দুঃখের বীজ নিহিত রয়েছে। কেননা তা নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা অজ্ঞানতা বশতঃ এরূপ মনে করি যে, যখন কোনো প্রিয় বেদনা উৎপন্ন হয়ে থাকে, ইহার অনিত্য স্বভাবকে না জেনেই ইহার প্রতি রাগ এবং আসক্তি প্রতিক্রিয়া করে থাকি। তাহাই আমাদের দুঃখের সূচনা করে থাকে। ‘তণ্হা দুক্খস্স সম্ভবং’ অর্থাৎ তৃষ্ণাই হল দুঃখের মূল।
বাস্তবে, রাগই দুঃখের উদ্গম নয়। বরং দুঃখ নিজেই হয়ে থাকে। যখনই রাগ উৎপন্ন হয়, তখন দুঃখ জাগ্রত হয়। ভগবান বুদ্ধ চার আর্যসত্যের মধ্যে দ্বিতীয় আর্যসত্যের ব্যাখ্যায় ‘তণ্হা পচ্চযা দুক্খা’ তৃষ্ণার কারণে দুঃখ না বলে ‘দুক্খ সমুদয’ বলেছেন। অন্য শব্দে রাগ দুঃখের পূর্ব শর্তমাত্র নয়; ইহা স্বয়ং দুঃখ হতে অবিভাজ্য অর্থাৎ অপৃথককারী। ‘তণ্হা দুক্খস্স সম্ভবং’ এরূপ কথনে আমরা ইহার শক্তি জানতে পারি।
বস্তুতঃ ‘তণ্হা’ এবং ‘দুক্খ’ হল সহজাত। যখনই তৃষ্ণা জাগ্রত হয়, ব্যক্তি তৎক্ষণেই চিত্তের সমতা হারিয়ে ফেলে। অশান্ত হয়ে যায়, উদ্বিগ্ন হয়ে যায়। অন্য শব্দে বলা যায় যে, তখনই দুঃখ অনুভব করতে থাকে। সেরকম যখন বেদনা উৎপন্ন হয়ে থাকে এবং তা তৃষ্ণায় পরিবর্তন হয়ে যায়, তখন তা হল দুঃখই।
সুতরাং, যখন কখনও ‘বেদনা’ শব্দের প্রয়োগ ধম্ম ধারণ সম্বন্ধে করা হয়ে থাকে, তা দুঃখের বোধই ব্যক্ত করে থাকে। এমন কি তটস্থ বা অদুঃখ-অসুখ বেদনাও সেরকম, যদি ইহার অনিত্য স্বভাবের উপেক্ষা করে দেওয়া হয়। এজন্য কেবল দুঃখ বেদনার জন্যই নয়, কিন্তু সুখ বেদনা এবং অসুখ বেদনার জন্যও ভগবান বুদ্ধ যথার্থ ‘বেদনা’ শব্দের প্রয়োগ দুঃখের পর্যায়েই করেছেন।
চার আর্যসত্য সম্বন্ধে আবার এ তথ্যের উপর জোর দিতে গিয়ে ভগবান বুদ্ধ সুত্ত নিপাতের ‘দ্বযযাতনুপস্সনা সূত্ত’ তে বলেছেন-
‘যং কিঞ্চিদুক্খং সম্ভবোতি সব্বং বেদনা পচ্চযাতি অযমেকানুপস্সনা। বেদনানং ত্বেব অসেস বিরাগ নিরোধা নত্থি দুক্খস্স সম্ভবোতি, অযং দুতিযনুপস্সনা।’
অর্থাৎ যা কিছু দুঃখ উৎপন্ন হয়ে থাকে, সেগুলি বেদনার কারণে হয়ে থাকে, এ প্রথম অনুপস্সনা যা নিরন্তর স্মৃতি দ্বারা দেখতে হবে। বেদনার সম্পূর্ণ সমাপ্তি হলে এরপর কোনো দুঃখ উৎপন্ন হয়না। ইহা হল দ্বিতীয় অনুপস্সনা।
প্রথম অনুপস্সনা হল বেদনাকে নিরন্তর দুঃখ বলে জানা। দ্বিতীয় অনুপস্সনায় সে বাস্তবিকতা, যা বেদনা, স্পর্শ এবং ষডায়তনের ক্ষেত্র হতে উর্ধে, যা হল একজন অরহতের নিরোধ সমাপত্তির স্থিতি। অর্থাৎ নৈর্বাণিক অনুভূতি। এ দ্বিতীয় অনুপস্সনার দ্বারা সাধক-সাধিকা এরূপ সত্যের সাক্ষাতকার করে থাকেন যে, নিরোধ সমাপত্তির অবস্থায় দুঃখ থাকেনা। কারণ, সেখানে কোনো বেদনাই থাকেনা। তা বেদনার ক্ষেত্র থেকে বাহিরে।
এখানেই বুদ্ধ আরও বলেছেন-‘সুখং বা যদি বা দুক্খং, অদুক্খমসুখং সহ অজ্ঝত্তং চ বহিদ্ধা চ, যং কিঞ্চি অত্থি বেদিতং, এবং দুক্খং তি ঞত্বান, মোস ধম্মং পলোকিনং, ফুস্স ফুস্স বযং পস্স, এবং তত্থ বিরজ্জতি, বেদনানং খযা ভিক্খু, নিচ্চতো পরিনিব্বুতো।’
যা কিছু প্রিয়, অপ্রিয় বা তটস্থ বেদনা শরীরের ভিতরে বা বাহিরে অনুভব করে থাকে, তার সবই হল ভ্রান্তিজনক। সেগুলি হল ভঙ্গুর, সে সব হল দুঃখ। একজন সাধক বা সাধিকা দেখে থাকেন যে, যা কিছু শরীরে স্পর্শ হয়ে থাকে, বেদনা অনুভূত হয় সে সব যেভাবে উৎপন্ন হয় সেভাবে ক্ষয় হয়ে যায়। বেদনা সমূহের ক্ষয়ের সাথে যখন এর সত্যকে জেনে থাকেন, তখন সাধক বা সাধিকা রাগ হতে মুক্ত হয়ে যান। পূর্ণ বিমুক্ত হয়ে যান।
এরূপ সত্যে যে ব্যক্তি উত্তমরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকেন, তিনি বেদনার প্রতি রাগ এবং আসক্তির স্বভাব হতে মুক্ত থাকেন এবং সে স্থিতি পর্যন্ত পৌঁছে থাকেন, যেখানে কোনো বেদনাই আর থাকেনা। (তা হল নির্বাণের স্থিতি, যা হল দ্বিতীয় অনুপস্সনায় পৌঁছা)। একজন সাধক বা সাধিকা যিনি অরহত্ব ফলের স্থিতি অনুভব করে নিয়েছেন, তিনি ‘নিচ্ছাতো’ (সমস্ত কামনা হতে মুক্ত) হয়ে যান। এরকম ব্যক্তি ‘পরিনিব্বুতো’ অর্থাৎ সর্বথা মুক্ত হয়ে থাকেন।
এজন্য ‘দুক্খ সচ্চ’ (দুঃখ সত্য), ‘সমুদয় সচ্চ’ (দুঃখের উদয়), ‘নিরোধ সচ্চ’ (দুঃখের বিলয়) এবং ‘দুক্খনিরোধগামিনী পটিপদা সচ্চ’ (দুঃখ সমাপনের দিকে নিয়ে যাওয়ার মার্গ) কে অনুভব করতে এবং বুঝার জন্য ব্যক্তিকে বেদনা সমূহের সঙ্গে কাজ করতে হয় এবং বেদনার সত্যকে (বেদনা সচ্চ), বেদনার সমুদয়কে (বেদনা সমুদয সচ্চ), বেদনার নিরোধকে (বেদনা নিরোধ সচ্চ) এবং বেদনা নিরোধের মার্গকে (বেদনা নিরোধগামিনী পটিপদা সচ্চ) জানা আবশ্যক।
এ সম্বন্ধে ‘বেদনা সংযুক্ত’ বিভাগের ‘সমাধি সূত্র’ তে বুদ্ধ স্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছেন যে-
‘সমাহিতো সম্পজানো, সতো বুদ্ধস্স সাবকো বেদনা চ পজানাতি, বেদনা চ সম্ভবং যত্থ চেতা নিরুজ্ঝন্তি মগ্গং চ খযগামিনং বেদনানং খযা ভিক্খু নিচ্চতো পরিনিব্বুতো তি।’
অর্থাৎ বুদ্ধের শ্রাবক (অনুসারী) সমাধি, সম্প্রজন্য এবং অনিত্যতাকে নিরন্তর প্রজ্ঞাপূর্বক বেদনা সমূহকে, বেদনার উদয়কে, বেদনার নিরোধকে এবং বেদনা নিরোধের মার্গকে জেনে থাকেন। একজন সাধক বা সাধিকা যিনি বেদনার সমাপ্তিতে পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছেন, তিনি রাগ হতে মুক্ত হয়ে গিয়েছেন, পূর্ণতঃ মুক্ত হয়েছেন।
অতঃপর ভগবান বুদ্ধ আরও জোর দিয়ে বলেছেন যে-‘অরিযো অট্ঠঙ্গিকো মগ্গো’ অর্থাৎ অষ্ট অঙ্গ সম্পন্ন মার্গের লক্ষ্য হল বেদনার জ্ঞান এবং ‘বেদনা নিরোধ’ পর্যন্তের স্থিতিতে পৌঁছে যাওয়া।
বুদ্ধের বচন হল এরূপ-‘তিস্সো ইমা ভিক্খবে বেদনা। কতমা তিস্সো? সুখ বেদনা, দুক্খা বেদনা, অদুক্খমসুখ বেদনা। ইমা খো, ভিক্খবে, তিস্সো বেদনা। ইমাসং খো, ভিক্খবে, তিস্সানং অভিঞ্ঞায পরিঞ্ঞায পরিক্খায পহানায…… অযং অরিযো অট্ঠঙ্গিকো মগ্গো ভাবেতব্বো…….।’
অর্থাৎ ভিক্ষুগণ! বেদনা তিন প্রকারের হয়ে থাকে। সে তিন প্রকার কি কি? প্রিয় বেদনা, অপ্রিয় বেদনা এবং অদুঃখ-অসুখ বা তটস্থ বেদনা। ভিক্ষুগণ! সম্পূর্ণ বোধ, ক্রমিক উন্মুলন এবং এ তিন প্রকারের কায়িক বেদনা সমাপ্তির জন্য আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলন করা উচিত।
বেদনা সমূহ হল উপকরণ, যেগুলির দ্বারা আমরা চার আর্য সত্যের উপর অনুশীলন করতে পারি এবং অনিত্য স্বভাবকে জ্ঞাত হয়ে অবিদ্যা এবং তৃষ্ণার বন্ধন সমূহ হতে মুক্ত হতে পারি এবং পরম সত্য নির্বাণ, দুঃখ বিমুক্তি, তা হল এমন এক স্থিতি যা বেদনার ক্ষেত্রের উপরে নাম-রূপের ক্ষেত্রের উপর পর্যন্ত পৌঁছানো যায়।



Post a Comment

0 Comments

Ad Code

Responsive Advertisement